সৌদি আরবে নিষিদ্ধ! লোটাস কামালের পার্টনার বিতর্কিত ডা. আরিফ কোন যাদু মন্ত্রবলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ২০:০০| আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ২১:৩৯
অ- অ+

ব্যাংকিং খাতে তোলপাড়! কে এই ব্যক্তি, যার হাতে তুলে দেওয়া হলো গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত? একদিকে সাবেক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, অন্যদিকে ভিসা কেনা-বেচার কেলেঙ্কারির অভিযোগে সৌদি আরবে নিষিদ্ধ। এমনই এক বিতর্কিত ব্যক্তি ডাক্তার আরিফুর রহমানকে করা হলো বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান। কীভাবে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির হাতে গেল একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের দায়িত্ব?

গত ১৯ আগস্ট বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন ডা. এইচবিএম ইকবাল। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে কর্মীদের মারধর, অর্থ আত্মসাৎ এবং স্বজনপ্রীতির মতো গুরুতর সব অভিযোগ। ডা. ইকবাল ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্য।

পুরনো চেয়ারম্যানকে সরিয়ে নতুন যাকে আনা হয়েছে, তিনি ডা. আরিফুর রহমান। সদ্য পদচ্যুত চেয়ারম্যান ডা. ইকবালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বহু পুরনো ব্যবসায়িক পার্টনার। জনশক্তি রপ্তানির জগতে তার পরিচয়, তিনি সৌদি আরবে ভিসা ট্রেডিং-এর জনক। গত শতাব্দীর আশির দশকে শুধু বিমান ভাড়া ও টুকিটাকি সামান্য খরচ দিয়ে চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে যেতেন বাংলাদেশের কর্মীরা। এতে একেকজন কর্মীর খরচ পড়তো ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এমনকি চাকরিপ্রাপ্ত কর্মীদের বিমান ভাড়াও দিতো কোন কোন নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

নব্বই দশকের শুরুরে দিকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন বাংলাদেশের নাগরিক ডাক্তার আরিফুর রহমান। প্রত্যেক কর্মী নিয়োগের অনুমতিপত্র টাকার বিনিময়ে কিনে নেন ডাক্তার আরিফ। কর্মী নিয়োগের এই অনুমতিপত্রই মূলত সৌদি আরবের ভিসা। এই ভিসা কিনে ডা. আরিফ সেগুলো বাংলাদেশে বিক্রি করেন তার ঘনিষ্ঠ আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামালের কাছে। পরে এই জাল ছড়িয়ে পড়ে সৌদি আরবের প্রায় সকল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মাঝে। ভিসা কেনা-বেচার এই চক্রে পড়ে সৌদি আরব যেতে একেক জন কর্মীর খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

একজন বিদেশি নাগরিক কেন ব্যাংক চেয়ারম্যান?

বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক ডা. আরিফ এই ভিসা কেনাবেচার চক্র চালাতে প্রায়ই থাকতেন সৌদি আরবে। কয়েক বছর আগে সৌদি সরকারের কানে যায় এই চক্রের কথা। এনিয়ে তদন্ত শুরু করে সৌদি আরবের দুর্নীতি দমন সংস্থা ‘নাজহা’। একথা জানতে পেরে সৌদি আরব ত্যাগ করেন ডা. আরিফ।

২০২২ সালে বাংলাদেশের চারজন জনশক্তি রপ্তানিকারকের বাড়িতে অভিযান চালায় নাজহা। চারজনের মধ্যে আশরাফ নামে একজনের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশি ৭৫ কোটি টাকার সমান ২৪ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল। আশরাফ স্বীকার করেন, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আসলে ডা. আরিফুর রহমানের, যা তিনি ভিসা ট্রেডিংয়ের জন্য রেখেছিলেন। এই ঘটনায় সৌদি আদালত আশরাফসহ চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। একইসঙ্গে, আরিফুর রহমানকে সৌদি আরবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আশরাফ এখনও সৌদি আরবের কারাগারে বন্দী।

সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, ডা. আরিফের সাথে সাবেক পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ। তাদের মধ্যে নিয়মিত মোবাইলে কথা হতো। এর একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা ভিসা ট্রেডিংয়ের তদন্ত শুরু করে। তদন্তে আরিফুর রহমানের নাম আসার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে তলব করা হয়। কিন্তু ঠিক তার পরের দিনই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ফোন করে ধমক দেওয়া হয়। স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, "কেন আরিফুর রহমানকে ডাকা হয়েছে? এটা বন্ধ করুন।" এই একটি ফোন কলেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে তার প্রভাব কতটা শক্তিশালী ছিল। সে সময় এমনও গুঞ্জন উঠেছিল যে, তদন্ত প্রতিবেদন থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার জন্য বারিধারায় বসবাসকারী একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী তদন্ত সংশ্লিষ্টদের এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন।

এদিকে লোটাস কামাল মন্ত্রী থাকাকালে অসংখ্য বার তার সঙ্গে বিদেশে সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ডাক্তার আরিফ।

সেই ডা. আরিফুর রহমান এখন প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান। কিন্তু কীভাবে ঘটল এই উত্থান? সূত্র বলছে, সাবেক মন্ত্রী লোটাস কামাল, প্রিমিয়ার ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এইচবিএম ইকবাল এবং বর্তমান চেয়ারম্যান আরিফুর রহমানের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। যখন এইচবিএম ইকবাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন, তখন শুরুর দিকের পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই আরিফুর রহমান।

ব্যাংকিং সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ব্যাংকের দায়িত্ব দেওয়ার ফলে আমানতকারী এবং শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়বে। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা কি সুরক্ষিত থাকবে? নাকি প্রিমিয়ার ব্যাংকও পরিণত হবে দুর্নীতির এক নতুন আখড়ায়?

সময়ই বলে দেবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয়। বিতর্কিত এক ব্যক্তিকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নিয়োগের এই ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সুশাসন এবং স্বচ্ছতাকে আরও একবার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
৫০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন সাকিব
‘আমার স্ত্রী ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট’, গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে যে ভয়ের কথা বললেন তৌহিদ আফ্রিদি
হবিগঞ্জে অনুমতি ছাড়া দাঁড়ি রাখায় তিন কনস্টেবলকে শাস্তি
ট্রাক চালকের আসনের নিচে লুকানো ছিল ১৮ হাজার পিস ইয়াবা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা