অগ্নিদগ্ধ শিশুর আর্তনাদে বিবেকহীন জাতির নগ্ন প্রতিচ্ছবি

মোঃ সাইফুল ইসলাম মাসুম
  প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২৫, ০৯:০৫
অ- অ+

আজকের সকালটা শুরু হয়নি কোনো পাখির ডাক কিংবা শিশিরভেজা আলোয়। আজকের সকালটা শুরু হয়েছে আগুনে ঘেরা আকাশ আর আর্তনাদে কাঁপতে থাকা মাটির বুক দিয়ে—একটি বিমান ভূপাতিত হয়েছে। আর ঠিক তার আগের দিন, আমাদের শহরের এক কোনায় পুড়ে যাওয়া শিশুদের বাঁচাতে হাহাকার করছিল একদল অসহায় মানুষ।

ঘটনাস্থলে তখনও পৌঁছায়নি অ্যাম্বুলেন্স। কোলের মধ্যে জ্বলন্ত শরীরের যন্ত্রণায় ছটফট করা শিশু, আর তাকে বাঁচাতে ঘাম ঝরানো কিছু সাধারণ মানুষ—যাদের হাতে না আছে ক্ষমতা, না আছে গাড়ি। তবুও তারা দৌড়াচ্ছে। শুধু দৌড়াচ্ছে, কারণ তারা জানে—সময়ের প্রতিটি ক্ষণে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে একটি প্রাণ।

কিন্তু আশপাশের মানুষ, যাদের পায়ে রিকশা, হাতে সিএনজি, কাঁধে প্রাইভেট কারের চাবি—তারা দাঁড়িয়ে থেকে দর কষাকষি করছে। ৩০ টাকার রিকশাভাড়া হচ্ছে ১৫০, ২৫০ টাকার সিএনজিভাড়া হচ্ছে ১২০০ টাকা। একজন মানুষ কোলে পুড়ে যাওয়া শিশু নিয়ে চিৎকার করছেন, আর সিএনজিওয়ালা বলছেন, “ভাড়া বাড়াইলে যাবো।” একটা প্রাইভেট কার পর্যন্ত থামেনি—সামনে অগ্নিদগ্ধ শিশুর দেহ, তবুও নেমে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মতো ‘মানুষ’ আর পাওয়া যায়নি।

একই সময়ে আমরা দেখলাম বিমান ভূপাতনের ট্র্যাজেডি। আকাশ থেকে আগুনে ঘেরা যন্ত্রপাতি যখন মাটিতে আছড়ে পড়ে, তখনও অনেকেই ছবি তুলছিল, লাইভ দিচ্ছিল, কিন্তু কেউ ছুটে যাচ্ছিল না আহতদের পাশে দাঁড়াতে।

এই কি তবে আমাদের সভ্যতা? এই কি মানুষ হওয়ার সীমানা?

আমরা উন্নয়ন দেখাই ইমারতে, মেট্রো রেলে, ফ্লাইওভারে। কিন্তু সভ্যতার আসল পরিচয় মেলে বিপদের সময়, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়—সেখানে আমরা বরং হাঁপিয়ে উঠি অর্থের অঙ্কে হিসাব মেলাতে। জীবনের দামে ভাড়া বাড়াই, একটা নিঃশেষ জীবনেও খুঁজি লাভ-লোকসানের গাণিতিক পরিমাপ।

আমরা তো এই দেশেরই মানুষ, যারা করোনা মহামারীর সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম তিনগুণ করেছিলাম, একফোঁটা স্যানিটাইজার পেতে মানুষকে জমানো টাকা উজাড় করে দিতে হয়েছিল। ডেঙ্গু আসলেই মশার ওষুধের দাম হয় পাঁচগুণ, বন্যায় চাল-ডালের বাজারে অগ্নি ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, পাহাড়ধস—এসব যেন শুধু আমাদের জন্য দুর্যোগ নয়, একটা আয়ের ‘উৎসব’!

এভাবে কি একটি জাতি দাঁড়াতে পারে? এভাবে কি আমরা দাবি করতে পারি—এই রাষ্ট্র আমাদের? এই শহর আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ?

একটা পোড়া শিশু বাবার কাঁধে কাঁদছে, বলছে—“আব্বু, আমি মরবো না তো?” আর পাশে দাঁড়িয়ে কেউ গুনছে, কত টাকা আদায় করা যাবে এই আগুনে।

বিমান ভূপাতনের ভয়াবহতায় যেমন করে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়, তেমনি পুড়ে যাওয়া শিশুদের মুখেও প্রতিবিম্বিত হয় এক সমাজের আত্মিক ব্যর্থতা। যেখানে প্রাণের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় টাকার অঙ্ক, সেখানে আর যাই থাকুক—সভ্যতা থাকে না।

এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ করা নয়, বরং একটি আয়না ধরে সমাজকে তার নিজের চেহারা দেখানো। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে যদি একটি শিশুর আর্তনাদেও আমাদের হৃদয় কাঁপে না—তবে কি সত্যিই আমরা মানুষ?

হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরগুলোকে নরম করো, শোককে ভিন্নের না ভেবে নিজেদের করে তোলার শিক্ষা দাও, আর রাষ্ট্রকে এমন করে গড়ে তুলো, যেখানে পুড়ে যাওয়া শিশুর কান্নার চেয়ে দামি কিছু আর নেই।

লেখক: ব্যাংকিং ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সচিবালয়ের ঢুকে গাড়ি ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টা, ১২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
সাঁথিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র মাহবুবুল আলম বাচ্চু গ্রেপ্তার
টেকনাফে সরকারি ২ লাখ চারাগাছ কেটে ফেলার অভিযোগ
ইছামতী নদী থেকে শিশুর মরদেহ উদ্ধার ‎
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা