শহীদ জিয়াউর রহমান: বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রূপকার

জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত এক মহান নেতা। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই ব্যক্তিত্বের সামরিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে। একজন চৌকস ও সৎ অফিসার হিসেবে তিনি দ্রুতই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
১৯৭১ সালে জাতির এক গুরুতর ক্রান্তিকালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা এ দেশের মানুষের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করে। পরবর্তীতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তিনি সিপাহি-জনতার এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ভরকেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৮১ সালে শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে তার শাসনামলের (১৯৭৫-১৯৮১) অবসান ঘটে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান শুধুমাত্র রাজনীতি, অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, বরং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। একজন সংস্কৃতিমনা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি জাতীয় জীবনে সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং এর উন্নয়ন ও বিকাশে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন
জিয়াউর রহমান ছিলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর প্রবক্তা, যা ছিল এক নতুন রাজনৈতিক দর্শন। এই জাতীয়তাবাদে তিনি ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও সংস্কৃতিনির্বিশেষে সব নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমাদের সংস্কৃতি আমাদের দেশজ কৃষ্টির ধারক ও বাহক এবং এর রয়েছে এক অনন্যসাধারণ ঐতিহ্য।
১৯৮১ সালের ৮ জুলাই দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' শীর্ষক এক নিবন্ধে জিয়াউর রহমান তার এই দর্শন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপনা, আন্তরিকভাবে ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।' তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ এ দেশের সংস্কৃতিকে দিয়েছে দুর্বার শক্তি।' এই চেতনার আলোকে তিনি আমাদের সংস্কৃতির নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্যকে আরও মহিমান্বিত করার ব্যাপারে তার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করতেন, প্রতিটি জাতির মনন ও রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। তাই একটি জাতির টিকে থাকার জন্য তার সংস্কৃতিকে রক্ষা ও বিকশিত করা অপরিহার্য।
সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ
জিয়াউর রহমান সংস্কৃতিচর্চার বিকাশের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন। তার এই উদ্যোগগুলো ছিল সুপরিকল্পিত এবং দূরদর্শী।
১. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর তিনি 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা' (জাসাস) প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির সৃজনশীল প্রতিভার সুষ্ঠু ও সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়ার সংগঠিত উন্নয়ন ঘটানো। বিএনপি-র প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রের ২৮ নম্বর ধারায় এই অঙ্গীকার স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয় যে, দেশের প্রতিটি এলাকায় সংস্কৃতি ও ক্রীড়া কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে এবং জীবনমুখী লোক প্রচেষ্টা ও প্রতিভাশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।
২. বাংলা একাডেমি
শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের ও আত্মোপলব্ধির অবিচ্ছেদ্য উপাদান। তাই তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে নিয়োজিত সর্ববৃহৎ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ৬ জুন তিনি 'দি বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮' জারি করেন, যা বাংলা একাডেমির পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি কাঠামো হিসেবে আজও কাজ করছে। এই অধ্যাদেশ বাংলা একাডেমির কার্যক্রমকে সুসংহত ও বলিষ্ঠ করতে সহায়তা করে।
৩. বাংলাদেশ শিশু একাডেমি
তিনি শিশুদের মানসিক ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশ বলে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে 'বাংলাদেশ শিশু একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশে এই প্রতিষ্ঠানটি বছরব্যাপী যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো 'জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা', যার দ্বার তিনি ১৯৭৮ সালে উন্মোচন করেন।
৪. শিশুপার্ক ও 'নতুন কুঁড়ি'
কোমলমতি শিশুদের বিনোদনের কথা চিন্তা করে তিনি ১৯৭৯ সালে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে একটি শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও শিশুদের একটি প্রিয় স্থান। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'নতুন কুঁড়ি' নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এমন অনেক প্রতিভার জন্ম হয়, যারা আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন।
৫. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায়, সে বিষয়ে জিয়াউর রহমান সচেতন ছিলেন। তাই তিনি এই সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে 'উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট' (বর্তমানে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট') এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে 'উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যান্য অবদান
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের আরও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন:
• চলচ্চিত্র শিল্প: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে তিনি ঢাকার অদূরে গাজীপুরে একটি চলচ্চিত্র নগরী, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া, তিনি সৃজনশীল ও উন্নতমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন এবং 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' প্রদান অব্যাহত রাখেন, যা আজও দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা।
• গণমাধ্যম: সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের বিকাশের জন্য তিনি 'প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)' প্রতিষ্ঠা করেন, যা সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার আমলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের রঙিন ট্রান্সমিশন চালু হয়, যা সাংস্কৃতিক উপস্থাপনাগুলোকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে এবং সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কৃতির প্রচার বাড়ায়।
• পদক প্রবর্তন: শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি 'একুশে পদক' ও 'স্বাধীনতা পদক' প্রবর্তন করেন, যা আজও দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা হিসেবে বিবেচিত। এই পদকগুলো গুণীজনদের কাজের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আরও উৎসাহিত করে।
• জাদুঘরের উন্নয়ন: বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উন্নয়নে তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান শুধু রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান রেখে গেছেন। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংস্কৃতির গুরুত্ব যে অপরিসীম, এই সত্য উপলব্ধি করে তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য নানামুখী কর্মতৎপরতা চালান। তাই বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের যে দিকেই তাকানো হোক না কেন, সেদিকেই জিয়ার হাতের স্পর্শ দেখা যায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে শহীদ জিয়ার এসব অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ইতিহাস থেকে কারো অবদান জোর করে মুছে দেয়া যায় না, কারণ ইতিহাস তার আপন গতিতেই চলে।
.লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ
(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন