রাজউক চক্রের সহায়তায় প্রতারণা করে কোটিপতি পারভেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩:২৮ | প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৫১

এক যুগ আগেও তিনি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতেন রাজধানীর তেজগাঁও থানা এলাকার একটি বাড়িতে। এরপর নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে প্রতারণা আর জালিয়াতিতে নামেন তিনি। এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। প্রতারকের নাম পারভেজ আহম্মেদ জাহান।

গুলশানে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি টাকার জমি আছে তার নামে। করোনা মহামারিতে অর্ধ কোটি টাকা সহায়তাও দেন তিনি। নিখুঁতভাবে জাল কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে একের পর এক প্রতারণা করে পার পেয়ে যান। কৌশলি এই ঠকবাজ একজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করলে সেই মামলার তদন্তে ফেঁসে যান নিজেই। বেরিয়ে আসে তার কোটিপতি হওয়ার রহস্য। মামলায় আসামি হন নিজেই। এ মামলায় জামিন নিয়ে গা-ঢাকা দেন তিনি। এখনও আত্মগোপনে। পুলিশ তার অবস্থান সম্পর্ক কিছুই জানাতে পারছে না।

পারভেজ আহম্মেদ জাহানের হঠাৎ বদলে যাওয়ার পেছনে কোনো জাদু নেই, আছে নিখুঁত জালিয়াতি, প্রতারণা। এত সূক্ষ্মভাবে বিভিন্ন কাগজপত্র ও সই-স্বাক্ষর জাল করা হয়, যা ধরা দুঃসাধ্য। ওই জাল কাগজের মাধ্যমে চোখে ধুলা দিয়ে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরকে বোকা বানিয়েছেন তিনি। এমনকি উচ্চ আদালত থেকেও রায় পেয়েছেন| গুলশানের সাড়ে চারশ কোটি টাকা মূল্যের জমির মালিকানাও অর্জন করেন তিনি। একটি সূত্র জানায়, রাজউকের অসাধু একটি চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে প্রতারণার মাধ্যমে বড় লোক হয়ে যান পারভেজ।

তেজগাঁও থানা সূত্রে জানা গেছে, দারোয়ানের চাকরিকালীন নিজেকে খান বাহাদুর ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে চাকরিস্থল বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নামেন গুলশানের ওই প্লট দখলের মিশনে। ওয়ারিশসূত্রে ওই প্লটের মালিকানা তার রয়েছে, তা প্রমাণ করতে নিখুঁতভাবে জাল কাগজপত্র তৈরি করেন। জমা দেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অফিসে। সেখান থেকে ওয়ারিশ হিসেবে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জমির মালিক হিসেবে আসল কাগজ পান। এরপর বিভিন্ন লোকের কাছে জমি বিক্রির নাম করে বায়না বাবদ টাকা গ্রহণ করতে থাকেন। প্লটের প্রকৃত মালিক টের পেয়ে মামলা করেন। কিন্তু প্রতারক পারভেজের তৈরি করা সাজানো কাগজপত্র এত নিখুঁত ছিল যে, উচ্চ আদালত থেকেও জমির মালিকানা তার বলে রায় পেয়ে যান। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। ওই জমির লোভ দেখিয়ে প্রতিনিয়ত ঠকাতে থাকেন মানুষকে।

তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান জানান, এ পর্যন্ত তার প্রতারণার শিকার ১৫-২০ জন থানায় অভিযোগ করেছেন। জামিনে বের হয়ে তিনি প্রতি মাসে একবার থানায় হাজিরা দিতেন। তবে কয়েক মাস নিয়মিত হাজিরা দিয়ে একপর্যায়ে গা-ঢাকা দেন।

পুুলিশ জানায়, গুলশানের ওই জমির প্রকৃত মালিক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উল্লেখ করে গুলশানের প্লটের জাল দলিল তৈরি করে আম-মোক্তারনামার মাধ্যমে মালিক ইফতেখার নামে একজন। এরপর সেই জমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করেন পারভেজ। এক পর্যায়ে নিজেও প্রতারিত হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করতে আসেন তিনি। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। মামলার বাদী থেকে হয়ে যান প্রধান আসামি। গত বছরের মাঝামাঝিতে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এই মামলা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পারভেজ একজন উচ্চমানের প্রতারক এবং ঠকবাজ।

সূত্র জানায়, পারভেজ পূর্ব তেজতুরী বাজারের ১৮১ নম্বর বাড়িতে ১৩-১৪ বছর আগে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ নেন। বাড়ির নিচ তলার সিকিউরিটি গার্ডের (নিরাপত্তাকর্মী) একটি ছোট কক্ষে থাকতেন।

পুলিশ জানায়, প্রকৃত এনআইডি মতে ০৫/১১/১৯৫৫ইং জন্মতারিখ পরিবর্তন করে প্রতারক পারভেজ তার কর্মস্থলের ঠিকানায় নিজের জন্মস্থান হিসেবে দেখিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি করেন। জন্মনিবন্ধনের সূত্র ধরে গত-৩০/১১/১৪ ইং তারিখে এনআইডি তৈরি করেন। যার এনআইডি নম্বর-৩৭১৩৮৯৩৭৯৪।

পরে এই আইডি ব্যবহার করে গুলশান-২ এর প্লট নম্বর- এন.ডব্লিউ (জে) ০৫, রোড নম্বর-৫১, এর ৪৪ (চুয়াল্লিশ) শতাংশ জমি নিজের বলে দাবি করেন। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪শ ৪০ কোটি টাকা। প্রতারক পারভেজ প্রকৃত মালিক ইফতেখার আহম্মেদ খানকে নিজের আপন ভাই বলে পরিচয় দেন। রাজউকে এক ব্যক্তিকে নকল ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে নিজের ছবি স্ট্যাম্প করেন। প্রকৃত জমির মালিকের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ভোটার আইডি কার্ড, জমির দলিল, বাবা-মায়ের নাম ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে প্রকৃত মালিক দাবি করেন। এ ঘটনায় জমির মূল মালিক আদালতে মামলা করলে তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়রানি করেন। প্রতারক পারভেজ আদালতে নিজের জমি দাবি করে মামলা করলে উচ্চ আদালত তার নামে রায় দেয়। এ সময় তিনি তার নানার সঙ্গে বৃটেনের রানী, লর্ড ক্লাইভসহ অনেকের ছবি এডিট করে সবাইকে প্রদর্শন করতেন। এবং তিনি দাবি করেন যে, উক্ত প্লটটি রাজধানীর ওয়ারীর ৭ ওয়ারী স্ট্রিটে বসবাসরত তার নানি বিলকিস বেগম, স্বামী-মৃত খানবাহাদুর নুরুল হকের। নানি বিলকিস বেগমের একমাত্র সন্তান এবং প্রতারক পারভেজের মা তাহমিনা বেগম। বাবা মৃত ডা. মমতাজুল হক খান। ঠিকানা-৭ ওয়ারী স্ট্রিট, ওয়ারী-ঢাকা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘পারভেজ গুলশানের প্লট নম্বর এন.ডব্লিউ (জে) ০৫ এর মূল মালিক বিলকিছ বেগমের মেয়ে তাহমিনা বেগমের সন্তান আহম্মেদ এর আপন ভাই পরিচয়ে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানান। জমির মালিকানা ইফতেখার আহম্মেদের হওয়ায় জাল কাগজে ইফতেখার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী উল্লেখ করেন। এরপর ওই কথিত ভাই, জমির প্রকৃত মালিক ইফতেখার আহম্মেদ খান গুলশানের প্লটটি প্রতারক পারভেজকে দানসূত্রে আমমোক্তার নামার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন বলে জাল কাগজ তৈরি করা হয়। গুলশানের প্লটের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বানানো হয়।

ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে রাজউকসহ ভূমি অফিসের সকল স্থানে তার দাবির স্বপক্ষে নিজের ছবিসহ কিছু ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দাখিল করেন প্রতারক পারভেজ। এসব ভুয়া কাগজ ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে প্লটটি বিক্রির জন্য প্রাথমিকভাবে জমি বায়না করেন। পরবর্তীতে গা-ঢাকা দেন। পারভেজ ওরফে ইফতেখার আহম্মেদ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে এই সম্পত্তি নিজের দাবি করে রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজপত্র, আসল কাগজ বলে দেখায়। পরবর্তীতে জমি আত্মসাতের পাঁয়তারা করে। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ১০ আগস্ট তেজগাঁও থানায় প্রতারক পারভেজ একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩০। ধারা- ৪২০/৪০৬/৩৪ পেনাল কোড।

এ মামলায় তিনি গুলশানের প্লটটির মালিক নিজে উল্লেখ করে এজাহারটি দায়ের করেন। এর আগে জমির মালিকানা দাবি করে জমিটি বিক্রির জন্য বায়না বাবদ সৈয়দ গোলাম হাসান কবির নামে এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ ১০ জন ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়। প্রতারণার কৌশল হিসেবে জমি ক্রয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অগ্রিম জমির বায়না হিসেবে নিতেন। এরপর বায়নার মেয়াদ শেষ হলে জমি তাদেরকে বুঝিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা করতেন। প্রতারণার টাকায় করোনাকালীন সময়ে প্রতারক পারভেজ প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। আসামি পারভেজ একটি জাল জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা। অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১৫ জন সহযোগীর সহযোগিতায় ২০১৪ সালের ৬ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জোন-৫ এর কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে এসব কাগজপত্রকে আসল বলে দাবি করে প্রতারণা করে আসছিল।

এ ঘটনায় পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. শাহ আলম পারভেজসহ অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১৫ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। এর আগে নিজ নাম-পরিচয় গোপন রেখে ইফতেখার আহম্মেদ খান পরিচয়ে তেজগাঁও থানার প্রতারক পারভেজ একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-৩০ (৮) ২০২১। এই প্রতারণার ঘটনায় হাজী মো. ছানাউল্লাহ খান, মো. আব্দুল মান্নান সরকার, আসামির ছোট ভাই দিদার আহম্মেদ জাহান, ছোট বোন সামসা জাহান, মাহমুদা জাহান তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন। বলেছেন, তাদের ভাই প্রতারক। চাঞ্চল্যকর প্রতারণার এই মামলাটির তদন্ত রহস্য উদঘাটনের জন্য তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুরস্কৃত হন।

(ঢাকাটাইমস/২১জানুয়ারি/আরআর/এমএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অপরাধ ও দুর্নীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অপরাধ ও দুর্নীতি এর সর্বশেষ

পুলিশের সোর্স হত্যা: পলাতক দুই আসামি গ্রেপ্তার

ডিজিটাল হুন্ডিতে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, চক্রের ৫ সদস্য গ্রেপ্তার

ইউটিউবে জাল টাকা তৈরি শেখা, রাজমিস্ত্রি-জেলেকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় চক্র

দুর্নীতি মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে

ভুয়া নিয়োগপত্রে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ

শিশু বিক্রির অর্ডার নিয়ে অপহরণ করতেন তারা

দুর্নীতির অভিযোগে রুয়েটের সাবেক ভিসি ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা ​​​​

যাবজ্জীবন সাজা থেকে বাঁচতে ২২ বছর ধরে তরমুজ ও ওষুধ বিক্রেতা, অতঃপর...

বিমানবন্দরে ডলার কারসাজি, ১৯ ব্যাংকারসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ঢাবি ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছিনতাইয়ের অভিযোগ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :