সতর্কবার্তা যাচ্ছে কোটা আন্দোলনে

মোরশেদুল জাহের, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০২৪, ২০:৫৪| আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ২১:৩৬
অ- অ+

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকার, প্রশাসন সরকারদলীয় সংগঠন আর কোনো সহনশীলতা দেখাতে রাজি নয়। তাদের কথায় এমনই আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে আন্দোলনকারীরাও দিনে দিনে আরও বেশি সংগঠিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবারের বাধভাঙা জনস্রোত ছিল এখন পর্যন্ত চলমান আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি উত্তাল মুহূর্ত।

তবে এই অবস্থা আর বাড়তে দিতে চা্য় না সরকার প্রশাসন। সতর্কবার্তা যাচ্ছে কোটা আন্দোলনকারীদের মাঝে।

এত দিন সব পক্ষ তাদের বক্তব্যে পরিমিতি বজায় রেখেছিলেন। সংযত ছিলেন। সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর চীনযাত্রার প্রাক্কালে তার নির্দেশনার ভূমিকা ছিল এতে। কিন্তু আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় স্থগিতের পর আর কোনো বাধ নেই। তাই কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি হুমকি বাড়ছে। পুলিশের ভূমিকা আর আগের মতো নীরব কিংবা নিষ্ক্রিয় নেই।

তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া ছিল বৃহস্পতিবার বিকালের বাংলা ব্লকেডে। বিপুল শিক্ষার্থীর সমাগমে স্লোগানে ব্যবহৃত হয় অসংযত ভাষা, তাচ্ছিল্যভরা প্যারোডি, পুলিশকে উদ্দেশ করে ভুয়া ভুয়া ধ্বনি, এমনকি পুলিশের রায়ট কারের ওপর উঠে কাউকে কাউকে স্লোগান দিতে বিক্ষোভ দেখাতে দেখা গেছে। ঘটনা সরকার পুলিশ প্রশাসনকে ক্ষুব্ধ করেছে বলে জানা গেছে।

রাজধানী ঢাকাসহ যেসব শহরে কোটা আন্দোলন বেশি সক্রিয়, সেখানে মানুষের জীবনযাত্রায় ভোগান্তি সৃষ্টি করছে। এতদিন যারা কোটা আন্দোলনকে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন, তারা এখন সরকার আন্দোলনকারী দুই পক্ষকেই দোষারোপ করছেন। তারা চান, এই আন্দোলনের কারণে যেন ভোগান্তি আর না বাড়ে, সরকার যেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু ধরনের কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ, কিংবা আশ্বাস সরকার তরফে আসেনি এখনো।

বিভিন্ন সূত্রে যে খবর আসছে, তাতে আগের অবস্থানে আর থাকছে না নীরব পক্ষগুলো। এতদিনকার অহিংস আর আপাত নিরীহ আন্দোলন এবং ধৈর্য্য ধরা সরকার, প্রশাসন সরকারি ছাত্রসংগঠন এখন পরস্পর চ্যালেঞ্জের সামনে। সূত্র বলছেন, সব পক্ষ যদি নিজেদের জায়গায় অনড় থাকে, সেটি সহিংসতাকেই কেবল উসকে দেবে। তাতে ডেকে আনবে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি।

তবে ভেতরে ভেতরে কোটা আন্দোলনকারীদের মধ্যে এই বার্তা যাচ্ছে যে, তাদের এখন কর্মসূচি বদলাতে হবে। তাদের আন্দোলনকে আদালতের বিপক্ষে দাঁড় করানোর চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আপিল আদালতের রায়ের আলোকে সরকারকে সময় দিতে হবে। নইলে নিজেদের বিপদ বাড়বে। কোটা আন্দোলন তার পথ হারাতে পারে।

