সাতক্ষীরা: সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়ন প্রয়োজন

ইকবাল মাসুদ
  প্রকাশিত : ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৩৪| আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৪৩
অ- অ+

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপার লীলাভূমি সাতক্ষীরা জেলা। জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সাতক্ষীরা। দেশের অষ্টম বৃহত্তম জেলা সাতক্ষীরার ৭টি উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। এই জেলার অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আছে, যা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি চাষে বিখ্যাত। এই জেলা থেকে দেশের রপ্তানিকৃত চিংড়ির প্রায় ৭০ ভাগ হয়ে থাকে। সাতক্ষীরার চিত্তাকর্ষক ও দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আগের সারিতেই রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন 'সুন্দরবন'। বর্তমানে সাতক্ষীরা শিল্প বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর ভোমরা স্থল বন্দরের অবস্থানও সাতক্ষীরায়। অর্থনৈতিকভাবে এই জেলা মৎস্য চাষ, কাঁকড়া, মধু, আম, ডেইরি শিল্প, মৃৎশিল্প, শাক-সবজি ইত্যাদির জন্য সুপরিচিত। সাতক্ষীরার ক্রীড়াবিদরা বিশ্বে দেশে মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদাময় অবস্থানে নিয়েছে, যা এখন গৌরব গাথা।

এতো সম্ভাবনা থাকার পরেও সাতক্ষীরা দীর্ঘদিন উন্নয়ন বঞ্চিত একটি জেলা। সাতক্ষীরার অনেক থানা শহর, ইউনিয়ন ও গ্রামীণ অঞ্চল এখনো উন্নয়নবঞ্চিত। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক অবকাঠামোর অনেকটাই জরাজীর্ণ ও অপ্রতুল। বিশেষ করে জেলা শহরের সঙ্গে সংযোগকারী অনেক প্রধান সড়ক ও আন্তঃউপজেলা সড়কসমূহের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ—বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, কাঁচা বা সংস্কারহীন। এতে করে অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও জরুরি সেবাদানে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রম করলেও আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এই জেলায়। সেই কবে ১৯৮০ সালে ৩৩ একর জমিতে তৎকালীন বস্ত্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মনসুর আলীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্, যা সাতক্ষীরার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। দেশের অন্যতম লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খোলার চেষ্টা করা হলেও মিলটি এখনো বন্ধ আছে। বিগত সরকারের সময় উন্নয়নের অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল কিন্তু শুধু একটি মেডিকেল কলেজ ছাড়া তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি।

খুলনা বিভাগের একটি ব্যস্ততম সড়ক খুলনা থেকে মুন্সিগঞ্জ এবং ভোমরা থেকে খুলনা সড়ক। সাতক্ষীরা-মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত বর্তমান সড়কে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। এই সড়কের পিচ উঠে সড়কে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। এতে সড়কে অহরহ ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এ সড়ক ধরেই সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং রাজধানী ঢাকার সাথে পণ্য আনা-নেওয়া করেন ব্যবসায়ীরা। সাতক্ষীরার সন্তানেরা দেশের গৌরব বয়ে আনলেও এখানে উন্নতমানের স্টেডিয়াম নেই, নেই সুইমিংপুল যেখানে সাঁতার শিখবে। মৎস্য চাষে অবদান রাখলেও নেই কোনো গবেষণা কেন্দ্র ও ভালো ফ্রিজিংপ্লান্ট, অনেক জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সাতক্ষীরা জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

কিছু আশার কথাও আছে, বেশ কিছুদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাতক্ষীরায় সরেজমিন পরিদর্শনে জেলার রাস্তা এবং উন্নয়নের করুণ অবস্থা দেখে যোগাযোগ উপদেষ্টাকে ব্যবস্থা নিতে লিখিত সুপারিশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রস্তাবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের খুলনা জোনের ‘সাতক্ষীরা-সখিপুর-কালীগঞ্জ (জেড-৭৬০২) এবং কালীগঞ্জ-শ্যামনগর-ভেটখালী (জেড-৭৬১৭) মহাসড়ক যথাযথ মানে উন্নীতকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্যাকেজ ডব্লিউপি-০৫ এর আওতায় কালীগঞ্জ-শ্যামনগর-ভেটখালী (জেড-৭৬১৭) সড়কের উন্নয়ন ও কালীগঞ্জ ফুলতলা মোড় থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর চৌরাস্তা পর্যন্ত টেন্ডার কাজের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭৪ টাকা। এছাড়া জেলার উন্নয়নে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পানি সম্পদ উপদেষ্টার তৎপরতায় উপকূলীয় বেড়ি বাঁধ সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

সাতক্ষীরার ক্রীড়াবিদরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তবে আধুনিক স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুলের অভাব রয়েছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাতক্ষীরা সফরে এসে এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন এবং দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।

সাতক্ষীরায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে উদ্বাস্তু হচ্ছে হাজারো মানুষ। উপকূলীয় জেলা হিসেবে সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। ফলে এখানকার মানুষকে সুরক্ষিত করতে স্থায়ী বাঁধ, অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাই সাতক্ষীরা জেলাবাসী প্রত্যাশা করে বৈষম্যহীন উন্নয়নের। দেশের অর্থনীতিতে সাতক্ষীরা জেলার যে অবদান ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে নির্ধারণ হোক উন্নয়ন পরিকল্পনা।

সাতক্ষীরাবাসী আশা করে, ভোমরা বন্দরের উন্নয়ন, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আধুনিক স্টেডিয়াম ও সুইমিংপুল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নদীর ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, হ্যাচারী ও আধুনিক ফ্রিজিং প্ল্যান্টসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যটন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে সাতক্ষীরাসহ দেশের অর্থনীতি। সাতক্ষীরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেছেন, "আমরা নতুন, আধুনিক ও বৈষম্যহীন সাতক্ষীরা গড়ার স্বপ্ন দেখছি" (সূত্র: BVNEWS24)। এটি একটি আশাপ্রদ কথা জেলাবাসীর জন্য, কিন্তু উদ্যোগ, বাস্তবায়ন ও সহযোগিতা জরুরি।

এখনই সময়—সরকারের নীতিনির্ধারকদের এই জেলার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটানো এবং টেকসই উন্নয়ন, বাস্তবসম্মত ও লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। সাতক্ষীরা যেন আর অবহেলিত না থাকে, সেটিই হোক আমাদের সম্মিলিত চাওয়া। আজকের সঠিক বিনিয়োগ—আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং টেকসই সাতক্ষীরা।

লেখক: সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা সমিতি, ঢাকা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাসের সঙ্গে সংঘর্ড়ষে অটোরিকশার তিন যাত্রী নিহত
ঘরে বসে জাতীয় পরিচয়পত্রের অসুন্দর ছবিটি ৩০ মিনিটেই বদলাবেন যেভাবে
কোনো ঝামেলা ছাড়া যেভাবে ফ্রিজ পরিষ্কার করবেন
ব্যাগেজ রুলস সুবিধায় বছরে একবার স্বর্ণ আনা যাবে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা