ছুটি কাটাতে এসে ভারতে বিয়ে করেন আরব শেখরা

ভারতের হায়দ্রাবাদে কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে করতে আসা আরব শেখদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছিল মাস খানেক আগে। মূলত অল্প কিছুদিনের জন্য ভারতে এসে তারা স্থানীয় একটি চক্রের সহায়তায় জাল কাগজপত্র তৈরি করে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে করে। খবর বিবিসির।
এ ধরনের একজন আরব শেখ বিয়ে করেছিল ফরহীনকে, যে পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিল আর স্বপ্ন ছিল নার্স হওয়ার। এক সকালে হঠাৎই ওর জীবনটা বদলে গেল যখন ওর বাবা একটা ঘরে তিনজন অচেনা লোকের সামনে ওকে হাজির করালেন। ওকে শুধু বলা হলো, ওই তিনজনের মধ্যে একজনের সঙ্গেই সেদিন বিকালেই ওর বিয়ে হবে।
ফরহীনের বয়স তখন ১৩। আর জর্ডনের অধিবাসী যে শেখের সঙ্গে সেই বিকালে ওর বিয়ে হলো, তার বয়স ৫৫।
‘আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। বাবা মায়ের পায়ে পড়ছিলাম বারবার। বলছিলাম যে আমি পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি’- ফরহীন বলছিলেন বিবিসিকে।
ওর মা-ই ওকে কনের সাজে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন বিয়ের বদলে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে ওই শেখ। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেবে সে। একজন কাজি ওদের নিকাহ পড়িয়েছিলেন।
‘ওই লোকটাকে প্রথমে দেখেই মনে হয়েছিল আমার থেকে ৪০ বছরেরও বেশি বড় হবে নিশ্চয়ই। প্রথম রাতে আমি কান্নাকাটি করছিলাম, কিন্তু ওই লোকটা জবরদস্তি করেছিল আমার ওপরে’- বলছিলেন ফরহীন।
‘তারপরের তিন সপ্তাহ প্রতিদিন-প্রতিরাত সে আমাকে ধর্ষণ করেছে।’
তার বউ-বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য ফরহীনকে সঙ্গে করে জর্ডনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ওই শেখ। তার আগে ফরহীনের জানা ছিল না যে ওই লোকটা বিবাহিত।
ফরহীনের বাবা-মায়ের সঙ্গে ওই শেখ একটা সমঝোতায় এল - সে জর্ডন ফিরে যাবে, পরে ভিসা পাঠালে ফরহীন যাবে সে দেশে। সেই ভিসা আর কখনও আসেনি। ফরহীন নিয়ম মতো এখনও বিবাহিত, কিন্তু তিনি জানেন না যে তার স্বামী কোথায়।
‘ওই ঘটনার প্রায় এক বছর পর অবধি আমি চুপচাপ ছিলাম। একটুও কাঁদিনি। একেক সময়ে মনে হত মরে যাই। নিজের পরিবার - বাবা, মা - আমাকে ধোঁকা দিল?’- বলছিলেন ফরহীন।
ওই ঘটনার পরে আট বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনও ফরহীন সেই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দপ্তরে, সেখানেই একজন শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
ফরহীন বলছিলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ ঠাট্টা করে যে এক খারাপ লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল বলে। কেউ আবার বলে যে আমি নাকি স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি বলে সে ছেড়ে চলে গেছে।’
ফরহীনের ঘটনার মতো আরও ৪৮টা অভিযোগ গত তিন বছরে তেলেঙ্গানা পুলিশের কাছে জমা পড়েছে। যে কাজি ফরহীনের বিয়ে দিয়েছিল, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হায়দ্রাবাদ শহরের দক্ষিণ জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ভি সত্যনারায়ন বলছিলেন, ‘সাধারণভাবে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ জানাতে এগিয়ে আসে না। আর এলেও অনেক সময়ে দেখা যায় অভিযুক্ত শেখ আগেই ভারত ছেড়ে পালিয়েছে। এটা আমাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি, কিন্তু ওই শেখদের ভারতে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করাটা খুব কঠিন।’
জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এটা বেশ জটিল একটা অপরাধী নেটওয়ার্ক। অনেক দালাল থাকে এর মধ্যে - যারা বিয়ের ভুয়া প্রমাণপত্র তৈরি করে দেয়।
সেপ্টেম্বর মাসে আটজন শেখকে তেলেঙ্গানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এদের মধ্যে দুজনের বয়স ছিল ৮০। বাকিদের ৩৫-এর আশেপাশে। এই আটজন যাদের বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিল, তাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর।
১২ বছরের তাবাসসুমের বিয়ে দেয়া হয়েছিল ৭০ বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে। একটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে যৌন অত্যাচার করার পরে তাকে তার 'স্বামী' ভিসা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তাবাসসুম বছর খানেক পরে এক সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু সেই সন্তানকে বড় করা হয়েছে তাবাসসুমের বোন হিসেবে।
তিনি বলছিলেন, ‘আমার মেয়ে যখন আমাকে দিদি বলে ডাকে, প্রত্যেকবার আমার বুকটা মুচড়ে ওঠে। আমি তো মা ডাকটা শুনতে চাই।’
অধিকাংশ শেখ ওমান, কাতার, সৌদি আরব বা ইয়েমেন থেকে আসে। কোনও কোনও বিয়েতে আবার পাত্র তো ভারতে আসেও না। ফোনেই বিয়ে হয়ে যায়। যেমনটা হয়েছিল জোহরা-র।
বছর ১৫-র জোহরা অনাথ। তার দাদির সঙ্গে থাকত সে। জোহরার একটা ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল তারই মামি।
‘বাড়িতে কাজি এসেছিল এক রাত্রে। ফোনের মাধ্যমেই নিকাহ পড়িয়ে দিল। আমি জানতামও না কার সঙ্গে আমার বিয়ে হলো’- বলছিলেন জোহরা। কিছুদিন পরে ভিসা পেয়ে জোহরা ইয়েমেন যায়। এক ৬৫ বছরের লোক নিজেকে জোহরার স্বামী বলে পরিচয় দেয়। তাকে একটা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে অত্যাচার করার পরে তাকে হায়দ্রাবাদে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ফরহীন বা জোহরার মতো মেয়েদের ব্যবহার করে তারপরে ছেড়ে দেয় ওই আরব শেখরা।
'শাহিন' নামের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান জামিলা নিশাত। তিনি এ রকম নারীদেরই সাহায্য করে থাকেন।
জামিলার কথায়, ‘আমি যে মুসলিম এলাকায় কাজ করি, সেখানে এক তৃতীয়াংশ পরিবারই অর্থের লোভে নিজেদের মেয়েদের এইভাবে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। খুবই গরিব পরিবার এগুলো। বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থাও করতে পারে না এরা। স্কুল থেকে যে সরকারি মিড-ডে মিল দেয়া হয়, শুধু সেই খাবার খেয়েই বড় হয় শিশুরা।’
কেউ অবশ্য স্বীকার করে না যে তারা অর্থের জন্য এভাবে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, বরং তারা বলার চেষ্টা করে যে একটা সামাজিক নিয়ম পালন করছে এর মাধ্যমে।
এ রকমও ঘটনা আছে, যেখানে একই পুরুষের সঙ্গে দুটি মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে।
রুবিয়া আর সুলতানা দুজনেই ছিল ছোটবেলার বন্ধু। তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়েছিল - শেখের সঙ্গে। পরে তারা বুঝতে পারে যে তাদের দুজনেরই স্বামী একই ব্যক্তি - ওমানের বাসিন্দা এক ৭৮ বছরের শেখ।
কাঁদতে কাঁদতে রুবিয়া বলছিল যে বিয়ের সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।
‘ওই লোকটা আমাকে আর আমার বন্ধুকে ছেড়ে চলে যায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ তার কোনও খোঁজ পাইনি আমরা। সুলতানা শেষ অবধি আত্মহত্যা করে’- বলছিলেন রুবিয়া।
ইসলামিক পণ্ডিত মুফতি হাফিজ আবরার এই ধরনের বিয়েকে বেশ্যাবৃত্তি বলে মনে করেন।
‘যে কাজি অর্থের বিনিময়ে এইভাবে অন্য দেশের পুরুষদের সঙ্গে এখানকার মেয়েদের বিয়ে দেয়, তারা ইসলাম ধর্মের আর মুসলমানদের নাম খারাপ করছে’- বলেও অভিমত হাফিজের।
কিন্তু তেলেঙ্গানার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক ইমতিয়াজ আলি খান মনে করেন এই ধরনের বিয়ে আটকাতে মসজিদগুলোর সহায়তা প্রয়োজন।
‘আমরা মসজিদগুলোকে বলতে শুরু করেছি যে এইরকম অনৈতিক বিয়ের ব্যাপারে নামাজিদের যেন তারা সতর্ক করতে শুরু করে’- বলছিলেন খান।
ফরহীন, তাবাসসুম, জোহরা, রুবিয়া আর সুলতানাদের মতো যুবতীরা অবশ্য এখনও আশা করে যে তাদের যে অবস্থায় পড়তে হয়েছে, সেই অবস্থায় অন্য শিশু বা নারীদের হয়তো আর পড়তে হবে না কিছুদিন পরে।
ফরহীন স্বপ্ন দেখেন সেই দিনের, যেদিন নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে সমাজ সচেতন হবে, তারা যে শুধুই যৌন লিপ্সা মেটানোর বস্তু নয়, সেটা বুঝতে শিখবে সবাই।
‘আমার পরিবার এখন আমার কাছে ক্ষমা চায় তাদের কৃতকর্মের জন্য। তারা বুঝতে পেরেছে তাদের ভুল। এভাবেই যদি বাকিরাও বুঝতে পারে যে অর্থের লোভে নিজের মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে বরং তাদের পড়াশোনা করানো দরকার’- বলছিলেন ফরহীন।
(ঢাকাটাইমস/৩১অক্টোবর/এসআই)

মন্তব্য করুন