বৃহস্পতিবার শাহবাগের পুলিশের এই ব্যারিকেড এক পর্যায়ে ভেঙে ফেলেন শিক্ষার্থীরা

পুলিশ প্রশাসন সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবার পুলিশ কঠোর অবস্থানে থেকেও কিছুটা নমনীয় ভুমিকা পালন করে। তবে এখন আর নমনীয়তা দেখাবে না। দেশের কোথাও কোটা আন্দোলনকারীদের সড়কে নামতে দেওয়া হবে না- এই প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। প্রস্তুতির ধরনও নানা রকম।

আন্দোলনকারীরা সরকারের কাছে কোটা নিয়ে যে আইন বা নির্বাহী আদেশ চাইছে, সেটারও একটা সুযোগ সামনে আসছে বলে মনে করেন সরকারি দলের একজন নেতা। কোটার সংস্কার সরকারের কাছ থেকে আদালত ঘুরে আবার ফিরে এসেছে সরকারের কাছে। আদালত কোটা নিয়ে যে রায় দিয়েছে, তাতে সরকারের একটা ভূমিকার জায়গা তৈরি হয়েছে। কোটা বহাল রেখে সেটি কম-বেশি করতে পারবে সরকার।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিরক্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। ওই বছরের অক্টোবর -সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই প্রজ্ঞাপনকে চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাত সদস্য ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। গত জুন হাইকোট সরকারের সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে কোটা পুনর্বহালের রায় দেন।

এই রায় প্রত্যাখ্যান করে আবার রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। যদিও সরকার বলে আসছিল আদালতের রায় নিয়ে তাদের করার কিছু নেই। রায় দিয়েছে আদালত, ফয়সালা করতে হবে আদালতেই। আপিল আদালত ১০ জুলাই হাইকোর্টের রায় চার মাসের জন্য স্থগিত করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চাইছে সরকার আইন করে কিংবা নির্বাহী আদেশে কোটার নিম্নতম মাত্রা নির্ধারণ করে দিক। এটা না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলনের মাঠ ছাড়বে না। রক্ত দিয়ে হলেও দাবি আদায় করে ঘরে ফিরবে তারা।

এই প্রত্যয় নিছকই আন্দোলনের মাঠ গরম করার জন্য ঘোষণা, নাকি ভেতরে ভেতরে বড় কোনো আলোড়ন তৈরি হয়ে আছে, সেটি শিগগিরই বোঝা যাবে। তবে একজন সরকারদলীয় সাংসদ বলেন, আদালতের রায়ের পর সরকারকে সময় না দিয়ে যদি শিক্ষার্থীরা মাঠ না ছাড়ে, তবে সরকার, পুলিশ প্রশাসন সরকারি দলের সংগঠনের তরফে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে তাদের বক্তব্যে। এটা নিশ্চয়ই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বুঝতে পারার কথা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সুস্পষ্ট করে বলেছেন, আদালতের রায়ের পর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীরা সীমা লঙ্ঘন করছেন। এমনকি তিনি এর মধ্যেঘোলা পানি তৈরির লোকের ঢুকে পড়ার তথ্য পাচ্ছেন। তিনি পুলিশকে যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেটি তার ভাষায়, ‘আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশকে বলেছি, এদের কথা আমরা শুনব। কিন্তু শোনারও একটা সীমা থাকে। লিমিট ক্রস করলে পুলিশ বসে থাকবে না। ছাত্ররা আদালতে নিজেদের বক্তব্য জানাতে পারেন। রাস্তায় থেকে তাদের কষ্ট করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না মন্ত্রী।

একই সঙ্গে ম্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) হার্ডলাইনে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, আদালতের আদেশ মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেউ আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো কার্যক্রম করলে সেটি বরদাশত করা হবে না।

উচ্চ আদালত চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ চার মন্ত্রী কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের আর জনদুর্ভোগ না বাড়িয়ে এবার পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

কোটা আন্দোলনে বিরোধী দল তথা বিএনপির উপস্থিতির সন্দেহ করছেন সড়কমন্ত্রী। তবে সে খায়েশ পূরণ হতে দেবে না আওয়ামী লীগ- কথাও বলেন তিনি। তার ভাষায়, শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে কোনো মহল দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইলে সরকারকে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিকভাবেও তা মোকাবেলা করা হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক রকম হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, আদালতের রায় মেনে শিক্ষার্থীদের ফিরে যাওয়া উচিত। সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা, জনগণের সুবিধা অসুবিধা দেখা। সেখানে যদি কেউ বাধাগ্রস্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত জুলা্ই থেকে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে কার্যত নীরব ছিল সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। আবার সংগঠনটির অনেক সাধারণ কর্মীর অংশগ্রহণ আছে এই আন্দোলনে। সংগঠনটি ক্যাম্পাসেও অনেকটা চুপচাপ ছিল। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল তারা যেন কোটা আন্দোলনকারীদের কোনো ধরেনের উসকানি না দেয়। সেই ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হতে দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার মধুর ক্যান্টিনের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন

সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন কোটা আন্দোলনের বাংলা ব্লকেডকেব্লকেড ব্লকেড খেলা বলে অভিহত করেন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ডানে-বাঁয়ে সামনে-পিছনে অনেক কিছু দেখছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্রলীগ একটি সংকটময় চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে আছে বলে জানান তিনি।

এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার কোটা আন্দোলনের বাংলা ব্লকেডে পুলিশের বাধা কিংবা অন্য কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা ছিল মানুষের মধ্যে। সাংবাদিকদের অনেকে নিরাপত্তামূলক বর্ম ভেস্ট পরে শাহবাগ সায়েন্স ল্যাবে যান সংবাদ কাভার করতে।

অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা কুমিল্লাসহ কয়েক জায়গায় দেখা গেছে। কুমিল্লায় আন্দোলনকারীদের বাধা এমনকি তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরিয়াল বডি, পুলিশ বাধা দিয়েছে। হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

মিরপুর রোডে আন্দোলনকারীদের মিছিল সায়েন্স ল্যাব নীলক্ষেত মোড়ের মধ্যে আটকে রাখে পুলিশ। এক সময় তাদের ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধ্য করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকা থেকে এসে অবস্থান নেন গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রধান ফটকে বাধা দেয় পুলিশ। তবে বাধা ভেঙে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

তবে সবার দৃষ্টি ছিল রাজধানীর শাহবাগের দিকে। সেখানে কাঁটাতারের লোহার ব্যারিকেড সামনে রেখে বিপুল সংখ্যক পুলিশ কয়েক স্তরে অবস্থান নেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মিছিলের বন্যা এতই বিশাল প্রবল ছিল যে সব বাধা ভেঙে শাহবাগের দখল নেন শিক্ষার্থীরা। পিছু হটতে হয় পুলিশকে। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা।

তবে কুমিল্লা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় শেষ পর্যন্ত কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এদিনের কর্মসূচি শেষ হয়। শুক্রবারের জন্য ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় শাহবাগে। এতে উত্তেজনার কিছুটা প্রশমন এবং সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা কমে বলা যায়।

সবশেষে শুক্রবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশের পর নতুন কর্মসূচি হলো শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনলাইন-অফলাইনে মতবিনিময়। এরপর সন্ধ্যায় ঘোষণা করা হবে নতুন কর্মসূচি। তারা কি অবরোধের মতো আগের কর্মসূচি বজায় রাখবে, নাকি সাংগঠনিকভাবে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে দাবির আওয়াজ জোরদার করবে সেটাই দেখার।

(ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/এসআইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কুষ্টিয়ায় পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ
ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে নগর ভবনে ঢাকাবাসী
জবি শিক্ষার্থীদের ‘লং মার্চ টু যমুনা’, পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে আহত শতাধিক
বিশ্বের ‘দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট’ হোসে মুজিকা মারা গেছেন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা