বাজারে কিছু কিনতে গেলে ‘১০ বার ভাবতে হয়’ জয়নালদের

মো. শামিম মিয়া (১৩)। হাতিরঝিলের পাগলা মাজার এলাকায় নানির সঙ্গে থাকে। হাতিরঝিল লেক, কারওয়ান বাজার, মধুবাগ এলাকায় আমড়া বিক্রি করে নানি, মা ও ছোট বোনকে নিয়ে চারজনের সংসার চালায়। শামিম মিয়া দুই মাস আগেও নানির সঙ্গে ভিক্ষা করত। ভিক্ষা করতে গিয়ে মানুষের কাছে মার খেতে হতো প্রতিনিয়ত। এক মাস আগে সিদ্ধান্ত নেয় ভিক্ষা না করে কাজ করে সংসারের হাল ধরবে। যেই কথা সেই কাজ। প্রতিদিন কারওয়ান বাজার থেকে আমড়া কিনে এনে বিক্রি শুরু করে। কিন্তু আমড়া বিক্রি করে তার প্রতিদিনের সংসার খরচ, মাস শেষে বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
১৩ বছর বয়সের শামিম এক মাস আগেও মানুষের কাছে গিয়ে বলতো আল্লাহর ওয়াস্তে ১০ টাকা ভিক্ষা দেন। এখন ভিক্ষা ছেড়ে রাজধানীর অলিগলি যে পথেই মানুষের ভিড় সেখানেই গিয়ে বলছে, ‘মামা আমড়া কিনবেন? একটা আমরা মাত্র ১০ টাকা, দেই মামা? একটা কিনে নেন? কেউ কিনছেন আবার কেউ না কিনে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। জীবিকার সন্ধানে থেমে নেই ছোট শামিম মিয়া।
শামিম মিয়া দুঃখভরা চোখের কোণে পানি নিয়ে ঢাকা টাইমসকে বলে, ‘কী আর কমু, ভিক্ষা যহন করতাম তহন মানুষ গালি দিতো মা-বাবা নিয়া। এমনকি মাইরও দিতো। এহন ভিক্ষা ছাইড়া আমড়া বেচি। এরপরও মানুষ কিনতে চায় না।’
শামিম বলে, ‘এরকম চলতে থাকলে তো বাইচ্চা থাকা কঠিন হইয়া যাইব। এরমধ্যে বাজরে গেলে তো মনে হয় আমাগোরে আল্লাহ দুনিয়াতে কেন যে পাঠাইছে!’
শামিম বলে, ‘বাজারে যে সবজি কেউ কিনে না হেই সবজি কিইন্না আনতে হয়। কারণ একটু কমে পাওয়া যায়। কতো মাস যে হইছে টাটকা সবজি কিন্না খাই না। কোনো মতে ডাইল ভাত খাইয়া বাইচ্চা আছি।’
বর্তমান সময়ে দুর্মূল্যের বাজারে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য জীবিকা নির্বাহ করা অনেক কষ্টের। নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দামই আকাশছোঁয়া। গত বছরের ৫ আগস্ট হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় হু হু করে বেড়ে যায় মাছ-মাংস, সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম। এর ধারাবাহিকতায় বাজার পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।’
শুক্রবার সকালে কথা হয় চল্লিশোর্ধ্ব শেখ সুবাহান নামে এক পান-সিগারেট বিক্রেতার সঙ্গে। শেখ সুবাহানের সংসারে বউ ও দুই মেয়ে। তিনি থাকেন বাংলামোটর পাম্পের গলি এলাকায়। প্রতিদিন পান-সিগারেট বিক্রি করে দুই মেয়ের খরচ, নিজের ও অসুস্থ বউয়ের ওষুধের খরচসহ বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে কষ্টের শেষ নেই। সংসারের হাল ধরে রাখতে রাতের বেলা রিকশা চালাতেও হচ্ছে সুবাহানের।
সুবাহান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। এক কেজি পেঁপে কিনতে লাগে ৪০ টাকা, আলু ৫০ টাকা, আর চাল, ডাল, মশলা কিনলে তো পকেট ফাঁকা। বাজারে সবকিছুর যেভাবে দাম বেড়েছে, সংসার নিয়ে চলা দায় হয়ে পড়েছে।’
শুক্রবার সরজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি বরবটি ১০০ থেকে ১১০ টাকা, টমেটো ও গাজর ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বেগুন ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ভালো মানের গোল কালো রঙের বেগুন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, শিম ২০০ থেকে ২২০ টাকা, আলু ৫০ টাকা, করলা ১০০ থেকে ১১০ টাকা, ঝিঙে, ধুন্দল, কচুর মুখী, কাঁকরোল ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পটল, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, চিচিঙ্গা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, শালগম ৮০ টাকা, ফুলকপি, বাঁধাকপি ৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়ার চিড় ৫০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, পটল ৭০ টাকা, লতি ৮০ টাকা, পেঁপে ৪০, শসা ৬০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতিটি লাউ ৬০ থেকে ১০০ টাকা, জালি কুমড়া ৬০ টাকা, কাঁচা কলার হালি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া লাল শাকের আঁটি ২৫ টাকা, পুঁই শাক ৩০ টাকা, কলমি শাক ১০ টাকা, ডাটা শাক ২০ টাকা, লাউ শাক ৫০ টাকা, কচুর শাক ১৫ টাকা, শাপলা ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. রুকন মিয়া সবজি বিক্রি করেন মধুবাগ এলাকায়। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সবজি বিক্রি করে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। বেশি দামে সবজি কিনতে চায় না ক্রেতারা। আর সবজির পাশাপাশি বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। বর্তমান বাজারে এই অবস্থায় বউ-বাচ্চাকে নিয়ে চলা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি রুই মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পাঙাশ ও তেলাপিয়ার দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, কাতল ৩৫০ থেকে ৮০০ টাকা, মলা মাছ ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, রুই মাছ ৪০০ টাকা, শিং মাছ ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা, কাচকি ৬০০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, পোয়া ৪০০ থেকে ৫০০, কই ২৪০ থেকে ৩০০, মাগুর ৬০০ থেকে ৮০০, বোয়াল ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, মৃগেল ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, বড় আকারের ট্যাংরা ৮০০ টাকা, বাটা মাছ ৪০০, চিংড়ি ৮০০ থেকে ১ হাজার, ছোট পুঁটিমাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, ছোট আকারের প্রতি কেজি ইলিশ ৮০০ টাকা, মাঝারি আকারের ইলিশ ১৫০০ টাকা, বড় আকারের ইলিশ ২ হাজার থেকে শুরু করে ২ হাজার ৮০০ টাকা, রূপচাঁদা ১০৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় মাছ কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী জাহেদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার যে আয় এই আয়ে ৫০০/১০০০ টাকা কেজি মাছ কিনতে পারছি না। তাই মাছ না কিনেই বাসায় চল যাচ্ছি।’
রিকশা চালক জয়নাল মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বর্তমানে ঋণ কইরা চলি। আল্লাহ আমাগোর খাওনের লাইগা পেট দিছেন। চোখ দিছেন দেখার লাইগ্যা, হাত-পা দিছেন কাজ কইরা চলার জন্য। কিন্তু কাজকর্ম ঠিকই করতাছি, কিন্তু বাজারের এমন অবস্থায় চলা দায় হইয়া পড়ছে। কোনো কিছু কিনতে গেলে এক বারের জায়গায় ১০ বার ভাবতে হয়।’
বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা, লেয়ার ৩৫০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা, সোনালি হাইব্রিড ৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৫০০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, খাসির মাংস এক হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতিটি ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিম ১৪ টাকা, হালি ৫৫ টাকা ও ডজন ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট চালের কেজি ৭০-৭৫ টাকা, ১ নাজিরশাইল ৭০-৮০, হাস্কি ৫৮-৬০ টাকা, ব্রি আটাশ ৬০ টাকা, পাইজাম ৫৬ টাকা, গুটি ৫২ টাকা, স্বর্ণা ৫৫ টাকা, ব্রি ২৯ ৬০ টাকা, চিনিগুঁড়া আতপ ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মুদি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী পেঁয়াজ ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা থাকলেও বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া আমদানি করা পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া আদা ২০০ টাকা, চায়না আদা ২২০ টাকা, খোলা চিনি ১৪০ টাকা, খোলা আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, প্যাকেট আটা ৬৫ টাকা, দুই কেজির প্যাকেট আটা ১১০ টাকা, দেশি মসুরের ডাল ১৪০ টাকা, লবণ ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, ইন্ডিয়ান মসুর ডাল ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রামপুরা এলাকার বাসিন্দা মিঠু রায় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই পূঁজোতে বাড়ি যেতে পারছি না। একমাত্র টাকার অভাবে। একদিকে রুজি করি অন্যদিকে বাজার করতে গিয়ে পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। এরকম যদি চলতে থাকে কীভাবে পরিবার নিয়ে চলব?’
(ঢাকাটাইমস/২০অক্টোবর/পিআর/এফএ)

মন্তব্য করুন