মানুষ হব কবে আমরা?

মো. আবু সাঈদ
  প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৯:৩২| আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ২০:০৭
অ- অ+

মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া এক কথা, আর প্রকৃত অর্থে 'মানুষ' হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ সম্ভবত এই 'মানুষ' হয়ে ওঠা। সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছুতেই আমরা অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছি। কিন্তু মানবিকতা, সংবেদনশীলতা এবং পরোপকারের মতো মৌলিক গুণাবলির কতটা আমরা ধরে রাখতে পেরেছি?

হিলারের বন্দিদশা থেকে কোনো উপায়ে মুক্ত হয়ে এক ইহুদি যুবকের নিজের শিক্ষকের কাছে লেখা চিঠিটি আজও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। যেখানে একজন শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার গ্যাস চেম্বার বানিয়েছেন, শিক্ষিত কেমিস্ট বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করেছেন, আর শিক্ষিত ডাক্তার শিশুদের মৃত্যুর জন্য ঔষধ সরবরাহ করেছেন। এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর সেই যুবক আকুল আবেদন করেছিলেন, ‘শিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানো বন্ধ করে তারা যেন মানুষ তৈরি করেন।’

এই আবেদনটি আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ প্রতিটি সংকট আমাদের সামনে আমাদেরই অমানবিক চেহারা নতুন করে উন্মোচন করে।

সংকটে প্রকাশিত অমানবিকতা

যেকোনো জাতীয় দুর্যোগ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের মানবিকতার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু সেই অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নাই হয়ে যায়। শীতার্তদের জন্য কাপড় সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু বিতরণের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ছবি তোলা আর নিজেদের উদারতার প্রদর্শনী। বিদেশ থেকে দুস্থদের জন্য আসা দান-অনুদান সুস্থ ও সবলরাই ভোগ করে, আরাম-আয়েশে দিন কাটায়। দাবি করা হয় জনসেবা বা সমাজসেবার কথা, কিন্তু সেই সেবার আড়ালে চলে নিজেদের আখের গোছানো। অফিস, গাড়ি, বাড়ির মালিকানা বৃদ্ধি পায়, আর সুযোগ পেলেই মুনাফা লুটের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে একদল মানুষ।

এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। অথচ রমজান মাস সংযমের মাস, যেখানে ব্যয় কমার কথা। কিন্তু দেখা যায় উল্টো চিত্র, যেখানে ইফতার পার্টি আর ভূরিভোজের নামে পারিবারিক থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। রোজা সংযমের শিক্ষা দেয়, অথচ আমাদের সমাজে এর প্রয়োগ প্রায়শই অনুপস্থিত।

মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার নিষ্ঠুর বাস্তবতা

সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনার চিত্র আমাদের অমানবিকতার এক চরম উদাহরণ। যখন মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা, তখনও একদল সুযোগসন্ধানী ওত পেতে ছিল মুনাফা লুটার জন্য। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মানুষ হিসেবে লজ্জায় আমাদের মাথা নত করে দেয়। ঢাকা মেডিকেলের সামনে বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রবেশপথে ৩০ টাকার রিকশা ভাড়া ৬০ টাকা নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের সামনে পানির বোতলের দাম দ্বিগুণ, যা মানবিকতার চরম লঙ্ঘন।

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো রক্তের ব্যবসা। জরুরি প্রয়োজনে পোড়া রোগীদের জন্য যে তাজা রক্ত প্রয়োজন, সেই রক্ত সংগ্রহের নামে ব্যবসা চালানো হয়েছে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সংরক্ষিত রক্ত তাদের কোনো কাজে লাগবে না।

রিল বানানো, ছবি তোলা, সেলফি তোলার হিড়িক পড়েছিল। যা নিছকই নিজেদের প্রচারের জন্য। রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্টজন, ভিআইপিদের কথা হয়তো হেনস্তার ভয়েই এড়িয়ে গেছেন তিনি। বলেছেন ‘না বলাই ভালো’। তাদের ভিড় কেবলই বিশৃঙ্খলা বাড়ায়। গণমাধ্যমেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা গেছে বীভৎস ছবি ও অমানবিক সাক্ষাৎকার প্রচারের জন্য। যা পেশাদারিত্বের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়।

বার্ন ইউনিটের সামনে সাত ঘণ্টা কাটানোর পরও সেই প্রত্যক্ষদর্শীর অনুভূতি ছিল, ‘আমরা কতটা অমানবিক!’ তার বারবার আরিসা নামের এক শিুশুর মুখ মনে পড়ছিল। তিনি লিখেছেন, ফুলগুলোর মৃত্যু পেশাদার সাংবাদিকদেরও কাঁদিয়েছিল।

ঘটনাস্থল উত্তরায়ও মানবতা সেদিন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। দুর্ঘটনার পরপরই যখন মানুষজন পুড়ে যাওয়া শিশুদের কোলে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছিল, তখন মেট্রো স্টেশন থেকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে যেতে রিকশাওয়ালারা ৩০-৪০ টাকার ভাড়া ১২০-১৫০ টাকা চাইছিল। মডার্ন হাসপাতালে যেতে যেখানে সিএনজিওয়ালার ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা, সেখানে তারা ১০০০-১২০০ টাকা চেয়েছিল। সবাই নাকি মানবিক! কিন্তু তাদের এই কাজের মধ্য দিয়ে সেই মানবিকতার লেশমাত্র দেখা যায়নি। জাতি হিসেবে নিজেদের যে পরিচয়টা মজ্জাগত হয়ে আছে তাও প্রমাণ করে দিলাম আমরা।

নেপালে যখন একটা বড় ভূমিকম্প হলো প্রায় এক যুগ আগে, তখন বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিকরা সেখানকার খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। তাদের বরাতেই আমরা জেনেছি সেখানে ভূমিকম্পের আগে যে আলুর দাম দশ টাকা ছিল, ভূমিকম্পের পর সেই দাম কোথাও কোথাও আট টাকায়ও পাওয়া গেছে। কারণ হিসেবে নেপালি বিক্রেতা বলছিলেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের জিনিসপত্রের দাম কমা ছাড়া বাড়ে না।

আর আমাদের দেশের কথা কত বলবো! এখন আর বলতেও লজ্জা বোধ হয়। মানুষত্ব কতটুকু আর লোভ কতটুকু আমাদের মাঝে, তার মাপার কোনো যন্ত্রের সন্ধান থাকলে পরিমাপ করা যেত।

তবু আছে আশার আলো

তবে এই সব অমানবিকতার মাঝেও কিছু মানুষ সত্যিকারের মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কিছু ব্যক্তিগত গাড়ির লোকজন পুড়ে যাওয়া নিষ্পাপ শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল। কিছু মানুষ শিশুদের কোলে নিয়ে দৌড়েছিল হাসপাতালে। ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, স্বজনদের জন্য পানি ও খাবার নিয়ে এসেছিল। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন জীবন বাঁচানোর জন্য।

এসব মানবিক কাজগুলোই প্রমাণ করে, সমাজে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়লেও সেই অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি আমাদের সমাজকে।

এ কারণেই হয়তো চন্দ্র-সূর্য ওঠে এখনো এদেশের আকাশে। আর যেকোনো দুর্যোগ-বিপর্যয় আমরা উতরে যেতে পারি হাতে হাত রেখে। এই ক্ষুদ্র মানবিক প্রচেষ্টাগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষ হিসেবে আমাদের এখনো অনেক কিছু শেখার আছে। অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার আছে।

সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, এই দেবশিশুদের কষ্ট কমিয়ে দিন। আর বাবা-মায়েদের দিন সহ্য করার ক্ষমতা। হয়তো একদিন সত্যিই আমরা সেই মানুষ হয়ে উঠতে পারব, যা আমাদের জন্মগত অধিকার।

‘মানুষ’ হয়ে ওঠার দার্শনিক পথ

ফ্রেডরিখ নিৎশে তাঁর অতিমানব ধারণার মাধ্যমে মানুষের নিজেদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, প্রচলিত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষকে দুর্বল করে। সত্যিকারের মানুষ হতে হলে তাকে এই শেকল ভেঙে নিজের পথ তৈরি করতে হবে, যা অত্যন্ত কঠিন একটি প্রক্রিয়া।

প্রাচীন গ্রিক দর্শনে সক্রেটিস-প্লেটোর মতো দার্শনিকরা মানুষের আত্ম-জ্ঞান ও সদ্গুণ অর্জনের ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের মতে, ভালো মানুষ বা জ্ঞানী মানুষ হওয়া সহজ নয়, এর জন্য নিরন্তর আত্মানুসন্ধান এবং নৈতিক অনুশীলন প্রয়োজন। সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ উক্তিটি এই কঠিন যাত্রারই ইঙ্গিত দেয়।

মানুষের অস্তিত্বের জটিলতা, স্বাধীনতার বোঝা, আত্ম-অনুসন্ধানের সংগ্রাম, এবং নিজের অর্থ ও মূল্যবোধ সৃষ্টির চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা এই ধারণাকেই প্রতিফলিত করে যে, মানুষ হওয়া সত্যিই এক কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

[[email protected]]

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সচিবালয়ের ঢুকে গাড়ি ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টা, ১২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
সাঁথিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মাহবুবুল আলম বাচ্চু গ্রেপ্তার
টেকনাফে সরকারি ২ লাখ চারাগাছ কেটে ফেলার অভিযোগ
ইছামতী নদী থেকে শিশুর মরদেহ উদ্ধার ‎
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা