বৈষম্যহীন স্বপ্নপূরণের নতুন সকাল

১৯৭১ আর ২০২৪। দুটি শতাব্দীর সেতুবন্ধ। ৫৩ বছরের ব্যবধানে আমাদের মুক্তির লড়াইয়ের দুটি বিজয় অর্জনের বছর। একাত্তর দিয়েছে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা। আর চব্বিশের লড়াইয়ে আমরা পেয়েছি জগদ্দল স্বৈরাচারের দেয়াল ভেঙে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। আমাদের এই মুক্তির আনন্দ নিয়ে আজ পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়েছে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের নব প্রভাত।
স্বাগত ২০২৫। স্বাগত পহেলা জানুয়ারি। নতুন সম্ভাবনা, নতুন স্বপ্ন আর বৈষম্যমুক্ত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের যাত্রায় সঙ্গী হলো নতুন বছর।
এক বছর আগের এই দিনে ফিরে তাকালে এক ভীতিকর ও দমবদ্ধ বাংলাদেশকে দেখা যায়। একটি একতরফা নির্বাচনের জনহতাশা, গ্লানি আর ছাইচাপা ক্ষোভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের নতুন দিনটি। তবে ছাত্র-জনতার বীরত্বে বরাবর গর্বিত দেশটিকে বেশি দিন বয়ে বেড়াতে হয়নি এই হতাশা আর গ্লানি। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মুক্তি মেলে শ্যামল-সবুজ বাংলার।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-জনতা রক্ত দেয় একটি বৈষম্যহীন উদার গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজটি করতে পারেননি তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাই স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফিকে হতে শুরু করে মানুষের প্রত্যাশা। এরপর সামরিক শাসন, ছদ্ম সামরিক শাসন পেরিয়ে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে আবার গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আঁকে মানুষ। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রায় তিন যুগ পর ২০২৪ সালে দেশের মানুষের সামনে নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে দেশের তরুণ সমাজ।
দেশের যে প্রেক্ষাপটে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তন, বিগত সেই ১৫ বছরের দিকে ফিরে তাকালে কী দেখা যায়? জনগণের বাকস্বাধীনতা ছিল রুদ্ধ। দেশের রাজনীতির অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে বারবার। দিনের পর দিন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলায় স্বাভাবিক রাজনীতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে নির্বাচন কমিশন হয়ে ওঠে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান।
এ সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে সংসদে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন করা ছিল দুঃসাধ্য। এর সাথে যোগ হয় রাজনীতির মাঠের বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও নির্যাতন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে গুম-হত্যার মতো অপরাধে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এসব অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বিচার বিভাগের কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষমতাসীনরা তাদের দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করে। নিম্ন আদালতও অসহায় হয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ। পুরো বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা নষ্ট হয় মানুষের।
জনগণের কাছে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি না থাকায় রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে আর্থিক খাতে শুরু হয় ভয়াবহ লুটপাট। অতীতে মানুষ শুধু কতিপয় ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণের কথা শুনেছে, গত ১০ বছরে দেখেছে পুরো ব্যাংক লুট করে নেয়ার মতো ঘটনা। দুর্নীতি হয়ে উঠেছিল অতি সাধারণ বিষয়। দুর্নীতি দমন কমিশন নামের প্রতিষ্ঠানকে কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়েছে দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
সব মিলিয়ে গেল প্রায় ১৫ বছরে যে দমবদ্ধ অবস্থা তৈরি হয়েছিল দেশে, তার বিস্ফোরণ ঘটে আগস্টে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সাথে দেশ থেকে পালিয়ে যান তার দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে মাঝারি পর্যায়ের প্রায় সব নেতা এবং তাদের অপকর্মের সহযোগীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি আর কখনো দেখা যায়নি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনেও দলের নেতাদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি। এমনকি ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর তার দল জাতীয় পার্টির কোনো নেতার এমন পরিণতি হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যাকে বলা হচ্ছে জুলাই বিপ্লব, এর মধ্য দিয়ে দেশের দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। ছাত্রসমাজ একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলছে, যেখানে থাকবে সবার মত প্রকাশ ও রাজনীতি চর্চার স্বাধীনতা। যেখানে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলা না গেলেও এর ডালপালাসহ কাণ্ড ছেঁটে ফেলা হবে। যেখানে ধর্মের নামে, জাতিগোষ্ঠীর নামে মানুষের মধ্যে কোনোরকম বৈষম্য থাকবে না। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ এবং প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারবে, কখনো দলীয় প্রতিষ্ঠান হবে না। ব্যাংকসহ আর্থিক এবং অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিরবে সুস্থ প্রতিযোগিতা।
জুলাই বিপ্লব দেশের সাধারণ মানুষকে এই স্বপ্ন স্বাভাবিক প্রত্যাশা হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে। এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়ণ আর প্রত্যাশা পূরণের ভিত তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক খাতে তাদের সেই চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে, স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে অর্থনীতি।
সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ রাজনীতির মাঠ স্থিতিশীল করা। কারণ জুলাই বিপ্লবে তৈরি হওয়া মানুষের প্রত্যাশা পূরণের দীর্ঘমেয়াদি মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে রাজনীতিবিদদের। একটি বৈষম্যহীন উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত তৈরির নীতিগত কাজটি অভিজ্ঞদেরই করতে হবে। ছাত্রসমাজ থাকবে সেই ভিত তৈরিতে ভ্যানগার্ডের ভূমিকায়। রাজনীতিবিদদের অভিজ্ঞতার সাথে তরুণদের প্রাণচাঞ্চল্যের সমন্বয় করার কাজটি করে যেতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
দেশের মানুষ ১৫ বছরের দুঃস্বপ্নের রাত পেরিয়ে একটি নতুন ভোর পেয়েছে। এখন তারা এক একটি স্বপ্নিল রাত শেষে ঘুম থেকে উঠে দেখতে চায় আশাপূর্ণ দিন। সেই স্বপ্ন পূরণে নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ে শুরু হোক বৈষম্যহীন রাষ্ট্র নির্মাণের দৃঢ় পদক্ষেপে যাত্রা।(ঢাকাটাইমস/০১জানুয়ারি/মোআ/)

মন্তব্য করুন