কোরবানিতে খান স্বাস্থ্যকর ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি, জানুন যেভাবে রান্না করবেন

ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া হয়। তাই এ সময় কোরবানির মাংস খাওয়া হয় অনেক বেশি। কোরবানির মাংস দিয়ে হরেক রকম পদের খাবার খাওয়া হয়ে থাকে। আর খাবারের মেনুতে মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি থাকবে না তাই হয় নাকি। ওপারের কাচ্চি বিরিয়ানি এপারেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অনেক কিছু মিলের মধ্যে এই খাবারটির স্বাদের বিষয়ে সকলেই একবাক্যে নাম শুনেই বাহবা করে ওঠেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে কাচ্চি বিরিয়ানিতে ডিম, মাংস এবং শাকসবজি ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যকর হতে পারে।
হলুদ, জিরে, গোল মরিচ, আদা, রসুন এবং জাফরান বিরিয়ানিতে যোগ করা হয়। এই সমস্ত জিনিসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরকে সুস্থ রাখে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো আমাদের শরীরের অঙ্গগুলোকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হলুদ এবং গোল মরিচ বিরিয়ানিতে যোগ করা হয় এবং এই দুটি মশলাই আমাদের পরিপাকতন্ত্রের উন্নতিতে কাজ করে। এদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে কাজ করে।
পেঁয়াজ, আদা এবং রসুন খাবারটিকে সুস্বাদু করে তুলতে পারে। তবে এই জিনিসগুলি আমাদের স্বাস্থ্যকরও করতে পারে। এর মধ্যে সালফার যৌগ, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি৬ এবং ভিটামিন সি পাওয়া যায়। বিরিয়ানিতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারের স্বাস্থ্য বজায় রাখতেও সহায়ক।
'কাচ্চি 'বিরিয়ানির মতো এই লোভনীয় খাবারটি কীভাবে এলো ! চলুন জেনে নেওয়া যাক ঐতিহ্যবাহী কাচ্চির ইতিহাস।
বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘বিরিয়ান’ এবং ‘বিরিঞ্জি' থেকে। ‘বিরিয়ান’ অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া এবং ‘বিরিঞ্জি’ মানে চাল। বিরিয়ানি রান্না করার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নিতে হয়, সেজন্যই এই নামকরণ।
আর ‘কাচ্চি’ শব্দটির উৎপত্তি উর্দু ‘কাচ্চা' শব্দ থেকে। বাংলায় ‘কাঁচা'-র প্রতিশব্দ ‘কাচ্চা'। কাচ্চি বিরিয়ানিতে সেদ্ধ করা ছাড়াই কাঁচা মাংস সুগন্ধি চালের সাথে মিশিয়ে রান্না করা হয়। হিন্দি এবং উর্দুতেও এই মোগলাই খাবারটি ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’ নামেই পরিচিত। কাচ্চি বিরিয়ানিতে টক দই এবং বিভিন্ন মশলা দিয়ে মাখানো খাসির মাংসের উপর সুগন্ধি চাল ও আলুর আস্তরণ দেওয়া হয়। তারপর যে হাঁড়িতে রান্না করা হয় তাতে আটা বা ময়দার ডোর মাধ্যমে ঢাকনা এমনভাবে আটকে দেওয়া হয় যেন ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। রান্না করার এই পদ্ধতির নাম ‘দম পোক্ত'। আর কাঁচা মাংস দিয়ে দমে রান্না করা হয় বলেই এর নাম ‘কাচ্চি বিরিয়ানি’।
তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানের চাঘতাই জাতির মাধ্যমেই এই খাবারের প্রচলন শুরু। শীতপ্রধান এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের লাল মাংস, বিশেষ করে ভেড়ার মাংস বেশ পছন্দের। লাল মাংসের সাথে চাল ও বিভিন্ন উপাদান, যেমন- মাখন, গোলমরিচ, লবণ, এলাচ এবং স্থানীয় মশলা জয়ফল ব্যবহার করে তারা একটি বিশেষ খাবার প্রস্তুত করতে শেখে। আর এভাবেই যাত্রা শুরু কাচ্চি বিরিয়ানির। ধারণা করা হয়, ১৩৯৮ সালে ভারতবর্ষে তুর্কী-মোঙ্গল সেনাপতি তৈমুর লংয়ের আগমনের সাথে সাথে এই বিরিয়ানিরও আগমন ঘটে। তৈমুরের সেনাবাহিনীর জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার তাগিদে চাল, বিভিন্ন মসলা এবং মাংস দিয়একটি হাড়িতে ভর্তি করা হতো। তারপর গনগনে গরম একটা গর্তে হাঁড়িটি চাপা দিয়ে দমে রান্না করা হতো এই খাবার।
ইতিহাসের পাতায় ভারতবর্ষে বিরিয়ানির আগমনের পেছনে যেসকল গল্প রয়েছে সেগুলোর মধ্যে মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের গল্পটিই সবচেয়ে পরিচিত। শোনা যায় যে, একবার সম্রাজ্ঞী ব্যারাকে গিয়ে সৈন্যদের শোচনীয় অবস্থা দেখতে পান। তাদের দুর্বল ও ভগ্ন স্বাস্থ্য মমতাজকে চিন্তিত করে তোলে। তিনি সৈন্যদের জন্য নিয়োজিত বাবুর্চিকে ডেকে চাল ও মাংস দিয়ে এমন একটি খাবার প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে। নির্দেশ অনুসারে একটি বিশাল হাঁড়িতে চাল, মাংস এবং হরেক রকমের মসলা দিয়ে অল্প আঁচে ও দমে কয়েক ঘণ্টা রান্না করে তৈরি হয় একটি বিশেষ খাবার, তথা বিরিয়ানি।
বর্তমানে ঢাকার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ‘ঢাকাইয়া কাচ্চি’। ১৯৩৯ সালে ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির যাত্রা শুরু। মাত্র এক হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে শুরু হওয়া ব্যবসা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর অতুলনীয় স্বাদ এবং ভালো মানের কারণে প্রসারিত হয়। বর্তমানে পুরান ঢাকায় গেলেই দেখা মিলবে কাচ্চি বিরিয়ানির সারি সারি দোকান। প্রতিটি দোকানের বিরিয়ানিতেই কোনো না কোনো বিশেষত্ব রয়েছে। কোথাও বিরিয়ানিতে ঘি বা মাখনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় শুধুই সরিষার তেল, আবার কোথাও খাসির বদলে গরুর মাংস দিয়ে বানানো হয় এই কাচ্চি বিরিয়ানি।
সকালে-দুপুরে-রাতে সর্বক্ষণই জমজমাট পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানগুলো। আসল কাচ্চির স্বাদ নিতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে আসে এখানে। প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলায় রাজত্ব করা মুঘল খাদ্য ভাণ্ডারের এই সুস্বাদু খাবারটির ব্যবসায়িক বিশাল বাজার দেখতে এবং এর অতুলনীয় স্বাদ উপভোগ করতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন পুরান ঢাকায়।
কাচ্চি বিরিয়ানির দোকানগুলির পীঠস্থান হল ঢাকা। কাজি আলাউদ্দিন রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, উর্দু রোড, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, রায়সাহেব বাজার, নবাবপুর, কোতোয়ালি, ইসলামপুর, মালিটোলা, মৌলবীবাজার ইত্যাদি জায়গায় বিরিয়ানির দোকান গড়ে উঠেছে।
বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হচ্ছে অর্থাৎ ১৯৩৯ সাল নাগাদ ঢাকায় প্রথম বিরিয়ানির দোকান গড়ে ওঠে। দোকানের মালিক ছিলেন হাজি মহম্মদ হোসেন। ঢাকা জুড়েই যা হাজির বিরিয়ানি নামে পরিচিত। পুরনো ঢাকায় কাজি আলাউদ্দিন রোডে হাজি মহম্মদ নাকি একটি মাত্র হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
হাজির বিরিয়ানির পাশাপাশি ফখরুদ্দিন মুন্সি বিরিয়ানির দোকান খোলেন। ১৯৬৬ সালে ভিকারুন্নেসা স্কুলের ক্যান্টিনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয় ফখরুদ্দিন বিরিয়ানির। তারপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই জনপ্রিয় হয়েছে কাচ্চি বিরিয়ানি।
হাজি সিরাজ-উল-ইসলাম নান্না। অল্প বয়স থেকে কষ্টের জীবন। প্রথমে বিড়ি বাঁধতেন। এক খাবারের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই ভাগ্য বদলে যায়। হয়ে উঠেন নান্না বিরিয়ানির জনক। মোরগ পোলাও দিয়ে যাত্রা শুরু। ১৯৬২ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে নান্নার মোরগ পোলাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর তারসঙ্গে জুড়ে যায় কাচ্চি বিরিয়ানি।
কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নার সহজ রেসিপি
উপকরণ
গরু বা খাসির মাংস ৪ কেজি, পোলাওয়ের চাল ২ কেজি, ঘি ৫০০ গ্রাম, আলু আধা কেজি, পেঁয়াজের বেরেস্তা ২কাপ, দারুচিনি ৮-১০ টুকরো, এলাচ ১০-১২টি, আদা বাটা ৪ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ৪ টেবিল চামচ, গরম মসলা গুঁড়া (দারুচিনি, এলাচ, জয়ফল, জয়ত্রি, শাহজিরা ও গোলমরিচ) ২ টেবিল চামচ, জিরা আধা চা চামচ, দই দেড় কাপ, দুধ ৪ কাপ আলুবোখারা ১৪-১৫টা, গোলাপ জল ১ টেবিল চামচ, লবণ পরিমাণ মতো। সিদ্ধ ডিম।
প্রণালি
মাংস ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। হাঁড়িতে মাংসের সঙ্গে আদা রসুন বাটা, লবণ, চিনি, টকদই, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ দিয়ে মেখে আধা ঘণ্টা রেখে দিন। গরম মসলার গুঁড়া, অর্ধেক ঘি ও জাফরান দিয়ে ভালোভাবে মাংস মেখে ১৫ মিনিট রাখুন।
এবার দুই কাপ দুধ মাংসের ওপর ঢেলে দিন। আলু লবণ মেখে তেলে ভেজে মাংসের ওপর দিন চাল ধুয়ে আধা সেদ্ধ করে মাংসে দিন। বাকি অর্ধেক ঘি, পেঁয়াজের বেরেস্তা, কিশমিশ, আলুবোখারা, বাদাম, গোলাপ জল ছড়িয়ে দিয়ে অল্প আঁচে এক ঘণ্টার মতো চুলায় রাখুন। চুলায় ওঠানোর আগে আটা মেখে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে দিন। এক ঘণ্টা পর আঁচ আরো কমিয়ে দমে রাখুন। চুলায় তাওয়ার ওপর হাঁড়ি বসিয়ে অল্প আঁচে দমে রাখুন। চুলা থেকে নামিয়ে পছন্দমতো সালাদের সঙ্গে গরম গরম পরিবেশন করুন। পুষ্টি বাড়াতে সিদ্ধ ডিম দিয়ে খেতে পারেন।
(ঢাকাটাইমস/৪ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন