গোপালগঞ্জ সহিংসতা: বিবেক জাগ্রত করি

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
  প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৮:৩৯| আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৮:৪৩
অ- অ+

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে। এই ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। গোপালগঞ্জে ১৬ জুলাই ২০২৫ সালের এই সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করলেও তাতে কাজ না হওয়ায় ঘটনার পর কারফিউ দেয় সরকার, যা পরবর্তীতে আরো বাড়ানো হয়। এই ঘটনা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও গণমাধ্যম।

গোপালগঞ্জ লঙ্কাকাণ্ড ও হতাহতের বিষয়ে আমরা নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে ধারণা পেতে দুটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করতে পারি। প্রথমত এ ঘটনায় সবচেয়ে বড় অপরাধটা কি এবং এটা কে বা কারা করেছেন? দ্বিতীয়ত অপরাধ বিজ্ঞানে ঘটনা ঘটার কারণ নির্ণয় করতে প্রথমেই সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা হয়, ঘটনায় সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী কে বা কারা?

এ ঘটনার স্টেক হোল্ডার বা অংশীজনরা কে কি ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে আলোকপাত করব। সর্বশেষ বড় সুবিধাভোগী অর্থাৎ ঘটনাটির মাস্টারমাইন্ড কে হতে পারে, এটা বুঝার চেষ্টা করব। আমরা এই অপরাধ বা ঘটনার অংশীজনকে তিন ভাগে ভাগ করি।

১. আমরা গোপালগঞ্জবাসীর দুর্বল বা সংকীর্ণতার দিকগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি দেশের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় গোপালগঞ্জে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারবে না? গোপালগঞ্জ কি বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্ন কোন কিছু? মতভিন্নতার কারণে তারা কি এনসিপির জনসভায় হামলা করতে পারে?

এনসিপি অথবা অন্য কোনো সংগঠনের গোপালগঞ্জে রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না? কারো কথাবার্তা আপনার বিরুদ্ধে যেতে পারে, তাই বলে আপনি তার ওপর শারীরিকভাবে হামলা করতে পারেন কি?

২. যেহেতু জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি একটি রাজনৈতিক সংগঠন। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির গোপালগঞ্জ গমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা বোঝার চেষ্টা করি। এ সময় সংগঠনটি গোপালগঞ্জে যাওয়া উচিত হয়েছে কি না বা আদৌ যাওয়ার দরকার ছিল কি না? এ সংগঠনের চলমান অন্যান্য জেলার পদযাত্রার সঙ্গে গোপালগঞ্জের কর্মসূচির সামঞ্জস্যতা রয়েছে কি না? সংগঠনটি গোপালগঞ্জবাসীর মন-মানসিকতা, পরিবেশ, সংবেদনশীলতা, তাদের চেতনা, বিশ্বাস, অনুভূতি, আবেগ এবং বিশ্বাস এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়েছে কি? এনসিপির কি গোপালগঞ্জ গিয়ে উস্কানিমূলক কথা বলা উচিত হয়েছে? এনসিপি কি তাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছিল? গোপালগঞ্জে এনসিপির নেতাকর্মীদের কথাবার্তা ও স্লোগানে তারা স্থানীয় জনগণকে এনসিপির প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন, নাকি উল্টো ক্ষিপ্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন?

৩. এবার আমরা এনসিপির কর্মসূচিতে গোপালগঞ্জবাসীর হামলার কারণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করি। এখানে বলে রাখা শ্রেয় যে, আমি গোপালগঞ্জবাসী হামলা করেছে বলার কারণ হলো, গোপালগঞ্জ জেলার একাধিক বিএনপি নেতা সামাজিক মাধ্যমে অভিমত প্রদান করেছেন এই বলে যে, নিজ জেলার সম্মান রক্ষার্থে তাদেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমনকি অদ্যাবধি এ বিষয়ে গোপালগঞ্জ জেলার অন্য কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এনসিপির ওপর হামলার ঘটনার কোনো ধরনের প্রতিবাদ করেননি। অর্থাৎ এ বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক বিষয়ে নয়, বরং তাদের জেলার মর্যাদার বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। গোপালগঞ্জ বিষয়ে ইতিপূর্বে বিভিন্ন পক্ষ হতে সামাজিক মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে উস্কানি দেওয়া হয়েছে। যেমন অন্য জেলার ক্ষেত্রে পদযাত্রা গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে মার্চ টু গোপালগঞ্জ দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে প্রকাশ্য দিবালোকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটি দীর্ঘ সময়ব্যাপী গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার কোনো ধরনের বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। বরং সরকারি বুলডোজার নিয়ে এসে বাড়িটি ভাঙ্গা হয়েছে। এ কারণে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল নিয়ে গোপালগঞ্জবাসী আতঙ্কে ছিলেন। সামাজিকমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে যে গোপালগঞ্জের নামও মুছে দেওয়া হবে। ৩২ নম্বরের ন্যায় টুঙ্গিপাড়ায়ও বঙ্গবন্ধুর মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এমন হুমকি গত এক বছর বিভিন্ন সময় সামাজিকমাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। গোপালগঞ্জে গিয়েও ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সমর্থকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, আসো আমার ওপর চড়াও হও। আরো অনেক পারিপার্শ্বিক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে গোপালগঞ্জবাসীর আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছে। এ অবস্থায় গোপালগঞ্জে এনসিপি এবং গোপালগঞ্জবাসী পরস্পর রাহাজানি, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায় লিপ্ত হয়েছে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনাও হয়েছে। অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে এনসিপি এক ধরনের প্রচারণা করলেও, গোপালগঞ্জের কর্মসূচির মধ্যে ভিন্নতা ছিল।

অন্য একটি রাজনৈতিক দলের ঘাঁটি হওয়ায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যদি একই ধরনের মার্চ টু বগুড়া, ফেনী, নোয়াখালী অথবা রংপুরের উদ্দেশ্যে হতো, তবে এ সকল জেলার বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং সংশ্লিষ্ট জেলার বাসিন্দাগণের প্রতিক্রিয়া কি ভিন্ন কিছু হতো? গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যতম ছোট একটি জেলা। ঢাকা থেকে মার্চ যেকোনো বিভাগীয় শহরে হতে পারে বা সীমান্ত বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সীমান্তবর্তী আলোচিত কোনো জেলায় হতে পারত। কিন্তু ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর মার্চ টু গোপালগঞ্জ মানে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্নমাত্রা যোগ করবেই। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে মুজিববাদ মুর্দাবাদ এ স্লোগান দিয়ে পদযাত্রা করার পূর্বে এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর গোপালগঞ্জবাসীর পক্ষ হতে কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনাটি ওই জেলায় অবস্থান করে স্থানীয় জনসাধারণকে চূড়ান্ত উস্কানি দেওয়ার পর ঘটেছে। এজন্য কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলতে পারে? লোকজন সামনে এসে আক্রমণাত্মক বা মারমুখী ভঙ্গিতে দাঁড়ালে মানতে পারতাম আত্মরক্ষার্থে গুলি করা হয়েছে। মানুষকে আপনারা পাখির মতো মেরে ফেললেন, কি এমন ঘটনা ঘটলো যাতে গুলি না করলে চলতো না। আমি অনেকগুলো ভিডিও দেখলাম, যাতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে লোকজন পালাচ্ছে, পেছন দিক থেকে তাদের ওপর গুলি করা হচ্ছে।

এমনও ভিডিও দেখেছি অচেতন বা নিথর দেহ, একাধিক ব্যক্তি মিলে বেদম পৈশাচিক কায়দায় মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছেন। বেদম পিটুনি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পর পায়ের বুট জুতা দিয়ে মারতে এবং গলায় পারা দিতেও দেখেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন ভিডিও-ও আমার চোখে পড়লো, যা দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম, যেমন একটি নিথর দেহকে চ্যাংদোলা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিল-ঘুসি ও লাথি মারছে। আরে ভাই এরা তো মানুষ।

আজকাল মানুষ অনেক সভ্য, তাই এরকম সচরাচর দেখা যায় না। মানুষের হিতাহিত জ্ঞান এতটা তলানিতে ঠেকেছে, যা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

এ হত্যাকাণ্ডের কি কোনো বিচার হবে? সেনাবাহিনী কি এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে? ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে সেনাবাহিনী ছিল, এটা কি সেই সেনাবাহিনী? এ সেনাবাহিনীর কি আমরা তখন প্রশংসা করেনি?

গোপালগঞ্জে রাজনীতি করতে গেলে সদা সর্বদা আওয়ামী লীগের হাতে নৃশংসতার শিকার হন কি? বিষয়টি এরকম নয়। এ সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী গোপালগঞ্জে দুবার বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্বিঘ্নে করে এসেছে। গোপালগঞ্জ বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি খুব কম হয়, যার অন্যতম কারণ হলো এক স্কুলের এক ছাত্র যার রোল নম্বর এক। এজন্য গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগে অতটা রাজনীতি করার প্রয়োজন হয় না। এমনটিও আমি শুনেছি গোপালগঞ্জে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের টাকাও প্রদান করেন না। কারণ বিজয় সুনিশ্চিত এজন্য টাকা খরচ করা নিষ্প্রয়োজন।

কেবলমাত্র একটা দলের ঘাঁটি হওয়ার কারণে গোপালগঞ্জবাসীকে নির্দিষ্ট দলের আঁতুরঘর, ফ্যাসিস্টের আস্তানাসহ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বা কটাক্ষ না করে, দেশের রাজনীতিবিদদের গবেষণা করা প্রয়োজন ছিল— কি কারণে গোপালগঞ্জ শেখ মুজিবুর রহমানের এত বড় ঘাঁটি। কেবলই কি বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জে হওয়ার কারণে? অন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাদের জন্ম কোনো না কোনো জেলায় হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এমনটি হলো না কেন। এ বিষয় হতে অন্যদের শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। এ বিষয়টি কাজে লাগিয়ে নিজেদের জেলায়ও এরকম শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেত না? আমাদের দেশে এক শ্রেণির লোক অন্যের সুখে সুখী না হয়ে অথবা অনুকরণ না করে, বরং নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন।

গোপালগঞ্জ মানুষের নিকট বঙ্গবন্ধু আজীবন জিন্দাবাদ। জয় বাংলা তাদের জীবনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। আর এ কারণে তারা বৈষম্যের শিকার। আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসলে গোপালগঞ্জের উন্নয়ন সবচেয়ে কম হয়। কেউ সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বা মুজিববাদকে মুর্দাবাদ বানানোর চেষ্টা করলে বিষয়টিকে তারা কখনো ভালোভাবে নেবেন না, এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। গোপালগঞ্জের অনেক মানুষের নিকট বঙ্গবন্ধু দেবতা তুল্য হবেন এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা।

কোনো নির্দিষ্ট জেলাকে আপনি যদি হিন্দু বাড়িও মনে করেন, ওই বাড়িটি কোরআন কি ওটা বোঝার আগ পর্যন্ত আপনি যদি ওখানে গিয়ে কোরআন পড়া শুরু করেন, তবে সেখানে সংঘাত অনিবার্য, কমসে কম ওই বাড়ির লোক আপনাকে বলবেন পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়। অন্যভাবে যদি বলি আপনি পীর সাহেবের খানকায় গিয়ে যদি বলেন হরে কৃষ্ণ হরে রাম। আর যদি বলেন তোমাদের পীর আমার নিকট মৃতপ্রায় বা মুর্দাবাদ। পীর সাহেবের মুরিদগণ বিষয়টি কীভাবে নেবেন এবং বিষয়টির প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেখাবেন, একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। তাদের নিকট বঙ্গবন্ধু মানেই মুজিববাদ। এ অবস্থায় অপরিচিত কিছু ব্যক্তি যাদেরকে গোপালগঞ্জের স্থানীয় ব্যক্তিগণ সরাসরি ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি।

তারা যদি কথা নাই বার্তা নাই হুট করে এসে বলেন মুজিববাদ মুর্দাবাদ, তবে প্রতিক্রিয়া নিউটনের কোন সূত্র অনুযায়ী হবে, তা আপনাদের ওপর আমি ছেড়ে দিলাম। আর ওটাই হয়েছে গোপালগঞ্জে।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণ করা মাত্রই জনগণের উদ্দেশে বললেন আজ হতে এদেশে মানুষের ওপর হত্যা ও গুলি চলবে না। তাহলে কি এখন তিনি অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট হত্যাযজ্ঞের বিচার হচ্ছে, গোপালগঞ্জ হত্যার বিচার কি হবে? এখন হয়তো আমাদের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলবেন আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানো হয়েছে। পতিত সরকারও তৎসময়ে একই কথা বলেছেন। আমরা তখনও এসব কথা মানিনি। এখনো মানবো না। আমরা অতীতেও নির্বিচারে স্বৈরাচারী সরকারের গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যাযজ্ঞকে ঘৃণা করেছি। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরেছি। এ সরকারকেও একই বার্তা দিতে চাই।

সেনাবাহিনী ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ না করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এসব ঘটনা প্রবাহে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত ম্লান হতে বসেছে। গোপালগঞ্জ হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। মনে রাখতে হবে ২০২৪ সালের আন্দোলনকারীদের শরীরে যেমন লোহিত রক্তকণিকা বা লাল ছিল, ২০২৫ সালের একই সময়ের গোপালগঞ্জের মানুষের রক্ত একই রঙ্গে প্রবাহমান। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। তাহলে গোপালগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে কি হবে?

এ ক্ষেত্রে কি গায়েবি নির্দেশে বা ওহীর মাধ্যমে নির্দেশিত হয়ে সৈনিকগণ গুলি করেছেন। এসব হত্যাকাণ্ডে নিহতের এক মা বলছেন, এখন আমার সংসারের দায়িত্ব কে নেবেন। আরেকজন বলেছেন আমাকে মা বলার আর কেউ রইল না।

এখন পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব মৃত্যুর রিপোর্ট পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি। এমনকি তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করার জন্য পরিবারগুলোর প্রতি চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত এ হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে সরকারকে সহানুভূতি বা দুঃখ প্রকাশ করে একটা বিবৃতি দিতেও দেখিনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত `জুতা আবিষ্কার‘ কবিতাটি মনে আছে? দুটি লাইন মনে লিখছি ‘করিতে ধুলা দূর, জগত হল ধুলায় ভরপুর!’ এবার দু-একটা শব্দ যোজন-বিয়োজন করে লাইন দুটি পড়তে পারেন। ‘করিতে বৈষম্য দূর, দেশ হল বৈষম্যে ভরপুর!’

আমি এ প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছি গোপালগঞ্জের ঘটনা কার পরিকল্পনায় সংঘটিত হতে পারে, এটা সর্বশেষ তুলে ধরব। অপরাধ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেকোনো ঘটনার কারণ চিহ্নিত করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ওই ঘটনার বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাবাদী কে বা কারা। দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে দুটি পক্ষ যারা পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছেন। একটি পক্ষ অনতিবিলম্বে নির্বাচন চাচ্ছেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল— বিএনপি এবং সঙ্গীয় অধিকাংশ দলও একই অবস্থানে রয়েছেন।

অপরপক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচন পেছানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা-তদবির করছেন। এই ঘটনা বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা অস্থিতিশীল অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ ঘটনাটি আগামী জাতীয় নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য একটা অজুহাত বা অপকৌশল মনে করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান নতুন হয়নি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে প্রতিটি সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয়েছে। প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের ভূমিকা অগ্রভাগে ছিল। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই একমাত্র ঘটনা ছাত্ররা ক্ষমতা নিয়ে নিল। এ ছাত্রদের বায়না যেন শেষ হচ্ছে না। একটা অনিবন্ধিত দলের নিরাপত্তা প্রদান করতে আমাদের রাষ্ট্র কোটি টাকা প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে এপিসি বা আর্মার্ড কার, পুলিশ, র‌্যাব বিজিবি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশাল বহর তাদের জন্য নিয়োজিত থাকতে হয়। প্রতি ঘণ্টায় কোটি টাকা খরচ করতে হয়। এ টাকা খরচ করে কোথাও তারা ভাবির মিছিল, কোথাও বা দুলাভাই জিন্দাবাদ মিছিল করে।

দেশের ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার এটাও নতুন কিছু নয়। এ সরকারের মধ্যে নিরপেক্ষতা আছে বলেও ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন না। এ সরকার বলছেন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিবেন। অর্থাৎ প্রতিটি দল এখন নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত বলেছেন। এ অবস্থায় সকল দলকে সমান সুযোগ দেওয়া সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল।

কোনো দল নিবন্ধিত হওয়ার পূর্বে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। এ কারণে সরকার ও অনিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠক করা অথবা নির্বাচন সংক্রান্ত স্টেক হোল্ডার হিসেবে গণ্য হতে পারেন না।

অপরিপক্ব এ ছাত্রদের কারণে গত এক বছরে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ হয়েছে। যার প্রমাণ হলো এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল। প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হয়েছে, যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ফলাফল।

অপরিপক্বতার কারণে ক্রমাগতভাবে দেশের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। গোপালগঞ্জ সহিংসতার ঘটনায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হলো পাঁচটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। এর মধ্যে পথচারী, রিকশাচালক এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও রয়েছেন।

আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার, জীবন রক্ষা সকলের অগ্রাধিকার। এরপর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা সকলের মৌলিক অধিকার। এ সরকার মৌলিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট না হয়ে রাজনীতি নিয়ে অধিক তৎপর বলে মনে হচ্ছে।

এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে পৃথিবীর ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান পাবে। এ দেশ আমাদের সকলের। এ দেশের ঐক্য, সংহতি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

আসুন দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে বৈষম্য দূর করি এবং মানবতা জাগ্রত করি। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দান করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কথাসাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ঢাকাটাইমস সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ঢাকাটাইমস কর্তৃপক্ষের নয়।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তরিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি
পঞ্চগড়ে রাস্তার কাজে অনিয়ম, অস্বীকার করায় এলজিইডি কর্মচারীকে গণপিটুনি
সাতক্ষীরায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ, আটক ৪
শার্শায় সরকারি চালের বস্তা ছিনতাই, বিএনপির ২ কর্মী গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা