অর্থনীতির সুফল ঘরে তুলছেন সুনামগঞ্জের কৃষক ও জেলেরা

জাহাঙ্গীর আলম ভুঁইয়া, সুনামগঞ্জ
  প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২৩, ১১:০৮| আপডেট : ১৭ জুন ২০২৩, ১১:৪১
অ- অ+

ধান, মাছ আর সবজির ফলনে হাওর কন্যা খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার হাওরের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। বছরের ৬ মাস বর্ষা আর বাকি ৬ মাস শুকনো মৌসুম আর প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানকার অর্থনীতির সুফল ঘরে তুলছেন কৃষক ও জেলেরা। ফলে প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন খাতে উৎপাদন বেশি হওয়ায় হাওর পাড়ের কৃষকদের অভাব দূর হয়ে সচ্ছলতা ফিরেছে।

জেলার ১২টি উপজেলায় বিস্তৃত ১৩৭টি ছোট বড় হাওর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাটি এলাকা। চলতি বছর এই জেলা থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ধান, সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মাছ ও ১৩শ কোটি টাকার সবজি উৎপাদন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সাদেক আলীসহ হাওর পাড়ের সচেতন মহল বলেন, দেশের অন্য যে কোন এলাকা থেকে সুনামগঞ্জ জেলা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। বর্ষা ও শুকনো মৌসুমে এখানকার জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ভাষা, ভূ-প্রকৃতি কিংবা জলবায়ু সব কিছুই ব্যতিক্রম। যার ফলে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সু-কৌশলে এখানকার অর্থনীতি ঘরে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার প্রায় ৩ হাজার ৭শ ৪৭ বর্গ কিলোমিটার হাওর এলাকার ৮০ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। এখানকার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদনকে ঘিরেই ঘরে উঠেছে মানুষের জীবনমান।

শুকনো মৌসুমে হাওরের ধান, সবজিসহ সব ধরনের কৃষি পণ্যের উৎপাদন করা হয় আর বর্ষা মৌসুমে যখন হাওরের এলাকা পানিতে টইটুম্বুর থাকে বিকল্প কাজের সুযোগ না থাকায় তখন মাছ আহরণ ও উৎপাদন করেই এখাকার মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।

ফলে এই দুই পেশাকে ঘিরেই যেমন এখানকার মানুষের জীবন মান পরিবর্তন হয়েছে তেমনি আধুনিকতার পরশে জীবন মানের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে হাওরের এলাকার অর্থনীতি।

জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরের কৃষক আব্দুল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, এক সময় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধানের চারা রোপন থেকে ধান মাড়াই পর্যন্ত প্রচুর পরিশ্রম করাসহ খরচও বেশি হত। বর্তমানে কৃষিতে মাঠে মাঠে ট্রাক্টর ও সেচপাম্প যোগ হওয়ায় ধানের চারা রোপণ, ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্রের আধুনিকতার ছোয়া লাগার ফলে কমেছে কঠোর পরিশ্রম, সময় ও খরচ। বেড়েছে কাঙ্খিত ফসলের উৎপাদন।

কৃষক আবিকুল মিয়া ঢাকা টাইমসকে জানান, আধুনিকতার ছোয়াঁয় ধান উৎপাদন করে সাফ্যলের মুখ দেখেছি। আগে ধান উৎপাদন করে খুব বেশি লাভ না হলেও এখন কৃষি অফিসের পরামর্শে ধান উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন আর বর্তমানে হাওরে কৃষকরা অর্থনেতিক দিক দিয়ে অনেক লাভবান।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর সুনামগঞ্জে ১৩ লক্ষ ৮ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধানের উৎপাদন হয় যা থেকে চাল উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৭২ হাজার ১শ ৪৯ মেট্রিক টন যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৬শ কোটি টাকা। তবে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ১৩ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। যা থেকে ৯ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ৩হাজার ৮শ কোটি টাকা। পাশাপাশি গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫শ মেট্রিক আমন ধানের উৎপাদন হয় যেখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্যে ছিল ৮শ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ৩ লাখ ১০ হাজার আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে। যেখান থেকে ২ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক চাল উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্যে ৮শ ৩০ কোটি।

জেলা মৎস্য অফিস থেকে জানা যায়, হাওর অধ্যুষিত জেলা হওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলায় ছোটবড় প্রায় এক হাজার বিলে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। যা থেকে ২শত প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয় এবং সেই মাছ সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে ১৬০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। এই জেলা প্রায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ২০টি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৫৩টি। বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তি মালিকানায় মাছ চাষ করা হয়।

আরও জানা যায়, গত বছর হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ থেকে ১ লক্ষ ৭ হাজার ৫শ ৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা হয় যার বাজার মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত ১৬ জুনের ভয়াবহ বন্যায় সকল মাছ ভেসে যায়। ফলে নিঃস্ব হয়ে পড়েন জেলার ১৭ হাজার মাছ চাষীরা। তারপরও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুধে টাকা নিয়ে চলতি বছর আবারও মাছ চাষ করেছেন চাষীরা। যেখান থেকে ১ লক্ষ ৯ হাজার ৫শ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে যার বাজার মূল্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।

মাছ চাষি ফজলুল হক, আলা উদ্দিন, হেলাল মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, প্রতি বছর বন্যায় আমরা মাছ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের কাছ থেকে কোন সহযোগীতা পাই না। তবে বর্তমানে মাছ চাষ করে তারা অনেক লাভবান। তবে যে বছর বন্যা হয় সে বছর তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, সুনামগঞ্জ হাওর এলাকা হওয়ায় এখানে দিন দিন মাছের উৎপাদন বাড়ছে। তবে মাছ চাষীরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের আর্থিক সহযোগিতা করাসহ মাছের উৎপাদন বাড়াতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এদিকে ধান ও মাছের পর এ জেলায় ব্যাপক সবজির উৎপাদন বেড়েছে। সেই সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করা হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের সবজি চাষি সজিব আহমেদ ঢাকা টাইমসকে জানান, এই বছর ২০ একর জমির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করেছেন সেই সবজির বাম্পার ফলনে জীবন বদলে গেছে। অন্য বছরের চেয়ে এই বছর সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। এবং বাজারে অনেক দাম পেয়েছি। ইতিমধ্যে তিনি ২০ লাখ টাকার সবজি বাজারে বিক্রি করেছেন তিনি।

শুধু সজিব আহমেদ নয়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি বছর সুনামগঞ্জে সবজির বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষীদের মুখে। সুনামগঞ্জে প্রতি বছর সবজি উৎপাদন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে এসব সবজি সুনামগঞ্জের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। তবে কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের সহযোগীতা করে তাহলে এই জেলায় আরোও সবজি উৎপাদন বাড়বে।

গত বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের সবজির উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য ৯শ ৫০ কোটি। তবে চলতি বছর সুনামগঞ্জে ৩ লাখ মেট্রিক টন সবজির উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্যে ১৩শ কোটি টাকা। ফলে দিন দিন এই ভাটির জেলায় সবজি উৎপাদন বাড়ছে।

সুনামগঞ্জ কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম ঢাকা টাইমসকে বলেন, হাওরের দিন দিন ধান ও সবজির উৎপাদন বাড়ছে। এতে কৃষকরা অনেক লাভবান হচ্ছেন এবং হাওরের অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে মাঠ প্রর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন: আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার সাংবাদিক নাদিম হত্যায় অভিযুক্ত বাবু চেয়ারম্যান

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, হাওরের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য হাওর প্রধান এলাকা সুনামগঞ্জের হাওরের ধান, মাছ সবজি উৎপাদন বাড়াতে আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগীতা করে যাচ্ছি। তা অব্যাহত থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/১৭জুন/এসএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আপনার স্মার্ট কার্ড তৈরি হয়েছে কি না যেভাবে জানবেন
বিএনপির শীর্ষ নেতারা কে কোথায় ঈদ করছেন
উত্তর ইরানে লৌহ যুগের ৩২শ বছর বয়সী নারীর কঙ্কাল আবিষ্কার
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে মদ্যপ অবস্থায় বিএসএফ সদস্য আটক, পতাকা বৈঠকে হস্তান্তর
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা