হাসি আপুর কথা: চলুন নিজেরা বদলাই

আদনান সৈয়দ
  প্রকাশিত : ২৮ এপ্রিল ২০২০, ১২:২৮
অ- অ+

মেয়েটির নাম রোকসানা। বয়স ১৮/১৯ হবে। আমার মেয়ে চারুলতা তাকে ডাকে রোকসানা আপু। কিছুদিন পর দেখি রোকসানা আপু হয়ে গেছে হাসি আপু। হাসি আপু কেন? জিজ্ঞেস করতেই চারুলতার ঝটপট উত্তর, “রোকসানা আপু সারাক্ষণ হাসে তাই সে হাসি আপু।”

রোকসানার আপুর একটা পরিচয় আছে। এই পরিচয়টা তুলে ধরায় আমার এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য। ইউরোপ আমেরিকায় তাদের বলা হয় মেইড(Maid)। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা তাদের নাম দিয়েছে সারভেন্ট। অর্থাৎ চাকর। আমরা সম্ভবত এখনো ব্রিটিশদের এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছি। এখন আমরা অবশ্য তাদের বিভিন্ন নামে ডাকি। কেউ বলি বাড়িঘরে কাজ করে, কেউ বলে কাজের বুয়া, কেউ বলে কাজের মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি আগেও বলেছি বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ণবাদী/ এবং শ্রেণিবৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে একটি। যারা বাংলাদেশের বাইরে থেকেছেন এবং থাকছেন তারা এই কথাটির সত্যতা বুঝতে পারবেন।( শুনেছি সৌদি আরব নাকি আরো জঘন্য) যে দেশে মানুষ মানুষকে তার কাজের পেশার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে, জাত, বর্ণ, গায়ের রং, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিভিন্ন সূচক দিয়ে মাপে সেই দেশটির মধ্যে বাংলাদেশের নামও পড়ে।

আমি বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের ইনিস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ(২০১৪) এর পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই ধারণাটি তখন আমার বদ্ধমুল হয়েছিল। আমি তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম বাংলাদেশে শ্রম আইন ২০০৬ এর পাতায় পাতায় শ্রমিকদের সব রকম অধিকারের কথা বলা হলেও আদতে তাদেরকে মালিক পক্ষ মানুষ বলেই মনে করে না। আর ঘরের কাজের মেয়ে বা কাজের বুয়ারা কোনো শ্রেণির মধ্যেও পড়ে না।

প্রায় সময়ই পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এদের নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। কেউ তাদের গায়ে খুন্তি দিয়ে গায়ে ছ্যাকা দেয়, কেউ তাদেরকে পিটিয়ে রক্তাত্ব করে। কথা হলো কারা করে এই কাজটি? ঠিক আমার আপনার মতো দেখতে কিছু তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাই। সেদিন দেখলাম এক মানবতাকর্মী তার গৃহকর্মীকে নাজেহাল করার দৃশ্য। ফেসবুকের পাতায় পাতায় সেটি ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এই হলো আমাদের অবস্থা!

অথচ শ্রম আইন বলছে অন্যকথা। আইএলও (ILO) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন গৃহকর্মীকে একজন শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।(সম্ভবত ১৭৬ ধারা) তাদের প্রতিদিনের শ্রম ঘন্টা থাকবে, একটি পরিচয়পত্র থাকবে, বিনোদনের জন্যে নির্দিষ্ট সময় থাকবে, চিকিৎসা সেবা, ভ্রমণ ভাতাও মালিককে নিশ্চিত করার কথা শ্রম আইনের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে। হায়! কিন্তু কে শুনবে কার কথা!

আগেই বলেছি শ্রেণিবৈষম্যের দেশ বাংলাদেশ। যে দেশ খোদ নিজেই শ্রেণিবৈষম্যের ডিপো সেই দেশের মানুষকে আপনি কীভাবে বোঝাবেন এসব কথা? অতএব বোঝানোর একমাত্র পথ হলো আইনের প্রয়োগ। এখন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম থাকার কারণে গৃহকর্মীদের উপর অত্যাচারের খবর বেশি বেশি করে আমাদের সামনে চলে আসছে এবং অপরাধীদের আইনের (?) আওতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আবার আসি রোকসানা প্রসঙ্গে। নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় এসে বাসায় যে বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করি তা হলো রোকসানা নামের এই গৃহকমীটি কেন জানি সোফাতে বসতে চায় না। তাকে জোর করেও বসানো যাচ্ছে না। আমরা যখন ড্রয়িং রুমে টিভি দেখি তখন আমরা সবাই সোফায় আর রোকসানাকে দেখি মাটিতে একটা ছোট লাল রং এর পিড়িতে বসে আছে। তার জন্যে আছে আলাদা বসার জায়গা, আলাদা খাওযার জায়গা এবং ঘুমানোর জায়গা। এই বৈষম্যের প্রথম প্রতিবাদ এল আমার ৬ বছর বয়সি মেয়ে চারুলতার কাছ থেকে। আমাকে সে প্রথমেই বললো, “হাসি আপু কেনো এখানে আমার সাথে বসছে না?” আমি এর কোনো উত্তর দিতে পারি না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে রাতেই আম্মার সঙ্গে কথা বলি।

আম্মা একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। তিনি কেন এই ঔপনেবেশিকি এই ঘৃণ্য প্রথা এই বাসায় লালন করবেন?( তিনি ধার্মীক এবং রবুবিয়ত অর্থাৎ পৃথিবীর সব সৃষ্টি সমান এই ধারণাতেও বিশ্বাসী) খুব ভালো করেই জানি রোকসানাকে সব রকম সুবিধা দেওয়ার পরেও কেন তাকে সোফায় বসতে দেওয়া হবে না। কেন তাকে তার কাজের মর্যাদা দেওয়া হবে না এই নিয়ে আমার লড়াইটা অব্যাহত থাকে। আমার এই লড়াইয়ে যোগ দেয় আমার ছোট ভাই আবীর। সে একজন শিক্ষিত আধুনিক মানুষ। শেষ পর্ন্ত লড়াইয়ে আমাদের জিত হলো। আম্মার মুখ থেকেই কথাটা এল। “রোকসানা তুই এখন থেকে আর মাটিতে বসবি না। সোফাতেই বসবি।” কাল দেখলাম চারুলতার রোকসানা আপু সোফায় বসে আছে। আনন্দে আমার চোখে পানি আসার উপক্রম। একজন মানুষইতো পারে আরেকজন মানুষের অধিকারকে ফিরিয়ে দিতে? আপনিও পারবেন। কাজটি শুরু হোক নিজ ঘর থেকেই। রোকসানাদের জয় হোক।

লেখক সম্পাদক, অযান্ত্রিক

ঢাকাটাইমস/২৮এপ্রিল/এসকেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতায় আরও ৮২ ফিলিস্তিনি নিহত
শরীয়তপুরের বিতর্কিত ডিসি আশরাফ ওএসডি হচ্ছেন
শালিক পাখির প্রেম
কাঁচামরিচের কেজি ১০ টাকা! হতাশ চাষিরা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা