রাজনীতির ঘেরাটোপে রাজাকারের তালিকা

স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও দেশে রাজাকারের তালিকা হয়নি। বারবার তারিখ ঘোষণা করেও তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি সরকার। এর পেছনে রাজনীতির মারপ্যাচ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে কোনো গবেষক বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়নি। আমলাদের দিয়ে করানো হচ্ছে এই তালিকা। তাই, রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় রাজাকারদের তালিকা তৈরিতে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
যদিও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে ২০২১ সালে বলেছিলেন ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে। চলতি বছরও তিনি বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যে তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু শুক্রবার ঢাকা টাইমস থেকে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রী তালিকা প্রকাশের সাম্ভব্য তারিখ বলতে পারেননি।
২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’তালিকা প্রকাশ করেন। ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য তালিকাটি স্থগিত করা হয়। যা আর প্রকাশ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
গত বছরের আগস্ট মাসে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করেছে সরকার। এতে রাজাকারের তালিকা তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয় জামুকাকে। এরপরও জামুকা তাকিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দিকে। আবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বে একটি উপকমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তবে জানা গেছে, এই উপকমিটিও নানা কারণে তাদের কাজ তেমন একটা এগিয়ে নিতে পারেনি।
ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা কখনও হবে না। আগেও হয়নি, এখনও হবে না। কারণ এখন সমন্বয়ের রাজনীতি চলছে। এই সমন্বয়ের রাজনীতিতে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা সব মিলেমিশে থাকে। সুতরাং এটা হবে না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই ধরণের কাজে তারা কখনও গবেষক রাখেনি। কারণ আজ-কালকার রাজনীতিকরা সব কিছু বোঝে! তারা যেহেতু সবকিছু বোঝেন, তাই অন্য কোনো লোক দরকার নেই।’
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তালিকা হচ্ছে না মন্তব্য করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সরকার রাজাকারদের তালিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাত্র তিন বছর আগে। এরপর সরকার যে তালিকা প্রকাশ করলো তাতে মুক্তিযোদ্ধার নাম সেখানে ঢুকে গেছে। এই তালিকা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে করাতে হবে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো তালিকা প্রণয়ন কমিটিতে কোনো গবেষক বা বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমলাদের দিয়ে কখনও এ ধরনের তালিকা করা যাবে না। এসব নিয়ে তো মুক্তিযোদ্ধা গবেষকরা লিখেছে। আমলারা জানবে কিভাবে যে কারা রাজাকার! তাদের তো জন্মও হয়নি যুদ্ধের সময়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তালিকা হচ্ছে না। যারা এই কমিটিতে আছেন, তাদের এ বিষয় কোনো ধারণাই নেই।’
রাজাকারদের তালিকা না হওয়া পেছনের কারণ চানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক শাজাহান খানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমরা কমিটি করে দিয়েছি, উনারা দেখছেন।
আইন পাস করে রাজাকারদের তালিকা করার কর্তৃত্ব সরকার জামুকাকে দিয়ে দিয়েছে, তারপরও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বে করা উপকমিটির কাছ থেকে তালিকা আশার করছেন কেন- প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব দিতে হবে। জামুকার পক্ষ থেকে শাজাহান খানকে আহবায়ক করে দেওয়া হয়েছে।’
রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের সাম্ভব্য কোনো তারিখ আছে কিনা চানতে চাইলে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এটা অগ্রিম বলতে পারব না। এর আগে দেওয়া কথা ঠিক রাখতে পারি নাই।’
রাজাকারদের তালিকা তৈরির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাজাহান খান বলেন, এখন পর্যন্ত ১৫০ এর কম বেশি থানা উপজেলা রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে নানা প্রোগ্রাম, নির্বাচনসহ ইত্যাদি কারণে এগুতে পারি নাই।
রাজাকার বাছাই কমিটিতে কোনো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশেষজ্ঞ নেই, এক্ষেত্রে কাজের প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে শাজাহান খান বলেন, তখনকার জামুকার মিটিংয়ে এই বিষয়টা ওইভাবে আসে নাই। গবেষকরা যে বইগুলো লিখেছেন, সেখানেও আমরা দেখেছি সবকিছু আসেনি। তাই তাদের যুক্ত করি নাই। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে শেষ হোক এরপর আমার ব্যক্তিগতভাবে ইচ্ছে আছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করার।
১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকেও কেনো রাজাকার তালিকা করতে পারেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শুধু মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকার তালিকা না, যেকোনো কাজের ব্যাপারে আগ্রহী কিছু লোক লাগে। যারা এগুলো করবে। যেমন- আমি যখন নৌপরিবহন মন্ত্রী ছিলাম, তখন মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা চলচ্চিত্র অপারেশন জ্যাকপট, পাকিস্তানি জাহাজ সংরক্ষণের প্রকল্প নিয়েছিলাম। এই কাজগুলো আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন অনেকদূর গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি চলে আসার পরে একজন সেক্রেটারি ছিল। সে এই কাজগুলো বন্ধ করে দেয়।’
শাজাহান খান বলেন, ‘সরকারের মধ্যে আগ্রহী লোক থাকতে হবে, যারা এসব নিয়ে কাজ করবে। যেমন জামুকা। জামুকা সৃষ্টি হয়েছে ২০০২ সালে। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন জামুকা আইনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নামও ছিল না। রাজাকারদের তালিকা করারও বিধান ছিল না। তখন আইনে ছিল- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমন্বিত রাখতে হবে।
আমি যখন জামুকার সদস্য তখন একদিন আলোচনায় বললাম, চেতনাকে সমন্বিত রাখার কথা তো বলা আছে- এখন আমরা কী করছি। তখন আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে পরিকল্পনা চাওয়া হল। এরপর আমি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে দেই।
(ঢাকাটাইমস/১৬ডিসেম্বর/টিএ/জেডএম)

মন্তব্য করুন