ভদ্রবেশি অপরাধীদের জন্য হঠাৎ মায়াকান্না

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়ালের গ্রেফতারের ঘটনায় অনেকেই মায়া কান্না শুরু করেছেন। কেউ তাদের গুরুত্বর অপরাধ নিয়ে কথা বলছেন না। বরং "কাজী হাবিবুল আউয়াল ভদ্র মানুষ ছিলেন, নোংরা রাজনীতির শিকার"-এমন একটি ন্যারেটিভ কিছু সাংবাদিককে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দাঁড় করানো হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, উনি ছিলেন মুখোশধারী ভদ্রবেশে একজন শয়তান। একই সাথে নুরুল হুদাকে আটকের আগে যে ধরণের আচরণ করা হয়েছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দু:খজনক।
রাতের ভোট আয়োজন করে চরম বিতর্কিত কেএম নূরুল হুদার বিদায়ের পর আউয়াল সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ডামি ভোট আয়োজনের কুশিলব ছিলেন। ভোটকেন্দ্র সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা দেন আউয়াল কমিশন, অনেক দেনদরবার কর্মসূচির হুমকি দিয়ে তৎকালীন ইসিতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন আরএফইডি তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করে। উনি যখন ডামি ভোট আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন তখন আমি আরএফইডির নির্বিচিত সভাপতি হই। আমি সভাপতি নির্বাচিত হলে সবচেয়ে আউয়াল কমিশন মনোক্ষুন্ন হয়েছিলেন। এজন্য পরবর্তীতে আমার উপর চালিয়ে ছিলেন অমানসিক নির্যাতন আর মানসিক নিপীড়ন। ভদ্রবেশে শয়তান আউয়াল কমিশন ফ্যাসিস্ট সুবিধাভোগী সাংবাদিকদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাদের আলাদা করে ডেকে সাক্ষাত দিতেন, আড্ডা দিতেন। আরো নানা সুবিধা দেয়া হতো। প্রতিপক্ষদের শায়েস্তা করবার পরিকল্পনা করতেন। কেমন ছিলো সেই পরিকল্পনা, একটু বলি, পড়ুন মনোযোগ দিয়ে।
"ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রস্তুত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী" এই নিউজ করবার জন্য প্রথমত আউয়াল কমিশন আমাকে শোকজ করলো। তথ্যদাতার নাম না বললে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়া হয়। ইসি সচিব জাহাংগীর তার রুমে আমাকে একদিক অকথ্য ভাষায় গালিগালাম করলো, কোন সময় যেন তার রুমে না ডুকে সেই বলে শাসিয়ে দেন। সিইসি আউয়ালের কাছে অভিযোগ করেছি, প্রতিকার পায়নি। সরাসরি আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছিলো আউয়াল কমিশন। আমি পত্রিকায় লিখেছিলাম, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সীমানা পুর্ণনির্ধারণ। ইসি কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। ডামি নির্বাচনে আমাকে হেনস্ত করবার অংশ হিসেবে ইত্তেফাকের মালিক আনোয়ার হোসেন মন্জুর আসন পিরোজপুর-২ কর্তনে ভূমিকা রাখেন আউয়াল কমিশন। এটি করবার জন্য তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান সিইসি আউয়ালকে প্রভাবিত করেন। এটির পেছনে কলকাঠি নাড়েন কিছু সাংবাদিক।
আরএফইডির ভোটেও প্রশাসনিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে আউয়াল কমিশন। আরএফইডি ভোটে সভাপতি পদে আমার প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন চ্যানেল আইয়ের সোমা ইসলাম। চূড়ান্ত ফলাফলে আমি ৩৪ ভোট আর সোমা পেয়েছিলেন ২৩ ভোট। বিজয়ী হই আমি। কিন্তু এই ভোটের আগে আমার বাসায় হামলা করা হয়। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হামলার পর ভোটের আগ পর্যন্ত টানা তিনদিন বাসা ত্যাগ করে নয়াপল্টনে হোটেল ক্যাপিটালে অবস্থান করি। আরএফইডির ভোটে আমি সভাপতি আর হিমেল (বিবিসি) সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আমাদের গ্রামের বাড়িতে ডিজিএফআই, এনএসআই দিয়ে হয়রানী করা হয়। এটির নেপথ্যে ছিলেন আউয়ালের কনসার্ন নিয়ে তারই একজন কমিশনার। সবচেয়ে দু:খজনক এবং মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো কোনভাবে আমাকে দমাতে না পেরে সবশেষ গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হয়। ডামি ভোটের আগে, বিকাল চার থেকে সাড়ে চারটা বাজে। ইসির সামনে রফিকের চায়ের দোকান। তার দুইশো গজ দূরে পুলিশ। হঠাৎ আমার ফোন, তোকে গ্রেফতারে পুলিশ এসেছে। অপরাধ কি? স্যোসাল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, যাই হোক এক বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় সেই যাত্রায় রক্ষা পাই (কোন একদিন বিস্তারিত বলবো)। আরো কি জানেন, ডামি নির্বাচনের আগেই কাওরান বাজার সরাসরি আমার উপর হামলা চালানো হয়। সেই যাত্রায় আল্লাহর রহমতে বেঁচে গিয়েছিলাম।
হাবিবুল আউয়াল ছিলেন ভদ্রবেশে একজন অপরাধী। ভদ্রতাই ছিলো তার মুখোশ। এহেন কোন অপরাধ নাই যাহা তিনি করেননি। তার কমিশনের বেশিরভাগ সদস্য দুর্নীতিগ্রস্থ ছিলেন। ৫ আগস্টের পর নির্বাচন কমিশনার আনিসুর টাকার বস্তা নিয়ে আত্মীয় স্বজনের বাসায় ঘোরাঘুরি পর্যন্ত করেছিলেন। কারণ তার বউ ছিলেন আওয়ামী লীগের বড় নেত্রী। আমি ডামি ভোট আয়োজনে ইসি ভবনে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। আমাদের আন্দোলনে আলাদা কার্ড প্রদানে আউয়াল কমিশন বাধ্য হয়। ভারত থেকে পর্যবেক্ষক ভাড়া করার অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রের বিপুল টাকা এই ভারতীয় পর্যবেক্ষকদের পেছনে ব্যয় করা হয়। তাদের রাখার ব্যবস্থা করা হয় হোটেল পর্যটনে। এই হাবিবুল আউয়াল সবচেয়ে বড় অপরাধটি করেছিলেন, ডামি ভোটের শেষ এক ঘন্টায় তিনি ১৩ শতাংশ ভোট দেখিয়েছিলেন। এটি নিয়ে তাকে বারবার প্রশ্ন করা হলেও সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। পক্ষান্তরে নুরুল হুদা সাবেক ছাত্রলীগের ঢাবির এফএইচ হলের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের স্টাইলে ইসি পরিচালনা করেছিলেন। রাতের ভোটের মাস্টার মাইন্ড ছিলেন হুদা। তিনি ইভিএমের চালুর নামে রাষ্ট্রের চার হাজার কোটি টাকা ধবংস করেছেন। নিজের ক্ষমতায় আপনভাগ্নেকে এমপি বানিয়েছিলেন।
তবে ভোট ব্যবস্থাপনা নষ্টের জন্য রাজনীতির পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও সমান দায়ী। এই দায় কোনভাবেই হুদা কিংবা আউয়াল এড়াতে পারেন না। এজন অবশ্যই তাদের বিচারের মুখোমুখী হওয়া ন্যায্যতার অংশ। রাতের ভোট এবং ডামি নির্বাচনের জন্য তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরণের ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে অনেক অপরাধ কমে আসবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

মন্তব্য করুন