দুর্বল ব্যাংকে মুদ্রা সম্প্রসারণের মাধ্যমে তারল্য সহায়তা: উপকার পাচ্ছে না আমানতকারীরা

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একাধিকবার গ্রহণ করা হয়েছে এমন কিছু পদক্ষেপ, যা সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর অন্যতম উদাহরণ হলো, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্র করে মুদ্রা সম্প্রসারণ (Expansionary Monetary Policy) প্রয়োগ করে তাদেরকে তারল্য সরবরাহ করা। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ভিত্তিতে ডিমান্ড প্রমিসরি (DP) নোটের বিপরীতে উচ্চ হারে সুদে (১০%) কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা সরবরাহ করছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করছে, এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক সহায়তা প্রক্রিয়া, বাস্তবচিত্র বলছে, এই পদক্ষেপ আর্থিক শৃঙ্খলা ও বাজারে আস্থার জায়গায় গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
ঈদের আগে ৫ ব্যাংকে ৩,০০০ কোটি টাকা সহায়তা
সাম্প্রতিক সময়েও, ঈদুল আজহার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫টি আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংককে ৩ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করেছে। এই ব্যাংকগুলো হলো: ন্যাশনাল ব্যাংক (১,০০০ কোটি টাকা), এবি ব্যাংক (৫০০ কোটি), বেসিক ব্যাংক (৫০০ কোটি), ইউনিয়ন ব্যাংক (৫০০ কোটি) এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক (৫০০ কোটি)। এই আর্থিক সহায়তা মুদ্রা ছাপিয়ে (Currency Printing) সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ, এটি ছিল মূলত ‘Deficit Monetization’ এর একটি নিদর্শন।
অর্থনীতির পরিভাষায়, এ ধরনের ব্যবস্থা মধ্য-মেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে (Inflationary Pressure) ত্বরান্বিত করে এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার (Macroeconomic Imbalance) সম্ভাবনা বাড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রাস্ফীতির একটি বড় উৎস হলো বেকিং খাতে অনিয়ন্ত্রিত তারল্য সম্প্রসারণ, বিশেষ করে যখন তা বাস্তব উৎপাদন বা প্রবৃদ্ধির অনুপাতে ঘটে না।
প্রতিশ্রুতির পরও সহায়তা: নীতি বিপর্যয়ের ইঙ্গিত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের সময় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্র থেকে ‘টাকা ছাপিয়ে’ কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও বাস্তবে সেই অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে সরে এসে তিনি এখন নিয়মিতভাবে এই সহায়তা প্রদান করছেন। নভেম্বরের এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর স্বীকার করেন যে, অন্তত ৬টি ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সহায়তা গোপনে প্রদান করা হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো হলো—ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক।
এই ঘটনাগুলো একটি নীতিগত দ্বন্দ্ব (Policy Inconsistency) এবং মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব (Lack of Transparency in Monetary Governance) নির্দেশ করে।
গ্রাহকরা পাচ্ছেন না অর্থের সুফল
যদিও এই সহায়তার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা অর্জনকে সামনে আনা হয়েছে, তবে বাস্তবে অনেক গ্রাহকই তাঁদের গচ্ছিত অর্থ উত্তোলনে ব্যর্থ হচ্ছেন। ঢাকায় অবস্থিত ন্যাশনাল ব্যাংকের এক গ্রাহক শামীমা জানান, তারা বারবার ব্যাংকে গিয়েও টাকা পাচ্ছেন না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা না এলে তারা অর্থ ফেরত দিতে পারবে না। কিন্তু সেই সহায়তা গোপনে আসায় গ্রাহকদের কাছে সে অর্থ পৌঁছাচ্ছে না।
ইউনিয়ন ব্যাংকের গ্রাহক নজরুল জানান, ১ লাখ টাকার চেক জমা দিলেও তা নিষ্পন্ন হয়নি। এমনকি কোরবানির ঈদের সময়েও তিনি মাত্র ৫ লাখ টাকা উত্তোলনে ব্যর্থ হন। এই ঘটনাগুলো আর্থিক খাতে 'ফাইনান্সিয়াল রিপ্রেশন' বা আর্থিক দমননীতির উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেখানে আমানতকারীদের প্রকৃত অধিকার কার্যত ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
সহায়তা নীতির সম্ভাব্য পরিণতি
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মন্তব্য করেছেন, কোনো কোনো ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকলেও, সেই ঘাটতি মুদ্রা ছাপিয়ে পূরণ করার প্রবণতা একটি অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, তেমনি আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও দুর্বল হয়। এটি সুদহার নির্ধারণে বিক distortions তৈরি করে এবং বাজারে মূলধন বণ্টনের দক্ষতা হ্রাস করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান অবশ্য দাবি করেছেন, সহায়তা প্রদান পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক এবং শুধুমাত্র গ্রাহকদের দায় পরিশোধের জন্যই এই অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে যেহেতু এই সহায়তা প্রক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপনীয় এবং পর্যাপ্ত নজরদারিহীন, তাই বাস্তবিক অর্থে সেই অর্থের সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রশ্নবিদ্ধ।
সমাপনী বিশ্লেষণ
বর্তমান আর্থিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একটি জটিল দ্বিধার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুদ্রানীতির কঠোরতা বজায় রাখতে হয়, অন্যদিকে আর্থিক খাতের আস্থাহীনতা দূর করতে তাকে বাধ্য হয়ে মুদ্রা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিতে হয়। এই দ্বৈত অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যখন মুদ্রা সরবরাহের বৃদ্ধি প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তখন তা মূল্যস্ফীতির জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
সার্বিকভাবে এই প্রশ্নটি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে—এই মুদ্রাসাহায্য কি আদতে গ্রাহকের হাতে পৌঁছাচ্ছে, নাকি এটি কেবল দুর্বল ব্যাংকের ক্ষত ঢাকার একটি কাঠামোগত ব্যর্থতা?
লেখক: গবেষক, ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন