মুজিব ও জিয়া হত্যাকাণ্ড—একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
  প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫৫| আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৫:০০
অ- অ+

১৫ আগস্ট মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কিত ও দেশের জন্য বেদনার দিন। ৭৫’র এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কিছু দুষ্কৃতকারী সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

একই পথ ধরে সেনাবাহিনীর একদল দুষ্কৃতকারী কর্মকর্তা কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩০শে মে দেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হন। তিনি তার রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সংঘটিত একটি সংঘর্ষের মধ্যস্থতা করতে চট্টগ্রামে যান। ওইদিন রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনিসহ আরও কয়েকজন নিহত হন।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ নম্বর ও ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন এবং জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। তাকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে মোশতাক পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী হন। অনেক বিশ্লেষকের মতে মোশতাক মুজিবের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতেন, কারণ মুজিবের মতো জনপ্রিয়তা মোশতাকের ছিল না।

বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির মুখে শুনেছি— “লোকে বলতো, ওঁর মাথায় যতগাছি চুল, ততটা দুষ্ট বুদ্ধি তাঁর মাথার কোষে কোষে ছড়িয়ে আছে।” শত ঈর্ষার ছুরি মুজিবের ওপর বসিয়েছে খুনি দল। তাকে হত্যা করে ঘটনাটি জনগণের কাছে জায়েজ করতে বিভিন্ন গুজব ও অসত্য ঘটনা রটানো হয়।

অন্যদিকে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড জায়েজ করতে কুখ্যাত খুনি দল জিয়ার শাসনামলে সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন বলে অপপ্রচার করে।

গত ৫০ বছর বাকশাল নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। মুজিবকে হত্যার পর বাকশাল বা রক্ষীবাহিনীর অপকর্মকে অজুহাত হিসেবে উল্লেখ করলেও, হত্যাযজ্ঞ-পরবর্তী সরকার ওই বাকশাল বা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করে। যেমন— আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রেক্ষিতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন র‌্যাব সৃষ্টি করে। যদি র‌্যাব বিলুপ্ত হয় তবে আমরা এ বাহিনীর হাজারো বদনাম শুনতে পাবো। কিন্তু এই বাহিনী সৃষ্টির প্রেক্ষাপট এবং সন্ত্রাস দমনে তাদের সফলতা তখন হয়তো আলোচনায় আসবে না। বাংলাদেশে এর নামই রাজনীতি।

আমরা বাংলাদেশিরা মনের মাধুরী মিশিয়ে জাস্টিফাই করতে খুব পারঙ্গম। আমাদের অধিকাংশ জাস্টিফাই ষড়যন্ত্রকারীদের পাল্লা ভারী করে। আমার মনে পড়ে বাল্যকালে গ্রামের ঝোপঝাড়, পুকুর, বনবাদাড়, বিলে-জিলে, ক্ষেত-খামারে, কখনো বা গাছে মাঝেমধ্যে মৃতদেহ ঝুলে থাকার খবর পেতাম। বিশেষ করে ভোরবেলায় শুনতাম— অমুক ব্যক্তিকে গতরাতে জিন বা ভূতে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে, মেরে পুকুরে ফেলে দিয়েছে, মাথা মাটির নিচে এবং পা উপুড় করে রেখেছে। সবই জিন-ভূতে করেছে বলে গল্প শুনতাম। প্রকৃত ঘটনা হলো ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদেরকে হত্যা করা হতো।

এই ধারাবাহিকতা এ যুগেও চলমান। এখন কেউ ধর্ষণের শিকার হলে, ইভটিজিং কিংবা হত্যার শিকার হলেও বলে— মেয়েটার পোশাক-আষাকে সমস্যা ছিল, আরও শালীনভাবে চলাফেরা করলে হয়তো এমনটি হতো না। নারী নির্যাতনের শিকার হলে বলে— মহিলার মুখে দোষ আছে, বেশি কথা বলে, এজন্য মার খায়। অন্যদিকে কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করলে, স্ত্রী প্রতিবাদ করলে বলে— ছি ছি, এ মহিলা নরকের কিট! অর্থাৎ আমাদের যত জাস্টিফাই সবই সবলের পক্ষে এবং দুর্বলের বিপক্ষে। যা প্রকারান্তরে দুর্বৃত্তদের হাত শক্তিশালী করে।

শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও আমাদের জাতীয় চার নেতা হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ার পর ষড়যন্ত্রকারীদের সৃজনকৃত কথার ন্যায় অনেকেই একই সুরে বলা শুরু করল। যা প্রকারান্তরে ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দেওয়ার নামান্তর। এক শ্রেণীর লোকের জাস্টিফাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দেওয়ার সাহসও যুগিয়েছে তাদের। এ যুগে এসেও আমাদের জাস্টিফাইটা সন্ত্রাসী গুলি করে কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করলেও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তির ভাষায় ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’ পর্যায়ে রয়ে গেছে।

পৃথিবীর প্রতিটি জাতির একজন হিরো থাকে। তবে বাংলাদেশের হিরো কে? প্রশ্ন আসতে পারে, এটা বোঝার উপায় কি? এ বিষয়টি বুঝতে উচ্চতর গণিত জানা প্রয়োজন হবে না। যাদের (পাকিস্তানিদের) বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি, তৎকালীন আমাদের দেশের সংগঠকদের মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল?

আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের একাধিক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং শীর্ষ রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে বিষোদগার করতে শুনেছি— শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেছে। অর্থাৎ শত্রুর শত্রু মানে আমাদের বন্ধু। কয়েক মাস আগে এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন— পাকিস্তানের জাতির জনক জিন্না, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, তুরস্কের জাতির জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, আর বাংলাদেশের জাতির জনক ইব্রাহিম (আ)। বঙ্গবন্ধু হলে নাউজুবিল্লাহ! দেশে কিছু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত ক্ষিপ্ত কেন? আমরা সকলকে সম্মান করব, কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার মতো নির্বোধ হবো না।

শেখ মুজিব সরকার গঠন করার পর তার কিছু ভুল ভ্রান্তি ছিল। কিন্তু ৭১ সাল বা তার আগে-পরে তার অবদান বর্তমান সময়ে এসে রিসেট বা ডিলিট হতে পারে না।

ধর্মের দৃষ্টিতে মানব হত্যার শাস্তি

মানবহত্যা কতটা ভয়াবহ অপরাধ ও মহাপাপ সে বিষয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন— কেউ যদি হত্যা অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করে, তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। (সূরা মায়েদা ৫:৩২)

আখেরাতে সর্বপ্রথম বিচার হবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন— “কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকাদ্দমার ফয়সালা হবে, তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৮)।

হিন্দু ধর্মে হত্যা থেকে বিরত থাকা সর্বোচ্চ এবং অপরিহার্য গুণাবলীর মধ্যে একটি, যা বেদ থেকে এসেছে। হিন্দু ধর্ম শিক্ষা দেয়— সমস্ত জীবের মধ্যে একটি ঐশ্বরিক আধ্যাত্মিক শক্তির স্ফুলিঙ্গ রয়েছে; তাই অন্য সত্তাকে আঘাত করা মানে নিজেকে আঘাত করা। যে কোনো সহিংসতার কর্মফল রয়েছে এবং আক্রমণকারীর উপর সহিংসতা ফিরিয়ে আনবে। বেদ সাধারণত সকল প্রাণীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নিষিদ্ধ করে এবং বলে যে, অহিংসার নিখুঁত অনুশীলনকারী পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পাবে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য যে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাদের মৃত্যুর পর নরকে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। গৌড় পুরাণ অনুসারে নিরপরাধ ব্যক্তির হত্যাকারীকে মৃত্যুর পর কড়াইতে গরম তেলের মধ্যে ফেলে ভাজা হয়।

বৌদ্ধ ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ বলে গণ্য।

ক্যাথলিক ধর্মে হত্যা এই আদেশটি মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা দাবি করে এবং অনুবাদ করা হয়েছে— “তুমি খুন করো না।” এই আদেশ সম্পর্কে রোমান ক্যাটেকিজম বলে— আমাদের প্রভু নিজেই এর দুটি বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করেছেন; একটি হত্যা করতে নিষেধ করা, অন্যটি আমাদের শত্রুদের প্রতি দান, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের অনুভূতি লালন করা। সকল মানুষের সাথে শান্তিতে থাকতে ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে নির্দেশ দেওয়া।

এই দেশ যতদিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমান তাদের মহান কীর্তির জন্য ততদিন বেঁচে থাকবেন। বাংলার মানচিত্রের সঙ্গে তারা মিশে আছেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ঢাকাটাইমস সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ঢাকাটাইমস কর্তৃপক্ষের নয়।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিদেশের মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর সাথে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই: রিজওয়ানা
অবৈধ অভিবাসন নিয়ে কঠোর বার্তা মা‌র্কিন দূতাবাসের
যাত্রাবাড়ীতে মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি জান শরীফ গ্রেপ্তার
জিয়াউর রহমান: এক দূরদর্শী নেতা ও দেশ গঠনের রূপকার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা