কোরবানির মাংস দীর্ঘদিন সংরক্ষণের উপায়

ত্যাগের মহিমায় আসছে পবিত্র কোরবানি। ঈদুল আজহা মানেই মাংস সংরক্ষণের একটা বাড়তি চাপ। তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করলে অল্প দিনেই তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক সময় এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণও নষ্ট হয়ে যায়। মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেট প্রথম ও সবচেয়ে সহজ উপায়। বিকল্প আরও নানা পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা যায়। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক মাংস সংরক্ষণের কিছু উপায় সম্পর্কে।
রেফ্রিজারেশন পদ্ধতি
মাংস সংরক্ষণের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ডিপ রেফ্রিজারেটরে মাংস সংরক্ষণ করা। মাংসের ৫০-৭৫% অংশই পানি। এ পানি থেকেই পচনশীল জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার নিচে রেফ্রিজারেটরে মাংস সংরক্ষণ করা উচিত। -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ওই পানির প্রায় ৯৮% অংশই ক্রিস্টাল হয়ে পচন রোধ করে।
রেফ্রিজারেটরে গরুর মাংস ৫-৬ মাস, খাসির মাংস ৪-৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে কলিজা বেশিদিন রেফ্রিজারেটরে না রাখাই ভালো। এছাড়াও উট ও মহিষের মাংস ৩-৪ মাস রাখা যাবে। আর ভেড়ার মাংস রাখা যাবে ২-৩ মাস। তবে রেফ্রিজারেটরে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইটে থাকলে মাংস প্রায় এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
মাংসে চর্বি যত কম থাকবে, মাংস তত বেশিদিন সংরক্ষণ করা যাবে। তাছাড়া, সংরক্ষণের আগে অবশ্যই মাংস থেকে রক্ত, চর্বি, পানি পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ এগুলো থাকলে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আবার মাংস বেশি মোটা করে না কেটে স্লাইস করে রাখলে বেশিদিন ভালো রাখা সম্ভব।
মাংস ছোট ছোট প্যাকেটে সংরক্ষণ করা উচিত। মাংস সংরক্ষণ করতে অবশ্যই জিপলক ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত। মাংস সংরক্ষণে বিভিন্ন প্লাস্টিক ব্যাগ বা বক্স ব্যবহার না করে ভ্যাকিউম-সিল্ড ব্যাগ ব্যবহার করা সর্বোত্তম। মাংস রেফ্রিজারেটরে রাখার এক সপ্তাহের মধ্যে বাসায় বিদ্যুৎ না থাকলে ফ্রিজ না খুলাই উত্তম। কারণ শক্ত হওয়ার আগেই মাংস বাতাসের সংস্পর্শে আসলে তা বেশিদিন ভালো থাকে না।
ঘরোয়া পদ্ধতি
আদা গুঁড়া, মিট এনহ্যান্সার, সয়া প্রোটিন পাউডার, সিরকা, কিউরিং সল্ট, ভেজিটেবল প্রোটিন, পাপরিকা পাউডার, সেলারি পাউডার এবং আলু দিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা সম্ভব।
ড্রাইং পদ্ধতি
এটি মাংস সংরক্ষণের একটি পুরোনো পদ্ধতি। মূলত অতীতে যখন রেফ্রিজারেটর ছিল না, তখন এ পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা হতো। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নিতে হয়। এটি অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ সাশ্রয়ী। এ পদ্ধতিতে মাংসের চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা করে কেটে ভ্যাকিউম-সিল্ড করে ফ্রিজে এক বছর পর্যন্ত রাখা যায়।
স্মোকিং পদ্ধতি
মাংস সংরক্ষণে এটিও একটি পুরোনো পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে দুটি উপায়ে মাংস মাংস সংরক্ষণ করা হয়। একটি হলো হট স্মোকিং আর অন্যটি হলো কোল্ড স্মোকিং। হট স্মোকিং এর ক্ষেত্রে ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়ানো হয়। অন্যদিকে, কোল্ড স্মোকিং পদ্ধতিতে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা স্মোকিং আগুনে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়াতে হয়। ফলে তাপের ধোঁয়ায় মাংসের জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। সাধারণত মাংস ব্যবসায়ীরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।
সল্টিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে লবণ, কিউরিং লবণ, মসলা এবং ব্রাউন চিনি অথবা খাবার লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস মেখে ২৪ ঘণ্টা রেখে ফ্রিজে এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মাংসের অক্সিডেটিভ ও মাইক্রোবিয়াল পচন প্রতিরোধই এ পদ্ধতির বিশেষত্ব। টিএফডিএ অনুমোদিত এই সল্টিং বা লবণ পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি টাটকা এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হয়ে থাকে।
ক্যানিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিটি থার্মাল স্টেরিলাইজেশন নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রায় ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় মাংস ড্রাই করে ঠাণ্ডা করা হয়। কাচের জার বা বয়ামের মুখ আটকে তাতে এ মাংস প্রায় এক বছর পর্যন্ত রাখা যায়। এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে গেলে মাংস কাটা, রান্নার আগে সিমিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঠাণ্ডা করা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
কোল্ড স্টেরিলাইজেশন পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে মাংসের সঙ্গে আয়োনাইজড রেডিয়েশন, অর্থাৎ কোবাল্ট, গামা রেডিয়েশন, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশন ইত্যাদির মতো রেডিয়েন্ট এনার্জি ব্যবহার করা হয়। মাংস সংরক্ষণের নতুন এই পদ্ধতিতে অধিকাংশ মাইক্রো অর্গানিজম মেরে ফেলা হয়। ফলে মাংসের সব পুষ্টিগুণাগুণ অটুট থাকে।
জ্বাল দিয়ে সংরক্ষণ
পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনিম জানিয়েছেন, মাংস উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বাল দিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ছয় ঘণ্টা পর পর মাংসটি জ্বাল দিতে হবে, নাহলে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এভাবে মাংস কয়েকদিন পর্যন্ত ভাল থাকে।
পানিতে সিদ্ধ করে সংরক্ষণ
প্রাচীণকাল থেকে এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ হয়ে আসছে। হলুদ ও লবণ দিয়ে মাংস সেদ্ধ করে অনেক দিন সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
রোদে শুকিয়ে
রোদে শুকিয়েও মাংস বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। এজন্য মাংসগুলো মাঝারি আকারে কেটে পরিষ্কার পানিতে ভালভাবে ধুয়ে নিন। এই মাংসের সাথে কোন অবস্থাতেই চর্বি রাখা যাবে না। এরপর মাংসের পানি নিংড়ে নিয়ে তাতে যথেষ্ট পরিমাণে লবণ ও হলুদ মাখিয়ে নিন, এবং পানিতে সেই মাংস কিছুক্ষণ সেদ্ধ করে নিন।
মাংস আধা সেদ্ধ হলে অর্থাৎ কাঁচা মাংসের গন্ধ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা চুলা থেকে নামিয়ে তিনি পুরো পানি ছেঁকে ফেলুন।
তারপর মাংসের টুকরোগুলো শিকে গেঁথে রোদে দিয়ে রাখুন। এভাবে মাংস শুকাতে একটানা চার থেকে সাত তিন সময় লাগে।
বাইরের ধুলোবালি থেকে মাংসগুলোকে বাঁচাতে পাতলা কাপড় পেঁচিয়ে দিতে পারেন।
মাংসের সব পানি সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে গেলে যেকোনো এয়ারটাইট কন্টেইনারে রাখতে হবে।
শুকনা এই মাংসটি হালকা গরম পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখার পর স্বাভাবিক নিয়মে রান্না করা যাবে।
লেবু পানিতে সংরক্ষণ
লেবু লবণ পানিতে মাংস ডুবিয়ে রাখলে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। এজন্য মাংসগুলো মাঝারি আকারে কেটে হালকাভাবে ছেঁচে নিন। এরপর লবণ ও লেবুর রসে ঘণ্টা-খানেক ডুবিয়ে রাখুন, যেন মাংসের ভেতরে ভেতরে সেটা পৌঁছায়। এভাবে মাংস কয়েকদিন পর্যন্ত ভাল রাখা যায়।
মাংস ভেজে সংরক্ষণ
এজন্য মাংস কেটে পরিষ্কার করে আদা বাটা, রসুন বাটা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মাংসটি কিছুক্ষণ ম্যারিনেট করে রাখুন। এরপর গরম ডুবা তেলে মসলাসহ মাংসগুলো ভেজে নিন এবং তেল ছেঁকে নিয়ে তা সংরক্ষণ করেন।
ডুবো তেলে মাংস সেদ্ধ করলে সেটা অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
এর পর একদিন অন্তত অন্তত মাংসগুলো উচ্চতাপে গরম করতে হবে। এভাবে মাংস ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত ভাল থাকে।
এছাড়া মশলা ছাড়াই শুধুমাত্র ডুবো তেলে মাংস সেদ্ধ করে সংরক্ষণ করা যায়। এজন্য হাঁড়িতে যথেষ্ট পরিমাণে তেল গরম করে মাংস ডুবিয়ে পুরোপুরি সিদ্ধ করতে হবে।
দু-এক দিন পর পর তেলে ডোবানো মাংস গরম করে নিতে হবে। এভাবে ১৫ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত মাংস সংরক্ষণ করা যায়।
এছাড়া লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস পুরো একদিন মেরিনেট করে রাখলে সেটা ফ্রিজে ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাংসের পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।
(ঢাকাটাইমস/৪ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন