পরকীয়া আসক্তি থেকে বের হওয়ার উপায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:৫১ | প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:৪৯

বর্তমান সময়ে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে পরকীয়া। ব্যক্তির চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চরম রূপ পরকীয়া। পরকীয়া হল বিবাহিত কোন ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকাণ্ড। নারী-পুরুষ উভয়েই পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে শতশত সুখের সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। পরকীয়ার কারণে সংঘটিত হচ্ছে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড।

বিশেষ করে জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষ স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকে। ফলে অনেক সময় তাদের স্ত্রী পরকীয়া, অবৈধ সম্পর্ক ও যেনা-ব্যভিচারে জড়িত হয়ে পড়ে। স্ত্রী থেকে দূরে থাকা স্বামীর বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ আছে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী দুজনে কাছাকাছি থেকেও তাদের মনের দূরত্ব এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

পরকীয়া মানবসমাজে লঘু বা গুরুভাবে নেতিবাচক হিসেবে গণ্য। পাশ্চাত্য আধুনিক সমাজে এর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলেও এটি আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন।

তবে ইসলামি রাষ্ট্রসমূহে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা হল পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড প্রদান। মনোচিকিৎসায় একথা স্বীকৃত যে, পিতামাতার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষন্নতার ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে।

পরকীয়ার মূল কারণগুলো হলো নৈতিক শিক্ষার অভাব, পরস্পরে ভালোবাসার অভাব, অবাধে মেলামেশা করা, অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়া। এছাড়া পরকীয়ার অন্যান্য কারণগুলো হলো- অতিরিক্ত যৌন চাহিদা, পারিবারিক কলহ, একঘেয়ে সম্পর্ক, অপূর্ণ প্রত্যাশা, অসুস্থতার কারণে স্বামী-স্ত্রীর একজনের সেক্স না থাকা, আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা, পুরনো অভ্যাস, মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণ, ডিআরডিফোর জিন, মানসিক সমস্যা, সঙ্গীর উদাসীনতা, পশ্চিমা সংস্কৃতি, শখ থেকে পরকীয়া, দূরত্ব ও শূন্যতা, স্ত্রী দূরে গেলে, সন্তান হওয়ার পর।

বিশেষজ্ঞদের মতে পরকীয়া আদতে ‘আসক্তি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের মতে, চলমান কোনো সম্পর্কে টানাপড়েন চললে মানুষ মুক্তির জন্য আবেগ-তাড়িত হয়ে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে চান।

এভাবে কিছু পথ চলার পর অনেকেই নিজের ভুল বুঝতে পারে। বের হতে আসতে চান পরকীয়া থেকে। তবে কেউ কেউ চাইলেও বের হতে পারেন না। কিন্তু কিছু কৌশল অবলম্বন করলে, নিজেকে এই পরকীয়া থেকে বের করে আনতে পারবেন।

সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার পরকীয়া বিশারদ রেস ডেভিস (৪৩) বলেন, পরকীয়া আদতে ‘আসক্তি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনও সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, কোনও বেদনা ভোলার জন্য, অফিসে অতিরিক্ত কাজের চাপ কিংবা পরিবারে কোনও সমস্যা হলে দম্পতির এক জন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন।

যারা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন, তাদের সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন রেস। দাম্পত্যে কোথায় গলদ হচ্ছে তা বোঝা বেশ মুশকিল। রেসের মতে, ‘‘আমি স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারি। বিয়ের বাইরে অন্য কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। তৈরি হয় আসক্তি! ব্যক্তির মস্তিষ্কে ডোপামাইন নামক রাসায়নিকের ক্ষরণ হয়, যা আসক্তির মূল কারণ।

তিনি বলেন, আমি দম্পতিকে সত্য কথা বলি। যিনি ধোকা দিচ্ছেন, তাকেও সত্যটা দেখাই এবং যাকে ধোকা দেওয়া হচ্ছে, তাঁকেও সত্য বলি। যখন কেউ পরকীয়ায় জড়ান, তখন তাঁর মনে হয়ে আমি আমার স্ত্রী বা স্বামীকে আর ভালবাসি না! অথচ মনের কুঠুরিতে ভালবাসা কিন্তু থেকেই যায়। আমি সেই ভালবাসার কথাই ওদের মনে করিয়ে দিই।

রেসে বলেন, তখন আমি কোনও মনোবিদের কাছে যাইনি। নিজেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। ভাগ্যবশত আমার বন্ধুরা আমাকে পরকীয়া থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন। তারাই আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, আমি ভুল কাজ করছি। তার পর আমি এই নিয়ে নানা পড়াশোনা করি। বুঝি, একমাত্র লোকের সঙ্গে কথা বলেই এর সমাধান সম্ভব। তাই আমি দম্পতিদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের সমস্যা শুনি, তার পর সমাধান দিই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একবার পরকীয়ায় জড়ালে সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার সব পথ দুর্গম হয়ে যায়। আর সম্পর্ক ফাঁস হয়ে গেলে তো ক্ষণিকের ভুল সিদ্ধান্ত সারা জীবন কাঁধে বয়ে বেড়াতে হয়। তাই সুখী দাম্পত্য চাইলে পরকীয়ার সম্পর্কে না জড়ানোই ভালো।

বিবাহিত জীবনে একবার অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা থেকে মুক্ত হওয়া সহজ কাজ নয়। তারপরও যারা এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। অনেকেই আবার এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে সুখী দাম্পত্য জীবনে ফিরে যেতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। জেনে নিন পরকীয়া আসক্তি থেকে বের হওয়ার উপায়-

পরকীয়া থেকে দূরে থাকতে আলোচনা করুন

কেন পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আগে সেই কারণটা বোঝার চেষ্টা করুন। এরপর দু’জনে আলোচনার মাধ্যমে ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেই বিশেষ সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। আপনার আচরণ, কথা সব কিছুতেই যেন ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে । কারণ অনেকই আছেন যে মুখে বলে ভালোবাসে কিন্তু কাজের সময় দেখা যায় সঙ্গীর কথার কোন মূল্যায়ন করে না। কাজেই স্ত্রীকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসুন। স্ত্রীকে পরকীয়া থেকে বাঁচতে এবং একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন এবং শান্তিপূর্ণ সংসার পেতে সঙ্গীর চাহিদার মূল্যায়ন করুন। সে ক্ষেত্রে দুজনে আলোচনার মাধ্যমে সেই বিশেষ সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। এতে সুখী দাম্পত্য সহজেই ফিরে আসবে।

সঙ্গীকে পরকীয়ার বিষয়টি জানান

অনেকেই পরকীয়ার বিষয়টি সঙ্গীকে জানাতে চান না। তারা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে বিবাদ আরও বাড়বে। এতে কিন্তু ভবিষ্যতে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হয়। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকলে স্থান-কাল-পাত্র বুঝে সঙ্গীকে গোটা বিষয়টি খুলে বলে দিতেই পারেন। কারণ অন্য কারও থেকে ব্যাপারটা জানলে তা আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।

ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন

পরকীয়া ভেঙে বেরিয়ে আসতে হলে সবার আগে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আপনাকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি সত্যিই সম্পর্ক শেষ করতে চান তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করুন। চাইছেন, অথচ বার বার ফিরে এসে সময় নষ্ট করছেন এমনটা হলে কিন্তু পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। দেরি না করে তাই আপনার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিন।

পরকীয়ায় জড়ানো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন

একবার পরকীয়া থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেই নারী বা পুরুষের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে অবশ্যই সম্পর্কে ইতি টানার কথা তাকে সোজাসুজি জানিয়ে দিন। আবেগপ্রবণ হয়ে কোনোভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করাই ভালো। বরং সংসার ও কাজে মন দিন। কাজটি কঠিন হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আপনিই সফল হবেন।

সঙ্গীকে নতুনভাবে ভালোবাসুন

নিজেদের মধ্যে কথা বলে সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করুন। যেই কারণেই আপনি পরকীয়া তে জড়িয়ে পড়েন না কেন তা শুধরাবার চেষ্টা করুন। সঙ্গীর বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করুন। তার জন্য সবসময় সত্য কথা বলুন ও সৎ থাকুন। আপনার স্বামী বা স্ত্রীর আপনার জন্য কী করেছেন ভাবুন। পরিবারে নিজের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করুন। নতুন দায়িত্ব নিন। এতে আপনাদের সম্পর্ক আবার আগের মত ভালো হয়ে যাবে।

ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি সামলান

স্ত্রী অথবা স্বামীর মধ্যে যিনি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন, তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। অন্য সম্পর্কে জড়ানোর সমস্ত দায় তার ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। এমনটা হলে কিন্তু পরকীয়ায় ইতি টানার উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না। বরং কেন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেই বিষয়টি নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। দুজনকেই ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিষয়টি সামলাতে হবে।

বিশ্বাস রাখুন ও উপহার দিন

অনেক সময় দেখা যায়, পরকীয়া সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরও সঙ্গীর প্রতি সেই বিশ্বাসটা আর ফেরে না। তাই উলটো দিকের মানুষটার মনে সারাক্ষণ সন্দেহ থেকে যায়। তাই নতুন করে তার বিশ্বাস অর্জন করা জরুরি। স্ত্রী বা স্বামীকে নানা ধরনের সারপ্রাইজ দিয়ে, ভালোবাসায় ভরিয়ে সেই ভাঙা মনকে জোড়া দেওয়ার কাজটিও করতে হবে অত্যন্ত নিপুণ হাতে। এতে করেই সুখী দাম্পত্য আবারও ফিরে আসবে।

ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন

পরকীয়া রোধে সৃষ্টিকর্তার ভয় অন্তরে রাখুন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন। কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ সমাজে অপরাধ কমিয়ে আনে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হয়। ইসলামে পরকীয়া-ব্যভিচার অবৈধ সম্পর্কে নারী-পুরুষের মেলামেশাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাইকেই চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, তোমরা জিনা বা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। এটি অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য আচরণ (সূরা বনি ইসরাইল-৩২)।

(ঢাকাটাইমস/৭ ডিসেম্বর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :