ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি গোপালপুর মেলা

আনন্দময় ছিল আমার শৈশবের দেখা প্রথম পহেলা চৈত্রের মেলা। চৈত্র এলেই মনটা কেমন যেন হয়৷ মনে পড়ে সেইসব ধূলিধুসর, রৌদ্রমাখা দিনগুলোর কথা৷ মনে পড়ে যায় আমার প্রিয় গ্রামের কথা, গ্রামের হাট-বাজার, যাত্রাপালা, নাগরদোলা আর কাঙ্খিত সেই গোপালপুর মেলার কথা৷
পুরো মাসব্যাপী অপেক্ষার প্রহর শেষে পহেলা চৈত্র ধরা দেয়!
মাটির ব্যাংক কিংবা বাঁশের খুটিতে কয়েন জমিয়ে রাখতাম।
ভোরবেলায় সেই ব্যাংক ভেঙে টাকা গোনার পালা! মাত্র ৭৩ টাকা ৫০ পয়সা। মাত্র নয় তখনকার দিনে এটা অনেক টাকা । আম্মা বলত সব খরচ করবি না ! কায়দা করে সাবান আর তোয়াল কিনতে বলতেন! গোপালপুর মেলা নিয়ে এতটাই উল্লাস উচ্ছাস মাতামাতি ছিল যে স্কুল পিরিয়ড কমিয়ে মর্নিং এ নিয়ে আসা হতো এমনকি মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হতো।
অজস্র মানুষের কোলাহলে ছড়িয়ে ছিল এক অদ্ভুত মাদকতা। সারি সারি কাঠ আর মাটির বানানো রঙিন খেলনা নিয়ে লাইন দিয়ে বসে ছিলেন দোকানিরা। নতুন নতুন জামাকাপড় পরে এসেছে আমারই মতো অনেক বন্ধু। ওদের কারও হাতে ফোলানো বেলুন, কারও হাতে বাঁশি, কেউ কিনেছে রঙিন মুখোশ আবার কেউ কেউ কিনছে নানা ধরনের রংবাহারি খাবার। মাইকে গান বাজছে, আবার মসজিদ মাদ্রাসায় টাকা উঠানোর মাইকের শব্দে একাকার চারদিক।
আমাদের এলাকায় যতগুলি মেলা হতো তার প্রায় সবই ছিল হিন্দু ধর্মের নানান ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত মেলা, কিন্ত এই মেলার জন্য সারা বছরের মধ্যে আমাদের সবার অন্যরকম আকর্ষণ থাকতো। এতো বড় মেলা আর কোন তল্লাটে হতো না। এই মেলা ছিল সার্বজনীন।
মেলার এক কোণে রুম বানিয়ে আমাদের এলাকার শরাফত ভাই লাল-টকটকে অনেক ধরনের ডিম নিয়ে বসতেন সাথে মাছ ভাতের বেশ কয়েক পদও ছিল। ঝুড়ি মোয়া বাতাসা, গুড়, মুড়ি, খই, কদমা আর তিলের খাজা! সারি সারি সাজানো। পাশেই উনুনে ভাজা হচ্ছে গরম গরম পিয়াজো, গুলগুলি আর জিলাপি। চলছে দেদার।
আমি যত এগিয়ে যাই, ততই মন্ত্রমুগ্ধের মতো হারিয়ে যেতে থাকি। একটা বিশাল জায়গা নিয়ে সাজানো হয়েছে অনেক কসমেটিকসের দোকান! ওই সময় ছেলেমেয়েদের জন্য যত খেলনা পাওয়া যেত তার সবই গোপালপুরের মেলায় ছিল! পিস্তল বন্ধুক ঘড়ি ফুটবল আমার জন্য এসব ছিল স্বপ্নের মত! আংটি বাশি সবারই চাই। এ ছাড়া কারুপণ্য, কুটিরশিল্প টাইপের সামগ্রী, সব ধরনের হস্তশিল্পজাত সামগ্রীর দোকানও প্রচুর ছিল। মানুষের ভিড়ে দোকানগুলো ছিল পরিপূর্ণ।
মেলা যদিও আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটা অংশ, তবু মেলাকেন্দ্রিক কিছু সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠছিল তখন। এগুলো আমাদের বিনোদনধারাকে উর্বর করেছে৷ মেলায় কি শুধু জিনিসপত্র বেচা-বিক্রি চলে? অবশ্যই নয়৷ যাত্রা প্রদর্শনী, পুতুলনাচ, পালাগান, কবিয়ালদের আসর, স্বপন ভাইয়ের মোটর সাইকেল খেলা থেকে শুরু করে হেন অনুষ্ঠান নেই, যা দেখা যায় না৷ কারণ, এসব হচ্ছে মেলার বাড়তি আকর্ষণ৷ সবাই তো আর মেলায় কেনাকাটা করতে যায় না, কেউ কেউ এমন নির্মল আনন্দ উপভোগ করতেও সেখানে যায়৷
ছোট্টবেলায় প্রচুর খেলনা বন্দুক-পিস্তল কিনেছি । মাথায় ক্যাপ লাগানো হ্যামার টানা কাঠের বাঁট-ওয়ালা বন্দুক এবং টিনের পিস্তল কিনতাম প্রচুর। টিনের পিস্তল গুলো খুবই শস্তা ছিল । বারুদের স্ট্রিপ প্যাঁচানো থাকতো এই টিনের পিস্তলের মধ্যে, ঠাস ঠাস করে গুলি মারতাম । ধোঁয়ায় ঢেকে যেতো চারিপাশ । আর কিনতাম ক্যাপ লাগানো প্লাস্টিকের রিভলবার । গুলি করলে এই ক্যাপ ছুটে বের হতো বারুদের বিস্ফোরণে । এগুলো বেশ দামি ছিল । পানিতে ছুটে চলত লঞ্চ, এটিও তখনকার দিনে বেশ ডিমান্ড ছিল । চর্কি মেশিন যেটি রশি টান দিয়ে ছেড়ে দিলে চাকাটি দারুন শব্দে উপরে উঠে যেতো। রিমোট গাড়ী আর ড্রোন মেশিনের এখনকার জেনারেশনের যুগে ওসব যেন হাস্যকর॥
প্রচুর পরিমাণে নতুন ফল আসত মেলায়। আম, লিচু, কাঁঠাল, কলা, তালের কচি ডাব এগুলো মেলার গোড়াতেই থাকত। তারপর একটা দ্রব্যের দোকানের পর মিষ্টির দোকানের সারি। সবচেয়ে ভালো মিষ্টি যেখানে তৈরি হয় সেখানকার মালিক এবং কারিগররা এসে মেলায় দোকান বসাত। মুক্তাগাছা টাঙাইলের বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা আসত। পোড়াবাড়ীর চমচম অত্যন্ত বিখ্যাত মিষ্টি ছিল, মেলায় আনা হতো। মিষ্টির দোকানে সব ধরনের মিষ্টি পাওয়া যেতে। বিশুদ্ধ ছানার বিরাট বিরাট রাজভোগ, রসগোল্লা, চমৎকার সব সন্দেশ ইত্যাদির দোকানও বসত।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দর্শনার্থী বাড়তে থাকে। আড়াইটা-তিনটা নাগাদ পরিণত হতো জনসমুদ্রে। আবার বিকাল পাঁচটার পর কমতে থাকত মানুষ। দোকানপাট খোলা থাকত মধ্য রাত পর্যন্ত। রাত ন’টার পর ওখানে থাকত প্রধানত জুয়াড়িরা। মেলার সময় মেয়েরা বাবার বাড়ি আসত, জামাইরা আসত শ্বশুরবাড়ি। জামাইকে নিয়ে মেলায় আসা একটা ছল, না এলে নিন্দা হবে। এবং জামাইকে অবশ্যই মেলায় নিয়ে যেতে হবে। মেলা করার টাকা দিতে হবে আর প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।
খানিকটা পথ পেরোতেই আবারও নানা ধরনের খেলনার সামগ্রী। মেয়েদের জিনিসপত্র। লাল-নীল চুড়ি, ফিতা, জামা—এই সব! দুটো লোক নানা ধরনের ঘুড়ি বিক্রি করছেন। সেই লোক দুটোকে ঘিরে রয়েছে অনেক আগ্রহী ছেলে। বাংলা সিনেমা যুগে মেলায় চারপাচ জায়গায় ভিসিপিও ছিল অনেক চাহিদার! পাগলা রাজা রাঙাভাবী, ভাই আমার ভাই এসব ছবির পোস্টারে ছেয়েছিল সিনেমা হলের মতো। খালার বাড়ী থাকার কথা বলে খালাতো ভাই জাহাঙ্গীরের সাথে সারা রাত ধরে চলত এই সব আনন্দযজ্ঞ এর মাতম!
রাত বাড়তে থাকে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো এক লোক বাঁশি বিক্রি করছিলেন। আর মাঝেমধ্যে একমনে একটা গানের সুর তুলছিলেন—‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি।’ আজ এতকাল পরও মেলা দেখলেই সেই গানের সুরটিই যেন মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।আনমনা হয়ে উঠি! চোখের কোনে পানি জমে! যদি ফিরে যেতে পারতাম বর্নালী সময়ের সেই রঙিন দিনগুলোয়!
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন