নাটক

দস্তয়েভস্কির দ্যা জেন্টেল স্প্রিরিট গল্প অবলম্বনে: ভাসানে উজান

নাট্যরূপ: অপূর্ব কুমার কুণ্ডু
| আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:১৫ | প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৭

দৃশ্য: ১

[মঞ্চে সেকেন্ড উইংস ধরে দুটি ঘর মিলে এক অখণ্ড বাড়ি দর্শক অভিমুখে অভিনেতার সাপেক্ষে বাঁ পাশটি বসতঘর আর ডান পাশটি বন্ধকের ঘর বন্ধকের ঘরের সম্মুখ প্রান্তের ডান পাশের দরজা লোহার গ্রিল আর বাঁ পাশের বৃহৎ জানালাও লোহার শিক বন্ধক ঘরের মাঝে উপর থেকে ঝুলেপড়া ঢাকনা চাকতির তলে পাঁচশ পাওয়ারের হলদে বাল্ব তার নিচে ব্রাউন কাপড়ে ঢাকা চওড়া টেবিল টেবিল ছুঁয়ে গদিওয়ালা রোলিং চেয়ার দেওয়ালের অংশে মধ্যবর্তী জায়গা থেকে তারকাঁটায় ঝুলছে একটি লম্বা নিঃসঙ্গ গাউন আকৃতির লম্বা কোট কোটের ঝুলন্ত তারকাঁটায় একটা নজেল টুপি একটু দূরে বৃহৎ আকারের কালচে সিন্ধুক সিন্ধুকের বুক বরাবর স্টিয়ারিং আকৃতির লোহার গোলক সিন্ধুকের আড়ালে দোনলা বন্ধুকের সামান্য অংশ দৃশ্যমান বন্ধুকের নলে গেঁথে আছে প্লাস্টিকের সূর্যমুখী ফুল দেওয়ালের কয়েকটি অংশে বক্স আকৃতির ছোটো ছোটো খোপে কাস্টমারদের বন্ধকি স্বর্ণ-রুপা-তামার অলংকারাদিসহ অন্যান্য উপকরণ অপরদিকে বসতঘরে দর্শক অভিমুখে অভিনেতার বাঁ পাশে মঞ্চের তৃতীয় উইংস ছুঁয়ে একটি নীলাভ বেডশিটের আরামদায়ক বিছানা বিছানায় সাইক্লোরমা প্রান্তে ডবল বালিশসহ কোল বালিশ বিছানার শেষ প্রান্তে একটি বইয়ের শেলফ যেখানে বেশকিছু বই দৃশ্যমান বইয়ের শেলফের উপরে দুটো ছবিতে রবীন্দ্রনাথ এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়র দৃশ্যমান বিছানার পাশে একটি রোলিং চেয়ার একটু দূরে একটু উঁচু বেদিতে একটি জল রাখার মাটির কলসি কলসির মুখের ঢাকনার উপর উপুড় করে রাখা তামার ঘটি একটু পাশে একটা পাঁচ বাটিওয়ালা টিফিন ক্যারিয়ার বসতঘরের সম্মুখ প্রান্তে একটি কল রেডিও বসতঘর এবং বন্ধক ঘরের মাঝের দেওয়ালটি ট্রান্সফারেন্সি গ্লাস আকৃতিরÑ যা আগপিছু করে দু ঘরকে এক আবার আলাদা করা চলে বন্ধক ঘরে টেবিলে পা তুলে, ঘর অন্ধকার করে, গদি চেয়ার মুখ-মাথা টুপিতে ঢেকে বসে আছেন পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব আশরাফ বোয়ারী বন্ধকের ঘর ডিম লাইটের আলোয় আলো আঁধারী হলেও বসত ঘরে একটা মিষ্টি আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে কল রেডিও কল রেডিওতে বেজে চলছে ঝুমা সরকারের কণ্ঠে একটা গান গানের কথা-সুর ও গায়কীতে শ্রুত হচ্ছে, ‘দিন রজনী চোখের পানি ঝরেছে অবিরাম/প্রাণ সখা পাব দেখা কোথায় গেলে বল...’ গানের সুর গায়কীতে নিমগ্ন আশরাফ বোয়ারীর বন্ধকের দোকানের সম্মুখ বাইরের অংশের জানালার গ্রিলের সম্মুখে তাড়ি মদ খেয়ে টলতে টলতে এসে দাঁড়ায় সুগার হানি টি বাগানের ম্যানেজারের বোতল সাপ্লায়ার ভেটকী সর্দার ভেটকী সর্দারের গোভানী চিৎকারে পরিবেশ থমথমে কথা শোনা যায় না কিন্তু গালাগালির বেসুর শ্রুত হয় শব্দদূষণে বিরক্ত আশরাফ বোয়ারী চেয়ার ছেড়ে ট্রান্সফারেন্সি গ্লাস সরিয়ে বসতঘরে ঢুকে কল রেডিও বন্ধ করে পুনঃগ্লাস টেনে বন্ধকের ঘরে এসে গ্রিল জানালার ভেতরের পাশে মুখ বাড়িয়ে দাঁড়ায় গান বন্ধ হওয়ায় এবং আশরাফ বোয়ারীর মুখ দৃশ্যমান হওয়ায় এবারের ভেটকী সর্দারের গালাগালি কথন শ্রুত পরিপক্ব হওয়া শুরু হয়]

ভেটকী সর্দার: আমি শালা ডগরা না যে জলের উপরে উপরে ভাসি শালা আমি পুঁটি না যে ঝিলিক মেরে ছুটি আমি শালা ভেটকী গভীর জলে থাকি ডগরা পুটি ধরি আর গিলি আমি শালা ভেটকী, ভেটকী সর্দার সুগার হানি টি বাগানের ম্যানেজারের বোতল সাপ্লায়ার আমি ভেটকী সর্দার আর আমার চায়ের বাগানে বসে তুই শালা করিস বন্ধকের কারবার তুই এত বড়ো বাটপার তুই আমার সাথে করিস টাউটামির কারবার বের হ তুই শালা সুদখোর, হারামখোর, তোর সুদের ব্যবসা করা আমি ছুটাচ্ছি তোর এত বড়ো স্পর্ধা, তুই আমার জাঁদরেল বউ-এর হাতের বালা জোড়া টেনে হিঁচড়ে খুলে তুই তোর ঐ সিন্ধুকের পেটের মধ্যে ভরে ফেললি তোর এত বড়ো স্পর্ধা, তোর ঐ সিন্ধুকের পেট তো শাবল দিয়ে ফুটো করবো সেই সাথে তোর পেট চিড়ে ভুড়ি বের করে আমি আমার পোষা কুকুর ট্যাকলারে দিয়ে খাওয়াবো ঐ হারাম খোর তুই কি মনে করিস তোর টাকারে আমি গুণি তোর টাকারে আমি মুতি শালা বার কর আমার বউয়ের বালা কত বড়ো স্পর্ধা, হাত থেকে টেনে হিঁচড়ে বালা বের করে তোরে বালা না, বালা গলায়ে বার্লি দিয়ে খাওয়াব মেয়েটার আমার কাল বাদে পরশু বিয়ে এত বড়ো জামাই, তিন তলায় ঘুমায়, পথ চলে চার চাকার দোলায় জামাই মেয়ের খাট পালঙ্ক সাজাব বলে কয়ডা টাকার দরকার তাই বলে তুই মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে আমার বউ-এর হাত খালি করলি ঐ বন্ধকের বাচ্চা তুই আগে এই খাচা থেকে বের হ তোর পেছনে বল্লম দিয়ে আমি যদি তোকে সরকার বাড়ির সামনের চৌরাস্তায় দাঁড় না করাই তবে আমি আমার বাপের বেটা না আগে তুই বের হ এ পিছাবি না আগে তোর কল্লা ধরবো তারপর তোকে বরিক পাউডার দিয়ে কাঁচবো গ্রিলের ভেতর গদি চেয়ারে বসা মারাও ভাব আমি ফাঁক গলে ধরতে পারবো না আমি আজকের এই রাত থেকে কালকের সন্ধ্যা পর্যন্ত এই গ্রিল বন্ধকের সামনে বকের মতো ধায় একপায় দাঁড়িয়ে থাকবো এক না এক সময় তোকে বের হতেই হবে তখন এই ঝামা ইট দিয়ে ঘসবো পাহাড়ি মাটির ইট তোর মাথা ভাঙবে কিন্তু ইট ভাঙবে না মাথা যদি ভাঙতে আমাকে বাধ্য না করিস, তোর হিসেবি মাথা যদি তুই হিসেব করি বাঁচাতে আমার পা ধরিস তবে ভালোয় ভালোয় আমি না চাইতেই আমায় জোর করে বালা জোড়া দিবি, সাথে চা জল খরচার সাথে সাথে ঘোড়ার গাড়ির যাতায়াত ভাড়া দিবি না হলে আগে তুই বাইর হ দেখবো তোর না আমার, কার দম কতখানি হারাম খোর আমার বউ-এর বালা খুলে নিস বালা যদি আমি তোর পিছন দিয়ে না ভরি... বালাতো আমি নেবই আর সেই সাথে চা শ্রমিকদের মহল্লায় তোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে তোকে দিয়ে তোর মরা বাপ-মার বিয়ে আরেকবার পড়াব আর আমি ভেটকী সর্দারের ছিটানো তাড়ি মদে তোরা তোদের পেট ভরবি কুত্তার বাচ্চা বাইরে আয় বাইরে আয়, আজ হয় সোনার বালা দিবি না হয় তুই ঐ দুইশো পাওয়ারের বাল্ব হয়ে জ্বলবি [আশরাফ বোয়ারী সব কথা শুনে দুনলা বন্ধুকটা নিয়ে গ্রিলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে কথা বলা শুরু করে]

আশরাফ বোয়ারী: ডগরা না পুঁটি না ভেটকী, ভাসিস না ঝিলিক দিস না শুধু ধরিস আর গিলিস গলা দিয়ে শাসন করিস আমারে ভয় দেখাস আরে আমি কি তোর কেনা গোলাম, বললি আর মেনে নিলাম তোর কি মনে হয় ও যা আমিও তাই তুই আর আমি যে এক না আয় তা মিলাই তুই আমাকে তিনশ শব্দ বানে ঘায়েল করতে চাইলি না দেখ আমি করবো বলছি না সরাসরি করেই বলছি তোর থুতনি আমার হাতের মুঠোয়, মারলাম ধাক্কা চিত হয়ে মাটিতে পড়লি এবার এক হাতে তোর চুলের মুঠি ধরলাম আর এক পা দিয়ে তোর বুক চেপে ধরলাম এবার তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে বউ-এর বালার জন্য স্বামী হিসাবে তোর যখন এত দয়া তাহলে প্রতি রাতে তাড়ি খাওয়ার আগে এক প্রস্থ আর তাড়ি খাওয়ার পর আরেক প্রস্থ বউ-এর গায়ে হাত তুলিস কেন? নেশার খরচের টাকার জোগান দিতে না পারলে বউকে রেড লাইট এরিয়ায় খদ্দেরদের কাছে নাইট শিফট ধরে ধরে বেচবি বলিস কেন? তুই তোর ম্যানেজারির বোতল সাপ্লায়ারের বেতন পেয়ে সংসারে ব্যয় না করে জুয়া আর ধোয়ায় উড়াস কেন? নেশার সঙ্গীদের কাছ থেকে ধারে টাকা নিতে তুই তোর যুবতী মেয়েটাকে ঐ সব জন্তুর সাথে ঘুরতে যেতে বাধ্য করতে চাস কেন? বউয়ের গলার হার, নাকের নোলক, কোমর বিছা, হাতের আংটি, সব বেচে শেষ করে এই বালা জোড়া আয়ত্তে নিতে না পেরে বউকে সাত-সাতটা সিগারেটের ছ্যাকা দিলি কেন? মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিতে লাগবে পঁচিশ হাজার তোর স্ত্রী’র একমাত্র অবশিষ্ট অবলম্বন ঐ একজোড়া বালা ব্যবসায়িক হিসাবে আট আনা সোনার জোড়া বালার দাম কিছুতেই হাজার বিশেকের বেশি না ক্ষয়িষ্ণু বেদনামাখা এক মায়ের সাথে মুখ জুড়ে বেদনামাখা মুখাবয়বের কন্যাকে দেখে এবং সব শুনে ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতির হিসাব না কষেই সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছি যেন অবলা নারীটি স্বামীর সুরক্ষা পায় কিন্তু তার বিপরীতে এই প্রাপ্তি? মাঝ রাত্রে এসে আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে থ্রেট? আমাকে হুমকি-ধামকি? যদি তোর স্ত্রী এবং কন্যা আমাকে বালা জোড়া দিয়ে বারংবার সতর্ক করে বলেছিল, তোর কারণে আমাকে পোহাতে হবে হাঙ্গামা তোর স্ত্রী তো তোকে জানে যে তুই কেমন স্বামী কন্যা জানে তুই কেমন পিতা তারা বলেছিল, মগডালে পাখির শাবক থাকলে সাপ যেভাবে মগডালে পৌঁছায়, চিনি থাকলে পিঁপড়ে যেমনভাবে পৌঁছে যায় পাহাড়ে তেমনি জোড়া সোনার বালার ঘ্রাণে চান্দু তুমিও আসবে এবং তুই শালা সত্যিই সত্যিই এলি যথার্থরূপেই এলি তোর এতক্ষণের হুমকি-ধামকি সব নীরবেই মেনেছি কিন্তু তুই যখন আমাকে দিয়ে আমার মরা বাপ-মায়ের বিয়ে পড়াবি বললি তখন আর পারলাম না পারলাম না বিবেকের বাঁধ দিয়ে ধৈর্যের ঢেউকে সামাল দিতে আয় এবার হয়ে যাক বোঝাপড়া তুই কি ভাবিস আমি তোর স্ত্রীর মতো সর্বংসহা? না রে, আমি হলাম তোর মতো চামারের চামার তোর মতো চামার কিন্তু চামারের বাপ তোদের মতো চামার আমি দিনে রাতে দশটা পুষি সকালে কোলে তুলি আর রাতে পাছায় লাথি মারি তোর মুখে বুলি বেশি মুখমণ্ডলে মুখটা বাদে আর সব বেশি বেশি দুই চোখ, দুই কান, দুই নাকের ছিদ্র শুধু মুখ একটা একটা মুখ তোরে মানায় না আরেকটা মুখ তোর দরকার নে গাল হা কর এই পিস্তলের নলে, তোর মাথার সোজা পিছনে আরেকটা গাল হবে হা কর কুত্তার বাচ্চা হা কর মুখের বুলির স্বার্থে একটা গাল তোকে মানায় না

ভেটকি সর্দার: মানায় বন্ধক ভাই মানায় আমার নেশা কেটে গেছে বন্দুকটা সরিয়ে নেন বন্ধক ভাই, বন্দুকটা সরিয়ে নেন এতক্ষণ যা যা বলেছি তার একটা কথাও আমার না সব কথা ঐ পচা তাড়ি মদের ছি ছি ছি পার-মাতালদের জন্য সমাজ সংসারে সব ছারখার হয়ে গেল আমি পুরুষ মানুষ জোড়া কী বিজোড়া বালা তা দিয়ে আমি কী করবো আমি কি মেয়ে মানুষ যে স্বর্ণের বালার জন্য পাগল হব হাতে পরে ঘুরে বেড়াব আমার হাত হলো সমাজের মানি-গণ্যি মানুষদের পদসেবার জন্য বন্ধক ভাই পচা তাড়ি মদের নেশা আমার কেটে গেছে পচা তাড়ি মদের নেশায় যা যা বলেছি তার সব দায় ঐ তাড়ি মদের এর সাথে আমি ভেটকি সর্দারের কথার কোনো মিল নেই ডগরার জলে ভাসা, পুঁটির ঝিলিক মারা এসবই আমার ভালো লাগে বলেই তো আমি জলের গভীরে ভেটকি মেরে পড়ে থাকি বন্দুকটা সরান আর আপনার পদ যুগলদ্বয় আমার দিকে বাড়িয়ে দেন এই পা ছুঁয়ে বলছি, বাড়ি যাব, কাঁচামরিচ দিয়ে ডগরা মাছ ঝোল করবো আর সরষে তেলে পুটি মাছ ভেজে আপনার জন্যে আমি আনবোই আনবো তবেই আমার নাম ভেটকি পচা তাড়ি মদের কারণে আমার কথায় আপনার মাথায় টক্সিন বেড়েছে ঐ টক্সিনকে ট্যাঙ্গানো আমার দায় বন্ধক ভাই, আমি ভদ্র ঘরের সন্তান সামনে এগুচ্ছি, পেছন থেকে ডাকবেন না ভাই আর বন্ধক ভাই, ঐ দুনালা বন্দুক আর তাক করবেন না গাল বাড়াতে হবে না কবিরাজ বলেছে, মদের কৃপায় আমার হার্টে ইতিমধ্যে অতিরিক্ত দুটি ছিদ্র অহেতুক বুলেট ব্যয় করে আর কী দরকার জিনিসপত্রের এত দামের মধ্যে অহেতুক অপচয় মানায় না টানাটানির সংসারে পাছে খরচা হয়ে যায় তাই বউ আমার সোনার বালাজোড়া এনে আপনার সিন্ধুকে জমা রেখে গেছে- এতেও কি বোঝেন না বন্ধক ভাই, ঘরে যান রাত বিরাতে ঘরের বাইরে আসা একদম আপনার মানায় না যা দিনকাল রাতে বের হবে চোর-বাটপার আর নেশাখোর আপনার-আমার মতো ভদ্র লোকের রাতে ঘরের বাইরে বেরোনো একদম মানায় না যান বন্ধক ভাই ঘরে যান আমিও বাড়ি যাচ্ছি বউটা আমার লক্ষ্মী আমার ফেরার বিলম্বে সে স্থির থাকতে পারে না ভেটকির বটে চিন্তায় চিন্তায় শুঁটকি হোক এ নিশ্চয়ই আপনি চান না যান বন্ধক ভাই ঘরে যান, আমার জন্য ভাববেন না সোজা বাড়ি যাবার পথে পেলে খেলাম, না পেলে না খেলাম আমার জন্য ভাববেন না বন্ধুকটা নামান ভয় করে হার্টে দুটো ছিদ্র তো তাই চললাম বন্ধক ভাই এই পা দুটোর যত্ন নেবেন কেউ রাগালেও জুতো খুলে খালি পায়ে বাইরে আসবেন না বন্দুকের গুলি তাক করে মাথায় আর দাঁড়াশ সাপের ফনা তাক করে পায়ের পাতায় আমরা যদি ভাইয়ে ভাইয়ে ভাইকে রক্ষা না করি তাহলে কীভাবে একে অপরকে বাঁচাই যান বন্ধক ভাই আপনি ঘরে ফেরেন আর আমি বাড়ি ফিরি আমি আসি

[ভেটকি সর্দার পালানো পালানো ভঙ্গিমায় পালিয়ে যায় আর আশরাফ বোয়ারী ধীর লয়ে বন্ধকের গ্রিল দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঝুলন্ত দুই‘শ পাওয়ারের বাল্বটি জ্বালিয়ে টেবিলে বন্দুকটি রেখে কথা বলা শুরু করে]

আশরাফ বোয়ারী: (দুনলা বন্দুকটির সাথে কথোপকথনের ভঙ্গিমায়) দুই নলা বন্দুক আমার বাংলাদেশ সরকারের রেজিস্ট্রার্ট বন্দুক এই যে আপনি যদি মদের বার চালান কিংবা আমার মতো বন্ধকীর কারবার করেন তবে আপনাকে আত্মরক্ষার জন্যই লাইসেন্স করা আর্মস রাখতেই হবে বিপদে পড়ে টাকার জন্যে দামি জিনিস বন্ধক রাখবে, বিপদ উতরে গেলে টাকা ফেরত ছাড়াই বন্ধকের জিনিস কেড়ে নিতে চাইবে তখন? টাকা ফুরিয়ে গেলেও মাতাল মদের দোকানে আসবে তার তখন চাই আরও গ্যালন কি গ্যালন বোতল মদ তখন? তখনই এই লাইসেন্স করা এই দোনলা বন্দুকটা বড়ো বেশি প্রয়োজন হয় ভয় ছাড়াও নচেৎ ভীত হও ভীত হলে ব্যবসা তো লাঠে উঠবেই সেই সাথে পাততাড়ি গোটাতেও হবে আর ভয় ছড়াতে জানলে তোমাকে মানুষ কম ঘাটাবে প্রবাদের লিস্টে কি কথা এমনি এমনি ওঠে মানুষ কি এমনই এমনিই বলে- শক্তের ভক্ত নরমের যম ভেটকী সর্দারের কত হুমকি-ধামকি আমাকে পারলে দুইপা ধরে ছিড়ে ফেলে কিন্তু যেই না দুনলা বন্দুকটা ওর মাথায় ঠেকিয়েছি অমনি প্রথমে থতমত, তারপর ভীত, আর সর্বশেষে পা জড়িয়ে ধরে কোথা থেকে কোথায় চলে গেল বন্দুকের নলে সব সমাধান হয়ে গেল ভয় দেখিয়েই ভয়কে জয় করতে হয় লোককে ভয় দেখাতে না জানলে আমার ব্যবসায় লস, ব্যবসায় লালবাতি ভয় দেখানোর জন্য, ভয় পাওয়াবার জন্য আমার সাধের পিস্তল আমার ভালোবাসার পিস্তল বিপদে যে দেয় পরিত্রাণ তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায় বল পিস্তল বল

[আশরাফ বোয়ারীর কথার সূত্র ধরে অতীত স্মৃতি ফিরে আসছে]

পিস্তল দুনলা পিস্তল কিন্তু বন্দুক আমার, এই জীবন তো আমি স্বেচ্ছায় বেছে নেইনি এই জীবনে তো আমায় জোর করে ঘাটে নৌকা বাঁধতে হলো আমার তো আজীবনের স্বপ্ন ছিল নাটকীয় জীবন নাটকের জীবন জীবনের ঊষালগ্ন পেরিয়ে আমি তখন টগবগে যুবক বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ভাবছি, যা কিছু বলার যা কিছু করা তা নাটকের মাধ্যমে করবো, নাটক লিখে, নাটকের রিহার্সেল করিয়ে, নাটক মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে দর্শক- শ্রোতাদের তৃপ্তির রসাস্বাদনে ভাসিয়ে ভাসিয়ে উজানমুখী করবো দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনাময় মানবজীবনের অলি গলি পার করে সুখ-আনন্দ-প্রাপ্তির রাজপথে পৌঁছে নেব বেহুলার ভাসান দেখাতে দেখাতে লক্ষীন্দরের জীবন ফিরিয়ে নেব নাটক করবো অথচ নাটকের দল হবে না- এ কেমন কথা দল প্রতিষ্ঠা আমিই করলাম দলের নাম দিলাম ‘ভাসানে উজান’ ভেসে ভেসে উজানের দিকে চলাই আমাদের লক্ষ্য বিনিদ্র রজনী জেগে নিত্য নতুন বিষয়ে নাটক লিখছি সন্ধ্যায় ডালপুরী আর লিকার চা খেয়ে রিহার্সেলে নির্দেশনা দিচ্ছি দল তরতরিয়ে এগুচ্ছে বাহাবা পাচ্ছি কল শো পাচ্ছি, টাকা পয়সাও জমছে দলে অভিনেতা-অভিনেত্রী বাড়ছে দলের প্রধানতম অভিনেতা মাথায় ঝাকড়া চুল, ঘিয়ে রঙের গড়ন, কেন্দ্রীয় চরিত্রে মানানসই অভিনেতা সাইফুল খান সঙ্গে প্রধানতম অভিনেত্রী কুসুম কলি আহা কী মাদকতা যখন অভিনয় চলে, যখন হেলে দুলে মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশ যায় তখন দর্শক সারিতে কী উল্লাস দলের ভরকেন্দ্রে তখন সাইফুল খান আর কুসুম কলি আমার লেখা নাটক রাজা হরিশচন্দ্র নাটকের রাজা হরিশ চন্দ্র হয়ে অভিনেতা সাইফুল খানের সে কী বানের তোড়ের দুর্দান্ত অভিনয়, [জোনের ধরা আলোয় সাইফুল খান চরিত্র রাজা হরিশচন্দ্র চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে]

হরিশচন্দ্র রূপী সাইফুল খান : শৈবা, তাহলে আর কেন বাঁচি, কীসের মোহে, কীসের টানে! আমাদের তো সবই গেল দিতে চাওয়া কি অপরাধ ছিল বিরাট কিছু না, সামান্য কিছু দিতে চাওয়া কি অপরাধ ছিল শৈবা তুমি বল শৈবা আমরা তো কারও জিনিস কেড়ে নিইনি তবে আমাদের এমন কেন হলো! ভগবান আমাদের এমন কেন করলেন আমি তো রাজা ছিলাম প্রজাকে দেওয়া তো রাজধর্মের মধ্যেই পড়ে, বলো পড়ে না তুমি শৈবা তুমি তো জানো, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় দ্রৌপদী যখন কৃষ্ণকে বলছে, ‘হা কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ! তোমার ভক্তের লজ্জা হরণ হচ্ছে আর তুমি ভগবান, স্বয়ং ভগবান হয়ে তা সইছ তুমি নিশ্চুপ, স্থির মূর্তির মতো হয়ে থেকো না তোমার ভক্তের সম্ভ্রম রক্ষা করো ভগবান তো তখন থেমে থাকেননি শুধু দ্রৌপদীর কাছে একবার জানতে চাইলেন, ‘সখে তুমি জীবনে কাউকে কি কখনো বস্ত্র দান করেছ’ দ্রৌপদী বললেন, ‘হ্যাঁ কৃষ্ণ, একবার এক সাধুর কৌপিন নদীর জলে ভেসে গেলে আমি আমার আঁচল ছিড়ে তার কৌপিন করে দিয়েছিলাম’ কৃষ্ণ বললেন, ‘দ্রৌপদী তোমার তাহলে আর ভয় নেই তোমার বস্ত্রের অভাব পড়বে না তুমি সুরক্ষিত থাকবে’ দানের পুরস্কার যদি ভগবান দিতে পারেন তবে আমাদের এমন কেন হলো মুনি বিশ্বামিত্র রাজ্য চাইলেন রাজ্য দিলাম, দানের দক্ষিণা দিতে হয় কিন্তু রাজ ভান্ডারে তো আমাদের আর অধিকার নেই দক্ষিণা কোথায় পাই, থাকবই বা কোথায়, স-সাগরা মতে রাজ্য দান স্থান জুটল এই কাশীধাম, মহাদেবের স্থান মাত্র ১ বৎসর সময়; এর মধ্যে দক্ষিণা জোগাড় করে বিশ্বামিত্র ঋষিকে দিতে না পারলে যে দানাপরাধে আজীবনের নরক বাস ১ বৎসরে দক্ষিণা জোগাড় যে অসম্ভব ছিল শৈবা তুমি বিক্রি হলে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছে, মাতৃস্নেহ তুমি এক মুঠি অন্ন ছেলে রোহিতস্যকে নিয়ে খেয়ে জীবন কাটাচ্ছিলে তোমার বিক্রির টাকা হাতে পেয়েও দক্ষিণার মোট টাকা হতে তখনও কিছু বাকি তাই আমি নিজে যে রাজা ছিলাম, পৃথিবীর রাজা সেই আমিই কিনা নিজেকে বিক্রি করলাম এই শ্মশানের চণ্ডালের কাছে দাস রূপে, এই জন্যই তো যে আমি বিশ্বামিত্রের কাছে যেন দান প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি কিন্তু তার এই পরিণতি! দিবা-রাত্রি শ্মশানের ঘাটে মরা আনছি, মরা পুড়াচ্ছি, যৎসামান্য যে টাকা পাচ্ছি তা সঞ্চয় করছি তবু টাকার অংক তো মেলে না এখনও বাকি, এখনও বাকি এই ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ রাতে শরীরের কম জোরে পারি না, দেহ ক্লান্ত, পুড়ে যায়, ঝড়ে উড়ে যায়, বজ্রঘাতে জীবন দ্বীপ নিভে যায় তবু চিতা সাজাই, চিতা জ্বালাই সেকি এজন্যে যে আমার পুত্র, ওরে আমার পুত্র-রোহিতাস্য... তোমার চিতা জ্বালাবার জন্য, তোমার বাবা চণ্ডাল হয়েছে তোমাকে চিতায় তুলতে শৈবা... আমি তো পারি না, এ কোন পাপে- কোন জন্ম জন্মান্তরের অপরাধে বাবা হয়ে পুত্রকে চিতায় তুলে চিতা সাজাই শৈবা ফুলকুড়াতে তুমি কেন গেলে- ভগবান কি আছেন! তিনি না হয় আমায় মারতেন, না হয় তোমায় কিন্তু তোমার সামনে, তুমি যে ভগবানের জন্য ফুল তুলতে গেলে, সেই ভগবানের সৃষ্টি সাপ আমাদের পুত্রকে কাটে হা শৈবা, বৃথাই আমাদের জীবন ধারণ কিসের সত্যেরক্ষা! কিসের দান তপস্যা! ছেলেই যখন আমাদের থাকলো না তবে চল শৈবা, উঠি চিতায়, জ্বালাই অগ্নি, সন্তান পুড়বে আর আমরা বাঁচব-ভগবান সেকি হয় হা ভগবান, দান প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে যদি হাজার বছরও নরক বাস হয় তবে তাই হোক তবু পুত্র বিনে জীবন! হায়রে আমার রোহিতাস্য, হায়রে আমার শৈবা, চিতার আগুন নিভে যায় কিন্তু মনের আগুন তো নেভে না মনের আগুন তো নেভে না মনের আগুন তো নেভে না

আশরাফ বোয়ারী: আগুনকে নিভিয়ে জল আর জলকে ফুটিয়ে আগুন বানিয়ে তুলছে আমারই লেখা কানন দেবী নাটকের কানন দেবী হয়ে মঞ্চের মাদকতা অভিনেত্রী কুসুম কলি কুসুম কলির সংলাপ যেন আগুন ফলবান (কানন দেবী চরিত্রে অভিনয় করছে অপর একটি আলোর জোনে কুসুুম কলি)

কানন দেবীরূপী কুসুম কলি: মর্ত্যে ফুটলেও সূর্যের পানে চেয়ে থাকা সূর্যমুখীর মতোই আমার দৃষ্টি সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী যখন মনে বসন্ত এসেছে, যখন যৌবনের উচ্ছল আবেগের জোয়ার আমার কাঠিন্যেও বাঁধ ভেঙে আমারই অন্তরের অতলে তুলেছে মাতনের হাওয়া, যেদিন যৌবনের রাজটিকা ললাটে পরে ঠিক যেন রাজার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন অশোক মৈত্র সেদিনই আমার মন বাঁধা পড়েছিল তার কাছে ভালোবাসাকে যেভাবে সম্মান দিয়ে সেদিন গ্রহণ করেছি ঠিক সেভাবেই সাতপাঁকে অগ্নি প্রদক্ষিণ করে সামাজিক স্বীকৃতিকে আদায় করে সংসার শুরু করেছি নিয়ম যে ভাঙে অচলায়তনের ধাক্কা তো তার স্বাভাবিক প্রাপ্য সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি গ্রহণের দলিলে সাক্ষ্যও দিয়েছে কিন্তু অভ্যর্থনার মঙ্গলশঙ্খ বাজায়নি আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে অভিনন্দিত করেনি রক্তচক্ষু প্রতিবাদের ঝড় সমাজের ওপরের মহল থেকে নিচ অবধি আজ যে পত্রিকার সম্পাদক আমার সাক্ষাৎকার পেতে মরিয়া আজ থেকে ত্রিশটা বছর আগে সেই আপনারা কার্টুনের ক্ষত একে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ না ঘটিয়ে আজকের মতো দুটি কথা লিখলে তো ঘরটা আমার ভাঙতো না আমার কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত শুনে আজ যারা বেলা পার করেন তাদেরই অনেকে যারা আমি বিয়েতে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজে হাতে সই করা ছবি পাইÑ সে কথা চিঠিতে লিখে, ট্রাঙ্ক কল, টেলিগ্রাম করে উঁচু মহলে অসন্তোষ না ছড়াতেন তবে তো আমার সাধের ঘর ভাঙে না আজ এই বাড়িতে প্রভাতে দরজা খুলবার আগ থেকেই যেসব শুভ দর্শনার্থী আমার অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন এই তাদেরই অনেকে সেই ত্রিশ বছর আগের বাড়িতে যদি ওভাবে ভর্ৎসনা কুৎসা রটনা চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে জীবনটাকে দুর্বিসহ করে না তুলতেন তবে যে সংসারটা আমার ওভাবে ভাসে না সবকিছু কীভাবে ভেসে গেল কিন্তু আমি কানন দেবী পরাজিত আমি নই সেদিনের ঘর আমার ভেঙেছে কিন্তু আবার ঘুরিয়েও দাঁড়িয়েছি আজ তো বহু বছর পার হলো স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্যের সাথে ঘর করছি সন্তান রানাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে লাল টুকটুকে বউমা এনেছি ঐশ্বর্য সম্পদ ক্ষমতা প্রতিপত্তি আজ আমার তো সবই আছে তবে কারও যদি মনে হয় সে দিনের সংসার ভেঙে যাওয়াটা আমার পরাজয় তবে তাকে বলি সেটি পরাজয় নয় সেটিও একটি জয় অভিনেত্রীর জীবন কাটবে বারবনিতার মতোÑ এই অন্যায় সংস্কারের বিরুদ্ধে আমিই প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছি বলেই এ অধিকার সম্বন্ধে সবাই সচেতন আমি, আমি কানন দেবী, মালি যেমন বন জঙ্গলকে নিয়ন্ত্রণ করে পুষ্প শোভিত বাগানে পরিণত করে ঠিক তেমনিভাবে আমি, আমি কানন দেবী, আমিই প্রথম দরজা ভেঙেছি বলেই সেই খোলা দরজা দিয়ে সুন্দর জীবনের পথ প্রবেশ অন্য সকলের কাছে সহজ হয়েছে আর সেখানেই আমার জয় পরাজয় কিন্তু জয় পরাজয় কিন্তু জয় পরাজয় কিন্তু জয়

আশরাফ বোয়ারী: পত্র-পত্রিকায় নাটকের প্রশস্তি লেখা হচ্ছে নিয়মিত শোর বাইরে মাঝে মাঝেই কল শো হচ্ছে ঝড়-ঝঞ্ঝা পার হয়ে যখন মাত্র একটু কপালে সুখের পরশ মিলেছে তখন ঐ সাইফুল খান রাজা হরিশচন্দ্রের মমত্বভরা কর্তব্য কর্মকে দুপায়ে দলে, পুত্র রোহিতাস্যকে কাটা সাপের মতো বিষধর সাপ হয়ে আমার উপর হিংস্র বিষাক্ত সাপ হয়ে মারণ ছোবলের ফনা তোলে তার ভয় আমার উপস্থিতির কারণে তারা নাকি বিকশিত-প্রকাশিত হতে পারছে না তারা অভিনয় করে দর্শক মাতাচ্ছে আর মাঝ থেকে বাহবা প্রশংসা সব একা আমি পাচ্ছি অতএব আমায় হঠাও একদিন দলের সকলের উপস্থিতিতে ঐ সাইফুল খান বলে, আমি নাকি কুসুম কলিকে একা পেয়ে তার সম্ভ্রম নষ্ট করতে গেছি সময় মতো সে এসে পড়ায় কুসুম কলি রক্ষা পেল এরকম একটা মানুষ কিছুতেই ভাসানে উজান দলে যুক্ত থাকতে পারে না আমি যেই মাত্র প্রতিবাদ করতে যাব, অমনি দেখি কুসুম কলি সাইফুল খানের হাত ধরে বলছে, তুমি তো আর সব সময় আমায় দেখে দেখে রাখতে পারবে না মাংসের ঘ্রাণ যখন নেকড়ে একবার পেয়েছে তখন বারবার তাড়া করবে এভাবে থাকা চলবে না হয় চল আমরা দল ছেড়ে যাই নচেৎ দল নিয়ে চলে যাই ভাসানে উজান দল আমার হাত ছাড়া হয়ে গেল

[আশরাফ বোয়ারী কথাগুলো বলতে বলতে বন্ধকের ঘর থেকে ট্রান্সপারেন্সি গ্লাস সরিয়ে বসত ঘরে ঢুকে বিছানায় দর্শকদের দিকে মুখ করে শোয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এই দৃশ্যের শেষ সংলাপ বলে]

আশরাফ বোয়ারী: ভাসানে উজান দল আমার হাত ছাড়া হয়ে গেলে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ মেকাপম্যান গৌরাঙ্গ ধর আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আমি নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও, অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সর্বোচ্চ ভালো করা সত্ত্বেও আমার উপর আরোপিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করলাম না কেন? কেন ঐ রাসকেল দুটোকে দলের সকলের উপস্থিতিতে থাপড়িয়ে দল থেকে বের করে দিলাম না কেন? আমি কেন আমারই প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখলাম না কেন? [আশরাফ বোয়ারী বিছানার বালিশের পাশে রাখা কাঁথা খুলে মুখের সামনে রুমালের মতো ধরে নিজের মুখ আড়াল করার ভঙ্গিমায় বলে চলে]

গৌরাঙ্গ ধর তুমি মেকাপম্যান কাজল পরিয়ে রং বেরংয়ের পাউডার মাখিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে, কাঁচা পাকা গোঁফ বসিয়ে, মাথায় পরচুলা পরিয়ে তুমি কিশোরকে বৃদ্ধ করো, নিরীহকে হিংস্র করো, মুখোশ দিয়ে মুখকে ঢেকে ফেল সে তো সাময়িক সে তো শিল্প সত্য কিন্তু বাস্তব কি এত সোজা গঙ্গাধর! একজন মেয়ে যখন একজন পুরুষ মানুষকে আসামির কাঠগড়ায় তোলে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কি সত্যিই সোজা? বিচারকের রায়ে জয়-পরাজয় হলেও গায়ে যে কালিমা লাগে তাকি কোনোদিন মোছে? গৌরাঙ্গ ধর, তোমার নারকেল তেল আর তুলা কি সেই কালিমার দাগ তুলতে পারে কলঙ্কের কালিমাখা একটা মানুষ কীভাবে শিল্প সংস্কৃতির ভুবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে গৌরাঙ্গ ধর কলঙ্কের কালির দাগ কি মোছে গৌরাঙ্গ ধর! মোছে না কেউই কোনোদিন মুছতে পারেনি [আশরাফ বোয়ারী দর্শকদের দিকে পা দিয়ে বালিশে মাথা পেতে কাঁথায় পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে মঞ্চ অন্ধকারে ডুবে যায়]

দৃশ্য: ২

[আশরাফ বোয়ারী বন্ধকের ঘরের সম্মুখে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে একটা পিতলের সিগারেটদানী ঘষে মেঝে পরিষ্কার করে চলেছে এমন সময় এক চব্বিশ-ঊর্ধ্ব কিশোরী একা মেকাপ বক্স নিয়ে লাজুক ভঙ্গিমায় আশরাফ বোয়ারীর সামনে এসে দাঁড়ায় উভয়ের মধ্যে কথা চলছে]

আশরাফ বোয়ারী: চৈত্রের দুপুর গরমে তাল পাকছে এই কাটফাটা দুপুরে অনুগ্রহ করে আপনি আমার মাথার তালু গরম করবেন না বলে দিয়েছি গতদিন বন্ধকের কারবারে আপনার সুপারি কাটার যাতির কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই একে যাতির মূল্য নেই তার উপর টাকা ফিরিয়ে দিয়ে সপ্তাহ শেষে ফিরিয়ে নেবার ধমকের গরিমা আপনার গরিমা, আপনার তেজ আপনার থাকুক, আমায় মাপ করেন যাতির যেহেতু কোনো মূল্য নেই, অতএব আমি যাতি রাখতে পারব না

শাবরিনা : মানুষের মূল্য না থাকতে পারে কিন্তু জিনিসের মূল্য সবসময় বয়স কম রক্ত গরম দাঁতের জায়গায় দাঁত আছে তাই যাতি হয়তো এখন নিষ্প্রয়োজন কিন্তু বার্ধক্যের জ্বরা এলে বুঝতেন সুপারিকুচির জন্য যাতিই বিশেষ প্রয়োজন

আশরাফ বোয়ারী: অ্যাই মেয়ে শোনেন, সুচিত্রা সেন স্টাইলে আমার সাথে কথা বলবেন না ভাব নিয়ে কথা বলতে চাইলে শাবানা আজমীর স্টাইলে বলবেন আর শোনেন আপনাকে বলি, সুপারী আমি খাই না আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না, মানুষের অভিনয় দেখে দেখে আমি ক্লান্ত সব শালা মুখোশ পরা এক-একটা অভিনেতা-অভিনেত্রী আপনি যে গরিব, দুটো টাকার অভাব মেটাতে ঘটি-বাটি-যাতির মতো হাবিজাবি জিনিস নিয়ে যে আমার মতো এক বন্ধকের কারবারীর কাছে দারস্থ এই সহজ সত্যটা মেনে নিলে কী ক্ষতি ক্ষতি তো এই যে তাতে ডাট থাকে না তাই তো শোনেন, মুখোশ আর মুখ এক না যেমন অভিনয় আর বাস্তবতা এক না একবার আমায় প্রশ্ন করেন কে আমি? করেন প্রশ্ন প্রশ্ন করা লাগবে না আমিই উত্তর দিচ্ছি আমি আপনাকে আমার বায়োডাটা শোনাচ্ছি না ততটুকুই বলছি যতটুকু আপনার শোনা প্রয়োজন আমি জীবন চলতি পথে যাদের সংস্পর্শে আসি তাদেরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি সহায় অসহায় উভয় মানুষই আমি দেখি সহায়ের ঔদ্ধত্য আর অসহায়ের নমনীয়তা সবই দৃশ্যমান হয় অসহায়ের অসহায়তা সবই আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি, ব্যথায় কাতর হই কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমি তাদের জন্য কিছু করতে পারি না পারার সুযোগ পাই না অথচ জেনে যাই, দুঃসময়ে মানুষ মানুষকে কীভাবে পা দিয়ে দলে, কীভাবে তুষের আগুন হয়ে ঝলসিয়ে মারে সহায়ের ঔদ্ধত্য আর নির্মমতা আমি যেমন জানি তেমনই জানি আমার সামান্য ভূমিকায় ঐ অসহায় তার দুঃসময় পার হয়ে গেলে, উপকার প্রাপ্তিকে অস্বীকার করার জন্য প্রতিদান দিতে সম্মানহানি বোধের কারণে কতটা অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর নাটুকেপনা করতে পারে আর সেই কারণে আমার জীবনে চরম সিদ্ধান্তটা আমি আমার মতো করে নিয়ে নিয়েছি কোনো অসহায় মানুষ যদি তার দুঃসময়ে আমার শরণাপন্ন আমার দারস্থ হয় তবে তাকে আমি তুষের আগুন হয়ে ঝলসাবো না, পা দিয়ে কাদা দলার মতো দলবো না ঠিকই কিন্তু দুঃসময়ে মার খাওয়া একটা মানুষের ভাগ্য নিয়ে দোলাবো, দাম নিয়ে আগুপিছু করবো, কম দামে কিনে বেশি দামে বেচবো, এতেই আমার তৃপ্তি, হোক সেটা কৃতি কিংবা বিকৃতি, আমি পয়সা ফেলে পয়সা তুলি আমি বন্ধকের কারবারী কেউ পছন্দ করলেও আমি বন্ধকী কেউ অপছন্দ করলেও আমি বন্ধকী এই হোক কুৎসিত বীভৎস কিন্তু লোভাতুর মুখই আমার মুখ তবুও আমি নই অভিনয়ের ছলে স্নিগ্ধ সুমিষ্ঠ কিংবা ভণিতার ছলে সংসার-সমাজে সেজে থাকা সঙয়ের মতো মুখোশধারী আশা করি আপনি বিশ্বাস করতে পেরেছেন যে, আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি

শাবরিনা : সবাই পারতে চাইলেই যে পারবে এমনটা তো নয় আমার কথাটা ধরুন না আজ আমি আর সুপারী কাটার যাতি আনিনি এনেছি আমার দীর্ঘদিনের পছন্দের মেকাপবক্স টাকারও দরকার আবার রংঢংয়ের মুখোশ আর মুখে ছাপাব না বলেই মেকআপবক্স আনা যখন অভিনয়টা ছেড়ে বাস্তবে ফিরতে চাইলাম তখনই আপনি আমার বানিয়ে দিলেন অভিনেত্রী আমার স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিমাকে নিয়ে রহস্য করে বললেন সুচিত্রা সেনের অনুলিপি শাবানা আজমীর মতো তেজ নিয়ে বলি এটা আপনার চাওয়া এবং কাম্য আমি তো চেয়েছিলাম মেকাপবক্স ছেড়ে, স্বাভাবিক চলনে অভিনয় থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু সত্যিই কি পারলাম সবাই কি সবকিছু পারে বলেন পারে!

আশরাফ বোয়ারী: পারে না বললে তো আর জীবন চলা বন্ধ থাকে না মানুষকে পারতে হয়, পারার প্রচেষ্টাকে জিইয়ে রাখতে হয়

শাবরিনা : কতটা পারা যায় এক অভিজাত পরিবারের মেয়ের সমস্ত জ্ঞান রুচি রং আড়াল করে এই সিলেট চা বাগান শ্রমিকদের সাধারণ নিম্ন আয়ের জীবনের সাথে হুবহু এক হয়ে মিলে যাওয়া, বিলীন হওয়া হবিগঞ্জে তো আমাদের নিজেদের বিশাল বাড়ি, বড়ো পুকুর আর সাজানো বাগান- এ সবই তো ছিল আমিই তো ছিলাম আমার বাবা মায়ের যোগ্য উত্তরাধিকার আমাদের বাড়ির পাশে একটা ছোটো পাহাড়ি টিলা শীতের এক ভোরে উঠে দেখি টিলার ভূমি ধসে ডেবে গেছে আমাদের বাড়ির একটি ঘর সেই ঘরে থাকতেন আমার মা আমি বাবা অন্য ঘরে আমি আর বাবা মিলে কোদাল শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে খুঁজে চলেছি যদি এখনও মাকে জীবিত পাওয়া যায় আমাদের কাজে হাত লাগালেন পরম মমতায় পাহাড়ি মেম্বার ছালেম ছাত্তারÑ তিনজনের প্রচেষ্টায় মাটি খুঁড়ে মাকে যখন পেলাম তখন আমার মায়ের মুখ আর চেনা যায় না নাক-চোখ-মুখ সবই লেপ্টে গেছে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করলাম দাও দিয়ে মায়ের মুখ হা করাতে যদি আবার মুখ খুললে দম নিতে পারে মা পারলো না দম নিতে কিন্তু চোখের সামনে দেখলাম বাবার প্রায় দমবন্ধ দশা মাকে ছেড়ে তখন বাবাকে বাঁচাতে আমি মরিয়া আমার বাবার কী হলো, বাবা কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে নাক মুখ দিয়ে রক্ত গলে বাবা আমার মায়ের মুখের উপর বুট হয়ে পড়লেন আমি আর ছায়েম ছাত্তার বাবাকে ধরাধরি করে হাসপাতাল-ডাক্তার করলাম ৬ মাস বাবা বিছানাশায়ী তারপর এক সন্ধ্যায় নিজের বিশাল বাড়ি, পুকুর, সাজানো বাগান সবকিছুকে পিছনে ফেলে মাটির ঘরের দাওয়ায় চোখ বুজলেন আর আমি এক সাম্রাজ্যের রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ একা নিঃস্ব, এতিম হয়ে গেলাম মনকে সান্ত্বনা দিলাম, এই পৃথিবীতে প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে একা আবার প্রত্যেকেই তার চেষ্টায় লাতায়-পাতায় কিছু না কিছু একটা অবলম্বন খুঁজে নেয় ঠিকই হয়তো মনের গহীনে একটা অবলম্বন হিসাবে ভাবছিলাম ছায়েম ছাত্তারকে মা এবং বাবার অন্তিম সময়ে তার উপস্থিতি, সহযোগিতার হাত কোথাও হয়তো কিছুটা হলেও আমাকে দুর্বল করেছিল তার কথাতেও ছিল কেমন জানি একটা নির্ভরতা বলতো, বাবা নেই তো কী হয়েছে আমি আছি না আবার বলতো মাচায় লাউ ঝুললে বেড়া দিতে হয় এই যেমন আমি বাঁশের মজবুত বেড়া আমি ঠিক বুঝতাম না তার কথার ইংগিত আমার প্রতি ব্যকুলতায় নাকি নারীর দেহের প্রতি এক পুরুষের লালসা এটা মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগতো ভয় হতো ভাবতাম হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে যাই কিন্তু পরক্ষণে মনে ভাসতো, নিজের বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় যাব ভয়শঙ্কা আর ভীতি নিয়ে কাঁটছে জীবন রাতে কালো অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে ভয় পাই দেখে হারিকেন জ্বালিয়ে ঘুমাই হঠাৎ একরাত্রে দেখি হারিকেনের আলো দপদপ করে জ্বলছে হারিকেন ঘিরে ছায়ামূর্তি ঘুমের ঘোর ভাঙতে ভাঙতে আমি তখন ভয়ে বরফের দানা ভালো করে তাকিয়ে দেখি হারিকেন গাউ করে আমার বুকের মাঝে বুক রেখে কুকুরের মতো নাকে নাকে ঘ্রাণ শুকছে বিড়াল চোখের ছায়েম ছাত্তার এত রাত্রে এই ঘরের মাঝে এই কাল সাপ এল কীভাবে? মাড়ি চাবিয়ে চাবিয়ে ছায়েম সাত্তার বলছে- গোলের ঘর ধান কাটার কাঁচি দিয়ে কেটে ঘরে ঢুকেছি চিৎকার দিয়ে লাভ নেই চিৎকারের শব্দ কুকুরের কানে যাবে না মানুষ তো দূরের কথা শোন শায়া না শাবরিনা, মাথা লেজ আমি একদিনে দুটো খাই না হয় মাথা না হয় লেজ মাথা খাই চাবিয়ে, লেজ খাই বেছে বেছে কিন্তু খাব যে এটা আনায় আনা ষোলো আনা, এখন তুমি বলো তোমার কোনটা খাব মাথারূপি তোমার জমি-জায়গা, না কি লেজরূপি তোমার দেহের পাহাড়-ঝরনা না না আপত্তির কিছু নেই আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি আমার লোক ঘরে আবার বাইরে তিনশত টাকার স্ট্যাম্প পেপার এনেছি কালি-কলম সব এনেছি আজ থেকে তোমার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি তিন লক্ষ টাকায় কিনি নিয়েছি সেকথা টাইপিস্ট দিয়ে স্ট্যাম্প-পেপারে লিখেও এনেছি শুধু তুমি তোমার নরম বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে টিপ দাও, সময় বাঁচাও, আমি ঘরের বাইরের লোক নিয়ে চলে যাচ্ছি আর যদি অন্যথা করো তবে আমি তোমায় খাব ঘরে আমার ষণ্ডা মার্কা লোক রেখে বাইরে বেরিয়ে গ্রামবাসী ডাকবো ঘরে অবিবাহিত হয়ে পরপুরুষের সাথে শোয়ার অপরাধে চুল কেটে, শায়া পরিয়ে শায়া না শাবরিনারে গ্রাম ছাড়া করবো এখন বলো কী দেবে তুমি জমি না তোমার তুমি হয় শালি তুই জমি দিবি না হলে নাঙ্গা হবি সেদিন নারী সম্ভ্রম বাঁচাতে স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি স্ট্যাম্প পেপারে টিপসই দিয়ে ছায়েম সাত্তারকে দিয়ে তার হাত থেকে বেঁচেছি বাবার এক দূর সম্পর্কের বড়ো বোন থাকে এই সিলেট চা বাগানে তার কাছেই নিরাপত্তা আর মাথা গোঁজার জন্য ঠাঁই নিয়েছি

আশরাফ বোয়ারী: এসব কথা আপনি আমাকে কেন বলছেন? আমি তো আপনার কেউ না বন্ধকের কারবারে কাস্টমারের আবেগ অনুভূতি কোনোভাবেই বিনিয়োগের পণ্য না কেনোভাবেই ভুলে যাবেন না আপনি যার সাথে কথা বলছেন তিনি শুধুমাত্র একজন বন্ধকের কারবারী উপরন্তু এই মেকাপবক্স কেন? রং পাউডার কাজল পেন্সিল এসবের কথা যত আমি ভুলতে চাই এই জগৎসংসার ততই যেন সেসব আমার কপালে লেপ্টে দেয় মেকাপবক্সও বন্ধকে রাখবার জিনিস না এতদ্সত্ত্বেও আমি আপনাকে পাঁচশত টাকা দিচ্ছি আপনি নিজে দেওয়ালের কাছে পিঠে কোথাও রেখে যান সময় সুযোগ মতো টাকা ফেরত দিয়ে এসে নিয়ে যাবেন এবার আপনি আসেন আমাকে আমার মতো থাকতে দেন

শাবরিনা : আপনি আপনার মতোই থাকবেন কারণ আপনি সব পারেন কিন্তু আমার হয়তো আর আসা হবে না কারণ আমাদের মতো মেয়েরা ভালো হয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাইলেও ভালো থাকতে পারে না

আশরাফ বোয়ারী: কিন্তু লোকে যে বলে ভালো হতে পয়সা লাগে না

শাবরিনা: অন্যের ভালো অল্প পয়সায় কিনে নিজের কুক্ষিগত করার জন্যই কিছু মানুষের অহেতুক মনগড়া এই উপদেশ এই চা শ্রমিকদের জীবন মান একটু ভালোর জন্য, চায়ের ক্রেতার একটু সুস্বাদু চা পানের জন্য, চায়ের ম্যানেজারের কোম্পানির শ্রীবৃদ্ধির জন্য কোনো পর্বেরই কি প্রকৃত পক্ষে টাকা পয়সা ছাড়া কোনো ভালো আছে কোনো ভালোই কি আসলে টাকা ছাড়া হয় এক ছায়েম সাত্তারের হাত থেকে মুক্তি পেতে যে আমি হবিগঞ্জের বিশাল বাড়ি শানবাঁধানো পুকুর সাজানো বাগান ফেলে বড় চাচীর বদৌলতে এই চা বাগানে শ্রমিকদের সাথে ছদ্মবেশে মিশে আছি একটু নিরাপত্তার জন্য একটু অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের জন্য সেখানেও নব্য ছায়েম ছাত্তাররূপী চা চাবাগানের চোরাকারবারী খন্দকার জব্বার এই খন্দকার জব্বার এমন কোনো কাজ নেই যা সে করে না চা বাগানের কর্মীরা যে পরিমাণ কাঁচা পাতা তুলবে, ওজনে কম দিয়ে ঠকাবে এই জব্বার খাতা কলমে চা পাতার ওজন দেখাবে ত্রিশ মণ কিন্তু আসলে চায়ের পরিমাণ পঞ্চাশ মণ আবার রাতের আঁধারে চা পাতা কেটে ঢেঁকিতে ছেঁটে তৈরি মণকে-মণ ঢেঁকি চা গোপনে সরিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেবে যে, সে এই খন্দকার জব্বার এতো গেল তার ব্যবসায়িক বাটপারি নারীদেহ ভোগ লালসায় সে এখন পিশাচি তার শকুনি নজর চা শ্রমিকদের যুবতী বউ আর কচি কচি মেয়েদের প্রতি যুবতী বউদের বশে আনে স্বর্ণের বালা, কোমর বিছা আর তাদের স্বামীকে বোতল-বোতল তাড়ি মদের নেশায় মত্ত করে কচি কচি মেয়েদের বিয়ের লোভ দেখায় আর মা খালাদের টাকা ছিটিয়ে হাত করে বিয়ের নামে দুতিন রাত ফুির্ত করে, ফুর্তি শেষে মাস্তান দিয়ে হুুমকি-ধামকি শেষে মুখের মধ্যে এক তারি টাকা গুজে মেয়ের পেছনে লাথি মেরে সটান সটকে পড়ে চোরাকারবারী নারী অপহরণকারী খন্দকার জব্বার, সবার সব খবর নখ দর্পণে তার এবার তার কামনার শকুনি দৃষ্টি পড়েছে আমার উপর সে জানে এই সিলেটে আমার সর্বসাকল্যে খালা আর এক চাচী চা বাগানের বড়ো বাবুর বাড়িতে ধোয়া-মাজা, কাপড় কাচা, বাগান সাজানোই তাদের কাজ আমি আপত্তি করি বলে আমাকে তার কাজে নিতে পারে না খালা চাচী কাজে গেলে আমি কখন ঘরে একা থাকি সেসবই খন্দকার জব্বারের মুখস্থ পানের চুনের প্রয়োজনে, পায়ের ফোটা কাটার জন্য, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে ঠেকাতে এক গ্লাস জলের অজুহাতে যেকোনো সময়ই তার আসা চাই যতবারই সে এসেছে, যত অজুহাতেই সে এসেছে আমি কিন্তু ঘরের খিল খুলিনি দরজা খুলতে না পেরে সে এখন পথ বাতলেছে চাচা খালারে নগদ টাকা আর দুজনকে দুটো হাত বালা পরিয়ে তাদের রাজি করিয়েছে এখন যেকোনো রাত্রে সে আমাদের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করবে আর তখন চাচি-খালা বেঁহুশের মতো ঘুমাবে আমি শত কোটি ডাকলেও, আমার ডাক তারা শুনবে কিন্তু ডাক শুনতে পারেনি বলে তাদের ঘুম ভাঙবে না

আশরাফ বোয়ারী: আপনি এতসব কথা আমাকে কেন বলছেন আপনি কেন ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন বন্ধকের কারবারী আমি মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলাতে পারি, ভাগ্য বদলে দিতে পারি না আমি দর-দাম আগু-পিছু করতে পারি, দাতব্য আশ্রম খুলে বসতে পারি না আমি দহনে গলে যেতে পারি কিন্তু দাবানালকে শীতল করতে পারি না

শাবরিনা : কিছুই যদি করতে নাই পারবেন তবে আপনার কাছে এলে বলবো না বলবো না বলেও এত কথা বলে ফেলি কেন? মনুষ্যত্ব যাকে বলে- তার জন্যই তো মানুষ মানুষকে আপন ভেবে মনের সব কথা উজাড় করে বলে আমার কী দায় আপনাকে এতসব কথা বলা আপনি যদি সত্যিকার অর্থে আমার আপন না হতেন, আপনার মধ্যে যদি একজন নারী হিসাবে আমি খুঁজে না পেতাম আমার রক্ষাবলয় তবে তো কোনো কথাই বলতাম না আপনার অহংকার আপনার গুটিয়ে নেওয়ায়, আমি অভিশপ্ত নিজেকে আমি গুটিয়ে নিতে না পারায় আপনার উচিত হাত বাড়িয়ে হাতটা আমার ধরা

আশরাফ বোয়ারী: হাত ধরা না, আমার উচিত হাতটা বাড়িয়ে আপনার পদযুগল ধরা আর পদযুগল ধরে ভক্তিভরে বলা, আমার অনেক বড়ো অপরাধ হয়েছে আপনার মতো মহৎ মানুষের সান্নিধ্যে এসে কথা শোনা ও বলার সুযোগ পাওয়া আচ্ছা আপনারা কেন সব সময় একটা শান্ত শীতল পুকুরের জলে একের পর এক ঢিল মেরে চলেন আপনার কি মনে হয় আপনাদের জীবনের সব জটিলতার অবসান করার মহান ব্রত নিয়ে আমার এই বন্ধকী জীবন এমনটা আপনি ভুলেও ভাববেন না আমি যে কতটা নিষ্ঠুর তার একটা টাটকা উদাহরণ আপনায় আমি দিই আপনার চাচি-খালা আর খন্দকার জব্বারের রচনায় যে চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে আপনাকে গ্রাস করবার নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে সেখানে আমি রবীন্দ্র ভান্ডার থেকে দুটো কলি উপস্থাপন করি যা ব্যবহৃত করা যেতে পারে নাটকে টাইটেল সং হিসাবে কলি দুটো হলো,

ওদের সাথে মোলাও যারা চরায় তোমার ধেনু

তোমার নামে বাজায় যারা বেণু

শাবরিনা: আপনি আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অপমান করে আপনার পৌরুষের বিকৃতি প্রকাশ করছেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই, বলবারও কিছু নেই কারণ আগ্রহে এগিয়ে আসা সবটাই আমার দিক দিয়ে কিন্তু লোভ-ব্যাকুলতা, কাম-প্রেম, মোহ-মুক্তি যেমন অর্থের দিক দিয়ে কাছাকাছি হয়েও এক নয় তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহান সৃষ্টি এভাবে নর্দমায়-নোংরায় জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অপমান করতে পারেন না সত্যিকার অপমান করার মতো মানুষ আপনি কোনোদিনই ছিলেন না, আজও না এ শুধু আপনার পালিয়ে বাঁচার কৃত্রিম অভিনয় আমি যাতে আপনার উপর ঘৃণা দেখিয়ে চলে যাই, আমার বারংবার আসা যাওয়ায় আপনার লৌহদৃঢ় ব্যক্তিত্ব যেন গ্লাসের কাচের টুকুরো হয়ে খান খান হয়ে ভেঙে না যায় আপনি যে আমারই মতো আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন এই গোপন সত্যের সাক্ষী যেন আমি না হই সে কারণেই আপনার এই ছদ্মবেশ আপনি কেন বোঝেন না কোনো মেয়েই কোন পুরুষের কাছে অরক্ষিত আর কোন পুরুষের কাছে সুরক্ষিত এতটুকু নিজস্ব বোধ না থাকলে সে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলতে পারত না আমি হবিগঞ্জ থেকে বেঁচে ফিরেছি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তির বিনিময়ে কিন্তু এই সিলেটে তো খন্দকার জব্বার আমাকে পরিত্রাণ দেবে না তার সব চক্রান্তের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে সম্পন্ন এখন শুধু নেকড়ে বাঘ হয়ে আমার মতো নিরীহ হরিণের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার করাটাই অবশিষ্ট আমি এক সামান্য নারী খন্দকার জব্বারদের মতো পাষণ্ড মোকাবিলার শক্তি আমি কোথায় পাব আমি বারংবার হেরে যাব হেরে যাব, কারণ আশরাফ বোয়ারীর মতো একজন বন্ধকের কারবারী যা করতে পারতো তা করলো না বলে মনে রাখবেন, অশুভ শক্তি বারংবার জিতে যায় তার কারণ অশুভ শক্তিরা সব সময় একত্রিত আর শুভ শক্তিরা সর্বদা বিভক্ত আমার চাচি খালা খন্দকার জব্বাররা একত্রে মিলে যেতে পারলো কিন্তু আপনি আশরাফ বোয়ারী আর আমি শাবরিনা মিলতে পারলাম না আপনি এও মনে রাখবেন, হাজার বছরের অন্ধকারের ঘরে অন্ধকার দূর করতে একটি দেশলাইয়ের কাঠিই যথেষ্ট যাক আপনাকে আমি বিরক্ত করতে আসবো না, আমার জন্য কিছু করতেও বলবো না শুধু বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে দুটি কলি আপনি উচ্চারণ করেছেন:

ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু

তোমার নামে বাজায় যারা বেণু

আপনার এই উচ্চারণ ছিল আমাকে দূরে ঠেলে দেবার জন্য কিন্তু আসলে আপনার এই উচ্চারণ আপনারই আত্মসংস্কারসাধন

বন্ধকের কারবারি, সর্বক্ষণের বন্ধকের কারবারী হয়ে রাখাল হওয়া যায় না রাখাল হতে মাঠে যাওয়া লাগে আর জিনিস নিয়ে যেভাবে দরদাম করা হয় সেটাকে চিৎকার বলা যায়, কিছুতে বাঁশির সুর সেটা না বাঁশি থাকলেই বাঁশি বাজে না কাউকে না কাউকে তো বাঁশিতে ফুঁ দিতে হয়, আদর করেই বাঁশিতে ফুঁ দিতে হয় আপনি ভালো থাকবেন নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন আমি আসি

[ চলে যায় হতভম্ব আশরাফ বোয়ারী কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ়তা কাটিয়ে হুক্কায় টান শুরু করে ]

দৃশ্য: ৩

[একটি অ্যালকোহলিক বার আলো আঁধারী পরিবেশ গদিওয়ালা একটি সোফায় বসে ধীরে ধীরে পানীয় পান করছে আশরাফ বোয়ারী বারের সিংগার বেদীতে শিল্পীর গজল লাইভ পরিবেশনের সমান্তরালে কোরিওগ্রাফীতে কথামালার দৃশ্যায়ন ফুটে উঠছে আশরাফ বোয়ারীর টেবিলে এক প্লেটে কিচেন স্পাইস, এক প্লেটে টমেটো, শসা সালাদ, এক বোতলে সাদা ভদকা, এক বোতলে গরম জল, একটি ভরা কাচের গ্লাস একটু করে খাবার খাচ্ছে আর পানীয় পান করছে আশরাফ বোয়ারী মন দিয়ে গজল শুনছে আশরাফ বোয়ারী গজলের কথা: চুপকে চুপকে রাত দিন, আসুন বাহানা ইয়াদ হ্যায়... আশরাফ বোয়ারীর বয় পলাশ এবং নির্দিষ্ট সময় পড়ে আসা খন্দকার জব্বারের মধ্যে কথোপকথন চলছে]

পলাশ: স্যার ম্যা আই কাম ইন

আশরাফ: ইফ আই কাম ইউ দেন ইউমে কাম ইন

পলাশ: সরি স্যার প্লিজ পারডেন মি

আশরাফ বোয়ারী: আই উইল পারডেন ইউ ইফ ইউ প্লিজ গিফ মাই টিপস টু দ্য সিঙ্গার হি হিজ ভেরি মাচ ফ্যান্টারস্টিক

পলাশ: ও ইয়েস স্যার [টিপস দিয়ে ফেরত এসে পলাশ পুনরায় বলে] স্যার আমি আপনার হয়ে সিঙ্গারকে টিপস পৌঁছে দিয়েছি

আশারফ বোয়ারী: থ্যাঙ্ক ইউ পলাশ

পালাশ: স্যার সিঙ্গারের গায়কী যেমন মিষ্টি তেমনি আপনার পানীয় গ্রহণ পরের পর্যায় উচ্চারিত সংলাপও তেমন মিষ্টি

আশারফ বোয়ারী: সংলাপ না কথা

পলাশ: স্যার কথা তো প্রাত্যহিক ব্যবহারের কিন্তু আপনি যেভাবে আপন মনে কথা বলে চলেন সেটা আর কথা থাকে না হয়ে ওঠে নাটকীয় সংলাপ মনে হয় একজন মঞ্চাভিনেতার মঞ্চমায়ায় বলে চলা স্বগতোক্তির মধ্যে দিয়ে অন্তর্যাত্রা

আশরাফ বোয়ারী: যাত্রা নাটক আমার দু চোখের বিষ পলাশ পলাশ তোর কি মনে হয় আমি নাটক করি

পলাশ: স্যার, আপনি অবশ্যই নাটক করেন না তবে আপনার করা প্রতিটি কাজ নাটকীয় যেমন: আপনার আসা, অর্ডার করা আপন মনে কথা বলা, এমনকি আপনার চলে যাওয়া স্যার কোনো কাজকে তখনই নাটক মনে হয় যখন সেই কাজটি আরোপিতভাবে করা হয় কিন্তু তা যদি হয় সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত এবং আনন্দদায়ক তখনই তা স্যার নাটকীয় যেমন আপনার উপস্থিতি

আশরাফ বোয়ারী: আচ্ছা পলাশ আজ কি বারে কাস্টমারের স্বল্পতা

পলাশ: না স্যার কেন বলুন তো?

আশরাফ বোয়ারী: কারণ তুমি অন্য কাস্টমারকে সার্ভিস না দিয়ে শুধু আমার সাথে কথা বলছো

পলাশ: না স্যার বারে কাস্টমার আছে যথেষ্ট কিন্তু স্যার আমি একটা হিসেব কষে নিয়েছি সেটা হলো আপনি এখানে বসেন এক ঘণ্টা, এক ঘণ্টা শেষে আপনি আমায় টিপস দেন পাঁচশত টাকা যা অন্য কয়েকজনে মিলে দেয় অর্থাৎ অন্যেরা টিপস দেয় একশত করে ফলে আপনি একাই যেহেতু পাঁচশত দেন ফলে আপনাকে পুরো সার্ভিসটা দেওয়া আমার লক্ষ্য

আশরাফ বোয়ারী: পাঁচশত টাকা সাথে আরও পাঁচশত টাকা যোগ হলে তো তোমার এক হাজার টাকা হয় এই লোকসান তোমায় ভাবায় না

পলাশ: ভাবাত কিন্তু আপনার একটা সংলাপ আমাকে সেই ভাবনা নিয়ন্ত্রিত করেছে আপনি একদিন বলেছিলেন, মানুষের সমস্ত কষ্টের মূলে লোভ লোভ টেনে আনে হিংসা হিংসা টেনে আসে ক্রোধ ক্রোধ টেনে আনে যুদ্ধ যুদ্ধ টেনে আনে মৃত্যু মৃত্যু ভয়াবহ কিন্তু এসবের চেয়ে ভয়াবহ ঘৃণা ঘৃণার পরিণতি সব পরিণতির চেয়ে বীভৎস ফলে অধিক লোভের কারণেই একজন অপরজনের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে যার ফলাফল মারাত্মক ফলে স্যার আমি যখন আপনার কাছ থেকে কল্পনাতীত ভাবে পাঁচশত টাকা পেয়েই চলেছি তখন তো আমাকে আর পাঁচ জায়গায় ছোটার প্রয়োজন নেই আমি কি ঠিক বললাম স্যার

আশারাফ বোয়ারী: আমার যে কথা তুমি আমারে বললে এটা ভুল ঐ কথাটা মহাকাব্য মহাভারত-এর রচয়িতা ব্যাসদেবের কিন্তু তুমি যে এক শোনায় মনে রেখে বললে, বলতে পারলে তার জন্য আজ তুমি টিপসে অতিরিক্ত আরও একশত টাকা পাবে পলাশ যদি পার তবে তুমি আমার একটা কথা বলা কথা বলতে পার আমার মনটা একটু দোদুল্যমান কিন্তু তোমার বলা কথা শুনে আমার মনটা ভালো লাগছে পারলে বল

পলাশ: স্যার আপনি যখনই কোনো কাজ করেন কাজটি আপনি কেন করেন, কীভাবে করেন কিংবা কীভাবে করলে ভালো হবে এই বিষয়ে একটা সেলফ অ্যানালাইসিস করেন পানীয় পান করতে করতে আপনার পা যখন টলে যায়, মাথা যখন ভারী হয়ে যায় তখন আপনি আনমনে একটা সংলাপ বলতে শুরু করেন স্যার আপনার সম্মতি পেলে আপনার বলা সেই সংলাপটি আমি বলতে পারি বলি স্যার

আশরাফ বোয়ারী: বলো পলাশ

পলাশ: (আশরাফ বোয়ারী চরিত্র অনুকরণে সংলাপ বলে পলাশ)

সন্ধ্যার পরে এই ধরেন রাত ৮টা কি ৯টা, বারে বসেছি একটু হার্ড ড্রিংকস খাবো বলে বন্ধকের কারবার, মানুষের অহেতুক কথা আর সুদ-আসলে টাকার হিসাবি দামদর ব্রেনটাকে একটু রিলাক্স দেবো বলে যাই মাঝে মধ্যে তা ধরেন মাসের শেষ সপ্তাহে যদি যাই একদিন, তবে পরের মাস বাদ দিয়ে তারপরের মাসের প্রথম সপ্তাহে আরেকদিন তা আমি পারতপক্ষে টেবিল রিজার্ভ নিয়ে একাই বসি আপন মনে আপন ধ্যানে নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া মিলিয়ে নেব বলে না তো, প্রেম তো আর আমি পাথরের বুকে যেভাবে দাগ কাটে জম, সেভাবেই আমার বিহেসাবী মস্তিষ্ক খানিকটা সময়ের জন্য হবে ঝিলের স্বচ্ছ জলে সাঁতরে বেড়ানো শিং-পুঁটি-কই মাছের মতো ছল ছল সাথে সংগত দেবার জন্য কিছুই থাকবে না, তাতে না থাকবে চোখের সহনশীল মলিন আলো, আবহে তেপান্তরে মাঠে মিলিয়ে যাওয়া পূরবী রাগের সন্ধ্যা কালো খাবারে থাকবে কচি পাঁঠার কুচি কুচি মাংস, টমেটো শসা পেঁপের মধ্যে কাগুজি লেবুর রসে হালকা বিট লবণে স্বাদ জারিত খেতে খেতে যখন হেড গিয়ার আলগা হবে, যখন মনে হবে এই বিশ্ব এক রঙ্গালয়, অদৃষ্টের টিপে দেওয়া সুইচে প্রতি মুহূর্তে করে চলেছি নানা রঙের নানা বর্ণের অসংখ্য চরিত্রে অভিনয়, যখন ভাবছি আমি সত্যিকারে পরোপকারী যে আমি প্রকৃতভাবে পারি অবলাকে আশ্রয় দিতে, বয়োজ্যেষ্ঠকে সঙ্গ দিতে, সংসারকে সঙ্গ দিতে, সংসারকে সাজিয়ে তুলতে সেই সেই আমি কেন আপনজন, বিশ্বস্তজনে উপকৃতজনদের কারণে বারংবার সংস্থান থেকে ছিটকে পড়ি, সংসারে থেকে গড়িয়ে পড়ি, বারংবার বিরাগী হয়ে পথে উঠি বিবাগী মন আমার কেন এত দ্রুত হয় আমার মুখোমুখি আমি আমার জন্য কীই-বা করতে পারি

[খন্দকার জব্বার আশরাফ বোয়ারীর টেবিলের সামনে এসে বয় পলাশের কথার টানের সাথে মিলিয়ে কথা বলা শুরু করে]

খন্দকার জব্বার: (আশরাফ বোয়ারীর দিকে তাকিয়ে) পারেন সম্মতি দিলে আপনার রিজার্ভ টেবিলে আমাকে বসিয়ে আমাকে আমার মতো পান করাতে পারেন আমি খন্দকার জব্বার, মৌলভী বাজার গ্রুপ অফ কোম্পানির কেয়ারটেকার আমার পানীয় খাবারের বিল আমিই দেবো যদিও আপনার সান্নিধ্যের মূল্য নট রিফান্ডেবল আজীবনের মতো চেয়ারটা আরামদায়ক আপনি বসতে বাঁধা দেননি, এটাই সম্মতি ওয়েটার গিভ মি ফোর জিন স্কচ ককলেট উইথ ফিস ফ্রাই চিলি চিকেন এ্যান্ড স্যালাড মোর

আশরাফ বোয়ারী: ওয়াই ইউ আর হোর এ্যন্ড ওয়াট ইজ ইওর এইম?

খন্দকার জব্বার: নাথিং ইনটেশনাল শুধু গসিপ এটুকুই বলবার আপনি এসেছেন এই মাত্র তা আমি জানি কিন্তু আমার আসা অনেক আগে আই অ্যাম লোডেড আই ওয়ান্ট টু টক আমার কথা আছে অনেক কথা কিন্তু সেরকম মুখ কোথায় বলুন, যে মুখ দেখলে কথা আসে আমার মনে হয়, আপনার বন্ধকের ব্যবসা আসলে আপনার ছদ্মবেশ এই ছদ্মবেশের আড়ালে আপনার মধ্যে আছে আরও বেশি কিছু এই ধরুন ভাবুকবেশ দাঁড়ান গলায় একটু সরষের তেল ঢেলে নিই তো ভাবুকবেশ মানে কী? ভাবুকবেশ মানে প্রতিভার বেশ প্রতিভার বেশ মানে, যারা চিরন্তনকে প্রস্ফুটিত করে শোনেন, আপনার তো মনেই হচ্ছে আমি একজন চা চোরাকারবারী হয়ে কীভাবে এই জ্ঞানের কথা, এই ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি? ভাববারই কথা ভালো কথা আর সেটাই হলো ছদ্মবেশ শোনেন আমি আপনাকে অনেকদিন ধরে অবলোকন করছি ঠিক ধরতে পারি না পারি কিন্তু পারি না, বুঝি কিন্তু বুঝি না কিন্তু বুঝলাম আমি যা বলতে চাই তা যদি কেউ বোঝে, তা যদি কেউ অনুধাবন করে তবে সে আপনি আমার ধারণা আপনি, আপনি, আপনি মানে ঘটনার-ঘটনাকার মানে আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না মানে আমি তো ঐ পথে যাইনি মানে শিল্পকলা বুনিনি তাই পারছি না মানে যারা নাটক ঘটায় তাদের কী বলে? নাটাই না ঘুড়ি! দূর কী বলতে কী বলি কিন্তু শোনেন, আমি একটা প্রতিশোধ নেব কঠোর প্রতিশোধ না না কাউকে আঘাত দিয়ে না, নিজেকে আঘাত দিয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করে কীভাবে? কাকে? এত তাড়াহুড়া কেন? বলছি তো বলছি আপনার টেবিলে আপনি তো আমায় আনেননি আমিই এসেছি কিছু বলবো বলে তা এত তাড়াহুড়া কীসের? শোনেন আমার প্রতিশোধ আমার মার বিরুদ্ধে তার লোভের বিরুদ্ধে আচ্ছা এই যে আমি চোরাকারবারী, আমি মানুষকে তার প্রাপ্য থেকে ঠকাই, নির্মমভাবে ঠকাই তাকি আমি একা একাই সব শিখে গেলাম! না কি এর পেছনেও কোনো গল্প আছে আছে গল্প আছে বাবা মায়ের শরীরের রোগ যেমন সন্তানের দেহে বয় তেমনি বাবা-মায়ের কর্মও সন্তান ধারণ করে বহন করে আমার মনে আছে আমি স্কুলে গান গেয়ে ফার্স্ট হয়েছিলাম গানটি ছিল, ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর মলিন মর্ম ঘুচায়ে’ হেড স্যার নাম ঘোষণা করলে আমি ডিসি মহোদয়ের কাছ থেকে পুরস্কার হিসাবে একটা বই পেলাম নাম গীতাঞ্জলি আনন্দে লাফাতে লাফাতে বইটি দর্শকসারিতে মাকে দিতে গেলাম হঠাৎ দেখি মা আমায় ঠেলছে যারা কোনো পুরস্কার পায়নি তাদের সান্ত্বনা পুরস্কারস্বরূপ বাটি দেওয়া হচ্ছে মা আমায় ঠেলছে বাটি আনতে আমি হতবাক যে, আমি প্রথম- সেই আমি যাব সান্ত্বনা পুরস্কার আনতে! আমার গড়িমসি দেখে মা নিজে গেলেন বাটি আনতে বাড়ি ফিরে ঐ স্টিলের বাটি বাকিয়ে ফেললেন আমাকে পিটিয়ে পিটিয়ে আমার অপরাধ আমি বাটি না এনে মা’র কথার অবাধ্য হয়েছি আর ঝড়ের মধ্যে ফল কুড়াইনি বলে বাড়ির অন্ন ধ্বংস করেছি আমার বাবা এক ফুড কোম্পানির অফিসার ছিলেন আগরতলা- গোহাটীতে তিনি কোম্পানির নিযুক্ত হয়ে কোম্পানির শ্রীবৃদ্ধি করলেন মা বাবাকে বাধ্য করলেন পাসপোর্ট, ভিসায় বারংবার যাওয়া আসার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোল্ডের ব্যবসা করতে মায়ের ফাঁদে বাবা পা দিলেন, কাস্টমস প্রথমবার সতর্ক করলো, দ্বিতীয়বার কমপ্লেইন, ভিসা পাওয়া বন্ধ দুর্নামে অফিসের চাকরি গেল, কিছু করতে না পেরে চিন্তায় চিন্তায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাবা, চাচাদের ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বাবার দুর্দিনের সুযোগ নিয়ে মা, চাচাদের দোকানে তালা দিল বেচে-কিনে সব পয়সা নিয়ে নিয়ে চাচাদের পথে নামালো আর ছোটো চাচার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো বলে, আমার জন্য ছোটো চাচার কেনা বিরিয়ানির মধ্যে ইঁদুরের বিষ মিশিয়ে আগে বিড়ালকে খাইয়ে মেরে, আমাকে হত্যার চক্রান্তকারী কলংকলেপন করে ছোটো চাচাকে গ্রাম ছাড়া করলো আমার পড়া বন্ধ হলো, আমার সম্পর্ক ছিন্ন হলো, আমি আমার লোভী মায়ের বাসনা পূরণের হাতিয়ার হয়ে গেলাম চা বাগান আর চা শ্রমিককে নিয়ে আমার কারবার আমি পাতায় মারি, ওজনে মারি, শ্রমে মারি, টাকায় মারি যতভাবে মারা যায় সেসবই আমি করি বিনিময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা মার হাতে তুলে ধরি মার আমার সেকি বিকৃত আনন্দ! আমার কারণে মানুষ যত বেশি ঠকে, তত বেশি মার আনন্দ বাড়ে কিন্তু আমি তো আনন্দ পাই না আমি তো আনন্দ পেতে চাই ঘটনার বদলা চাই আমি জানি, আমি জানি, আমি যেভাবে চা শ্রমিকদের প্রতারণা করছি, ঠকাচ্ছি এর বদলা একদিন তারা নেবেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকবে অথচ আমাকে ছোবল দেবে না তা তো হয় না আর তা দ্রুত হবার জন্য আমি প্রতারণার মাত্রা আরও বাড়িয়েছি

আমার প্রতারণা এখন শুধু চা বিক্রিতে আটকে নেই, শ্রমিকদের কচি কচি মেয়েগুলোর দিকে এগিয়েছে মেয়েগুলোকে বিয়ের লোভ দেখাই আর মেয়ের চাচী-খালাদের টাকা দিয়ে হাত করি, দুতিন রাত ফুর্তি করি তারপর মুখের মধ্যে এক তাড়ি টাকা গুজে দিয়ে, মেয়ের পেছনে লাথি মেরে সটকে পড়ি হি হি হি কিন্তু আমি জানি এ ব্যবস্থা সাময়িক নারীর অবমাননা ধরিত্রী সয় না আক্রমণ আমার উপর আসবেই হয় মারতে নয় মরতে কিন্তু আমি মারবোও না আবার মরবোও না রক্তাক্ত হব, ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াবে আমার নাক মুখ দিয়ে হাত পা মাথা থেঁতলে থেঁতলে আমি যখন মৃতপ্রায় তখন পকেট থেকে আরেকটি টাকার তাড়ি বের করে ওদের হাতে দিয়ে বলবো, মরার আগে অন্তিম ইচ্ছা, শেষবারের মতো মাকে দেখতে দাও ওরা যখন ধরাধরি করে আমাকে মার সামনে শোয়াবে তখন ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলবো, মা গো এই ছিটকে পড়া রক্ত আমার গীতাঞ্জলি পুরস্কার আর এই রক্তাক্ত সন্তান, তোমার সেই সান্ত্বনার বাটি পুরস্কার নাও মা হয় আমার অক্ষমতা মেনে এই বাটিতে থুতু ফেল নচেৎ লোভের আগুন অনুশোচনার চোখের জলে চিরতরে নিভিয়ে ফেল আমার কাজ চোরা কারবার আমার নাম জব্বার খন্দকার আমি আমাকে ছাড়া কাউকে করি না কেয়ার বিল ক্লিয়ার যাই বস্তিতে পেলেও পেতে পারি অ্যানাদার ওয়াইল্ড হট লাভার

[জব্বার খন্দকার টলতে টলতে বার থেকে বেরিয়ে যায় আশরাফ বোয়ারী পকেট থেকে এক তাড়ি টাকা বের করে গোনা শেষ করে বয় পলাশকে ডেকে টিপস দিয়ে কথা বলা শুরু করে]

আশরাফ বোয়ারী: পলাশ পঞ্চাশ হাজার টাকা ভরি ধরলে এক লক্ষ টাকায় দুই ভরির দুই জোড়া বালা কেনা সম্ভব হচ্ছে এক এক দুই হাজার নগদ চাচি-খালার দক্ষিণা কিন্তু সংশয়টা অন্য জায়গায় আচ্ছা পলাশ একটা কথা বলতো, এক মেয়ের অভিভাবকের দৃষ্টিতে কে বেশি আদৃত, একজন চোরাকারবারী নাকি একজন বন্ধকের কারবারী

পলাশ: একজন চোরাকারবারী দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যার উপর ভর করে একজন বন্ধকের কারবারী দাঁড়িয়ে আছে সত্যের উপর ভর করে ফলে মেয়ের সত্যিকার মঙ্গলকারী অভিভাবক হলে সে অবশ্যই এই দুয়ের মাঝে বন্ধকের কারবারীকেই বেশি প্রাধান্য দেবে কিন্তু যেহেতু তুলনাটা হচ্ছে চোরাকারবারীর সাপেক্ষে বন্ধকের কারবারীর ফলে এখানে অভিভাবক বিশ্বস্তভাবেই ধুরন্ধর লোভী এবং শঠ ফলে দুইয়ের মাঝে যার কাছ থেকে প্রাপ্তি বেশি মিলবে ঐ দুরন্ধর অভিভাবক তাকেই সাদরে গ্রহণ করবে

আশরাফ বোয়ারী: আর মেয়েটির বিবেচনায়?

পলাশ: এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউই দিতে পারবো না একমাত্র স্বামীই জানবে তার স্ত্রী কাকে প্রাধান্য দেবে বিষয়টা সংশয়ে পূর্ণ তবে স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীকে পরীক্ষায় না ফেলে তাকে সহযোগিতা আর যত্ন নিয়ে কোলে পিঠে করে ঘরে নিয়ে তার সুরক্ষা দেওয়া

আশরাফ বোয়ারী: সুরক্ষা দেওয়া

পলাশ: অবশ্যই স্যার এই জটিল পৃথিবীতে একজন নারীর জীবনে সত্যিকারে সুরক্ষা সব সময় প্রয়োজন হোক সে সুরক্ষার বলয় পিতা স্বামী কিংবা সন্তান

আশরাফ বোয়ারী: পলাশ, আমি আমার সংশয়ের সমাধান পেয়েছি আর বিলম্ব করব না আজ তোমায় টিপস ছয়শতের সাথে আরও একশত যোগ করলাম

পলাশ: স্যার আপনি আমার সার্ভিসের টিপস ইতিমধ্যে দিয়েছেন প্রশ্ন-উত্তর পর্ব আমার প্রতি আপনার স্নেহ এখানে বিনিময় না হলেই ভালো স্যার

আশরাফ বোয়ারী: এই অতিরিক্ত টিপস তোমার টিউটিতে নয়, এই টিপস আমার তৃপ্তিতে তাহলে চলি পলাশ

পলাশ: স্যার প্লিজ টেক কেয়ার আই অ্যাম অলয়েজ উইথ ইউ গুডনাইট স্যার

দৃশ্য-৪

[চায়ের বাগানে একটা বেড়া দেওয়া ঘর যেটি বন্ধক ঘরের সামনে একটি সাজেসটিভ বেড়া বসিয়ে দৃশ্যমান করে তোলা হয়েছে মঞ্চে একটি বেঞ্চিতে বসা চাচী, খালা আর দূরে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ানো শাবরিনা বেঞ্চির সম্মুখে একটি ভাঙা হারমোনিয়ামের উপর একটি হারিকেন হারিকেনের আলোর সম্মুখে একটি বুট করা মাটির হাঁড়ির উপর বসে কথা বলছে আশরাফ বোয়ারী]

চাচী: এত রাত করে না এসে আমাদের খবর পাঠালে তো আমরা যেয়ে আপনার বন্ধকের দোকানে দেখা করে আসতে পারতাম ঘরে সেয়ানা মেয়ে রাত বেরাত পুরুষ মানুষ ঘরে ঢুকলে কথা হয় আমরা তো একটা সমাজে থাকি নাকি সই

খালা: আর বলো না মানুষের কোনো চরিত্র আছে বেড়া বেয়ে উঠেছে উচ্ছে গাছ উচ্ছে চুরি করবি কর তাই বলে উচ্ছে টান দিয়ে ছিড়তে যেয়ে আস্ত গাছ ধরে টানা টানি উচ্ছে গেলে সাথে গাছও গেল ঘরে আমরা ঘি নিয়ে থাকি আগুনের শলকা দেখলে আমার আবার কাঁপিয়ে জ্বর আসে সই

চাচী: জ্বর তো আজ আছে কাল নেই কিন্তু মা বাবা মরে সেয়ানা মাগীটারে যে আমার কাঁধের উপর চাপায় গেল, তখন থেকে আমার কোনো মুক্তি আছে মাগীটা আবার জমিজমা সব কোনো এক ভাতারের দিয়ে পাছায় লাথি খেয়ে আমার এখানে এসে উঠেছে আমার হয়েছে সাপ হয়ে ব্যাঙ গোলার মতো অবস্থা না পারছি উগলাতে না পারছি গিলতে

খালা: মাগীর আবার বায়না কত রূপচর্চার জন্য মেকাপ বক্স দাও শীতে শাল দাও পায়ে হিল জুতো দাও ওরে মাগী তোর জুতোয় ঘর থেকে বের করবো তোর ভরণ-পোষণ দেবে তোর কোন বাপ এত এত করে বললাম খন্দকার জব্বারের সুনজর আছে তোর উপর তোর হাতে একটু পান চুন খেলে তার গরম মাথাটা একটু শীতল হয় শ’ শ’ কর্মীরে সে যদি হাত ভর্তি টাকা দিতে পারে তাহলে তোকে কি সে টাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিতে পারে না তাহলে কি টাকার অভাবে তোর শাড়ি গয়না ব্লাউজ ছায়ার অভাব হবে মাগী আমার ডাটে বাঁচে না আচ্ছা বাবু আপনিই বলেন, আমরা দুজনে যে শাড়ি দুটো পরেছি তা কি কম দামি সেই শাড়ি তো ঐ জব্বারই আমাদের দিয়েছে আমরা তার কী হই তবু তো চাচী-খালা গলা ভরা ডাক দিয়ে গত দুই মাসে চারটা শাড়ি দিল না বাবু আমার তো তার কোনো দোষ দেখি না সারাদিন আমরা দুজন পরের বাড়িতে গতর খেটে পাই পাই পয়সা জমায়ে সংসারটা চালাই তুই মাগী কী করিস খালি খাস আর ঘুমাস চা হাটে বেচে দরদাম করে টাকা আদায় করে জব্বার আমাদের ঘরে আসে যে না মাগীটা অন্তত একটু তাড়ি চোলা ঢেলে দিয়ে তার মেজাজটা ঠাণ্ডা করবে তা না ভেতর থেকে ঢিল মেরে খাটের তলে লুকিয়ে থাকে ওরে মাগী তুই বুঝিস না ভদ্রলোকের এতে মানে লাগে না হয় তাড়ি চোলা থেকে খেতে জব্বার তোর গতরটা একটু দেখবে হাতাহাতি তো করবে না ভদ্রলোক মানুষ বাবু খন্দকার জব্বার বার বার তিনবার এসে এই গাজীর কারণে ফেরত গেছে আচ্ছা বাবু আপনিই বলেন, এরকম আচরণ করলে তিনি কি আর এই বাড়িমুখো হবে আর আমরাই-বা কোন মুখে তাকে আসতে বলি আমরা মাগীর খাই না মাগী আমাদের খায় আর দুদিন দেখব এরকম চললে মাগীরে ঠ্যাঙায় ঘর থেকে বের করব যা যেখানে তুই তোর ভাতার আছে সেখানে থাকবি মাসে দুটো করে শাড়ি, পুকুরে জলে ফেললে কাতলা বোয়াল তোর কোন ভাতার দেয় আমরা দেখব মাগীর গতরে ডাট কোথায় যায় আমরা দেখব তা বাবু আপনাকে অনেক ঘরের কথা বলে ফেললাম কিছু মনে নেবেন না না জানি মাগী আপনার কাছে কী কী জিনিস বন্ধক রেখে কত টাকা হাতিয়েছে হাতিয়ে থাকলেও হাত বাড়িয়ে যে আমরা তা ফেরত দিতে পারব তেমন অবস্থা কিন্তু আমাদের নেই কী বলিস সই

চাচী: বলাবলির আর কী আছে? আমরা তো মাগীর টাকায় খাইও না আর পরিও না বন্ধকে টাকা নিলে সে নিয়েছে তার নিজের জন্য পরিশোধও করবে সে আমরা বাবু তার কোনো দায় নিতে পারবো না সে ফুটানি দিয়ে পারুক আর বাবুর ফুর্তির শখ পূরণ করে পারুক, বন্ধক পরিশোধের দায় তার বন্ধকের ব্যাপারে আমরা কিছু জানিও না, আর জানতেও চাই না বাবু

আশরাফ বোয়ারী: বন্ধকের কারবারী একটা হয়েছে আম্মাজানেরা এই বন্ধকে বন্ধকী আপনাদের বাড়ির আশ্রিত কন্যা বন্ধকের বিনিময়ে প্রণোদনা পাবেন আমার তরফ থেকে আপনারা

চাচী: কথাটার বাংলা মানে কী বাবু?

খালা: মাগী আবার কবে থেকে আমাদের কন্যা আমাদের কন্যাদের বিয়ে যা হয়ে গেছে অনেক অনেক বছর আগে ও আমাদের কন্যা না থাকে খায় পরে এ পর্যন্ত তা বাবা প্রণোদনা পাব কথাটার মানে কী বাবু

আশরাফ বোয়ারী: মানে আপনার বাড়িতে আশ্রিত কন্যাকে আমি বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাই আপনারা যেহেতু আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং লতায়-পাতায় সম্পর্কের দিক দিয়ে তার আত্মীয় তাই সম্মতি পেতে হবে আপনার কাছ থেকে আর সে কারণে আমার তরফ থেকে আপনাদের প্রণোদনা আপনাদের দুজনের জন্য এক ভরি ওজনের এই নিন সোনার বালা আর পছন্দ করে শাড়ি কিনবার জন্য নগদ উভয়কে এক এক দুই হাজার টাকা আগামী শুক্রবার কাজী ডেকে আপনাদের আশ্রিত কন্যাকে আমি ঘরে তুলবো

খালা: এই বালা আমাদের

চাচি: এই টাকা আমাদের

আশরাফ বোয়ারী: হ্যাঁ এই বালা এই টাকা সবই আপনাদের, আমার প্রাণ প্রিয় চাচী-খালাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের সম্মানে আর আপনাদের আশ্রিত কন্যার ডাল-ভাত মোটা কাপড়ের অভাব হবে না মাঝে মধ্যে সিলেট শহরে নিয়ে থিয়েটার-সিনেমা দেখানো হবে বৎসরে দুবার ঢাকা-কক্সবাজারের মতো নগর ভ্রমণ মাসে দুবার রূপ সজ্জার জন্য বিউটি পার্লারেও যাবে আশা করি আপনাদের আশ্রিত কন্যা আমার কাছে ভালোই থাকবে

খালা: ও বাবু এ তুমি কী কথা বলছো মা-বাবা মরা মেয়েটিকে তুমি নিয়ে গেলে আমরা খালা-চাচী কী নিয়ে থাকবো ও ছাড়া আমাদের আর কে আছে ও সই তুই কিছু বলিস না কেন সই

চাচী: তুই ওর খালা তোর বুক পুড়ছে আমার কিছু হচ্ছে না মেয়েটার মুখে চাচী ডাক না শুনে আমি কীভাবে রাতে বালিশে মাথা দেবো ও বাবু, তুমি এসব কী বলছো ছো মেরে ঈগল হয়ে আমাদের শাবক ছানাটাকে নিয়ে যাবে ও বাবু এত নির্দয় তুমি হয়ো না, এত নির্দয় তুমি হয়ো না বাবু

আশরাফ বোয়ারী: আমি নির্দয় হলেও আপনারে আশ্রিত কন্যা বিয়ের পরেও আপনাদের প্রতি দয়াবতীই থাকবে সে প্রতিমাসে দুটো রঙিন শাড়ি, পোলাওয়ের চাল আর পাহাড়ি মোরগ নিয়ে একবেলা দেখা করে যাবে কেমন না-জননী

খালা: সেকি জানি না মেয়েটা আমাদের লক্ষ্মী মেয়েটার মুখে সব সময় একটা বেদনার ছায়া ঘোরে ওকে ছেড়ে আমরা কীভাবে থাকবো বলতে পার বাবু?

চাচী: বাবু তোমার হাতে যখন মেয়েটাকে তুলেই দেবো তখন তো আর কথা লুকিয়ে লাভ নেই শোন বাবু, মেয়েটার উপর যেন অন্য কোনো পুরুষের নজর না পড়ে সেই সতর্ক পাহাড়া দৃষ্টি রাখবার জন্য আমাদের বাড়তি দায়িত্ব পালনের জন্য সিকিউরিটি চার্জ বাবদ খন্দকার জব্বার আমাদের দুজনকে অ্যাডভান্স দশ দশ বিশ হাজার টাকা দিয়েছিল অ্যাডভান্স ডিউটি নিশ্চিত করতে সে টাকা তো আমরা খরচ করে ফেলেছি বাবু এখন যদি মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিতে যাই তবে তো লোন পরিশোধ না করলে মেয়েটা আমার খন্দকার জব্বারের দাদনে আটকা পড়ে যাবে বাবু এখন আমরা কী করবো বাবু! একদিকে কন্যার বিদায়ের শোক আরেকদিকে খন্দকার জব্বারের দাদনের সাঁড়াশি চাপ এক সাথেই দুই চাপ এই বৃদ্ধ বয়সে আমরা দুজনে কীভাবে সামলাবো বাবু আমাদের দুজনেরই আবার গ্যাসের চাপে বুকে ব্যথা

আশরাফ বোয়ারী: গ্যাসের চাপ তো ক্রনিক, রাতারাতি সারবে না বরং আপনারা আশ্রিত কন্যাকে তুলে দেওয়ার শোক সামলাবার জন্য অ্যাডভান্স প্রস্তুতি গ্রহণ করুন আর খন্দকার জব্বারের দাদনের বিশ হাজার টাকা আমি শুক্রবার বিয়ের রাতেই আপনাদের হাতে তুলে দেবো এ নিয়ে অহেতুক আর ভাববেন না তাহলে মা-জননী আমি আসি মেয়ের সাথে আলাদা কথা আর বললাম না নিশ্চয়ই সে সব জানতে পারছে

খালা: কী যে বলো বাবু, আমাদের কথাই মেয়ের কথা পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু কোনোদিন তো কোল ছাড়া করিনি

চাচী: বাবু তুমি যেয়ে নাক ঢেকে ঘুমাও মেয়ের আমার কপাল সত্যি এমন জামাই লক্ষতে একটা মেলে বাবু একটা মেলে চায়ের কারবারী, বন্ধকের কারবারীদের লাইন বসিয়ে দিয়েছি বাড়ির সামনে এমন খালা-চাচি ওকি আর কোনোদিন পাবে খালে ফেলি আর জলে ফেলি আমরা যা বলবো যে ব্যবস্থা করব তাই-ই হবে বাবু যাও বাবু বাড়ি যাও শুক্রবার লাল রঙিন জর্জেট শাড়ি এনে পরিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যেয়ো কেমন, যাও বাড়ি যাও

দৃশ্য: ৫

[আশরাফ বোয়ারী বন্ধকের ঘরে সাইক্লোরমা রূপ দেওয়ালের বক্সগুলোতে বন্ধকী জিনিসগুলোর অবস্থান দেখে দেখে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে পর্যবেক্ষণ শেষে টেবিলের ড্রয়ার খুলে টাকার তাড়ি বের করে টাকার হিসাব মেলাচ্ছে আশরাফ বোয়ারী কপাল কুচকে যাচ্ছে বারংবার কোথায় যেন হিসেবের গরমিল বিশেষ করে একটা পিতলের কলসি আর একটা ভাঙা রেডিও তাকে ভাবাচ্ছে পাশাপাশি টাকার হিসাব মিলছে না অপরদিকে বসত ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ব্লাউজ ম্যাচিং করছে আশরাফ বোয়ারীর বৌ শাবরিনা গায়ে পারফিউমও দিচ্ছে মিউজিকে একবার আশরাফ বোয়ারীর টেনশন অপরদিকে শাবরিনার ঘরে কলরেডিওতে আধুনিক বাংলা গান গানের কথা: যে পাখি ঘর বোঝে না ঘুরে বেড়ায় বন বাদাড়ে... পাখিটার এমন স্বভাব নিজের অভাব পূরণ করে নিজের মতো পাখিটা হাসি খেলে অন্তরালে সুনিপুণ করে কত... আশরাফ বোয়ারী শাবরিনার সাথে কথা বলা শুরু করে]

আশরাফ বোয়ারী: শাবরিনা শাবরিনা কলরেডিও বন্ধ করে এই ঘরে আস

শাবরিনা: আসতে বললেই তো আসতে পারব না সময় লাগবে

আশরাফ বোয়ারী: তোমাকে আমি অসময়ে ডাকিনি দরকার বলেই ডাকছি

শাবরিনা: দরকারটা যখন তোমার তখন এখানে আসলেই হয়

আশরাফ বোয়ারী: শাবরিনা ডেকেছি আমি

শাবরিনা: বেরোতে হবে আমাকে

আশরাফ বোয়ারী: বেরোতে হবে তোমাকে কেন স্টেশনে কি ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখেছ

শাবরিনা: ট্রেন দাঁড় করিয়ে রাখি না ট্রেন আমার জন্য বসে থাকে

আশরাফ বোয়ারী: স্টেশন মাস্টার তো আমি নাকি!

শাবরিনা: আমিই প্যাসেঞ্জার, ট্রেনই আমার

আশরাফ বোয়ারী: তা হলে আমার ডাকে আসবে না

শাবরিনা: অহেতুক কথা বলার এনার্জি আমার নেই

আশরাফ বোয়ারী: আমার মনে হয় অনেক এনার্জি আছে হিসাবের গরমিল মিলানোর

শাবরিনা: মাথা থাকলে মাথা ব্যথাও থাকবে

আশরাফ বোয়ারী: মাথা ব্যথার কারণ যখন তুমি

শাবরিনা: কী কারণ শুনি

আশরাফ বোয়ারী: আজকেও তুমি পিতলের কলসি বন্ধক রেখেছো

শাবরিনা: যে কলসি কিনে দিতে পারেনি তার কলসি নিয়ে কথা না বলাই ভালো

আশরাফ বোয়ারী: তাহলে ভাঙা রেডিও বন্ধক রাখলে কেন? কলরেডিও তো আছে

শাবরিনা: কলরেডিও রেডিও আছে

আশরাফ বোয়ারী: কলসি, রেডিওতে কত টাকা দিয়েছো?

শাবরিনা: ক্যাশে যে টাকা গুনে কম হচ্ছে সেটাই দিয়েছি বুঝতে অঙ্ক বিশারদ হওয়া লাগে না

আশরাফ বোয়ারী: গিন্নিপনা একটু কম করো, হিসাবটা বলো

শাবরিনা: বলছি তো টাকা সরাইনি

আশরাফ বোয়ারী: তাতে সব বলা হয়ে যায় না তোমায় বলেছি আমার বন্ধকের কারবারীতে নাক গলাতে এসো না

শাবরিনা: নাক আমি গলাইনি কাস্টমার যাতে নাক না গলায় তার ব্যবস্থা করেছি

আশরাফ বোয়ারী: বললেই তো হতো আমি ব্যবসার কাজে শহরে গেছি

শাবরিনা: আগেই তো বলেছি দোকান ঘর আলাদা হোক

আশরাফ বোয়ারী: এই ব্যবসায় চব্বিশ ঘণ্টায়ই দোকানদারী

শাবরিনা: সেটা দোকানদারের, গৃহিণীর না

আশরাফ বোয়ারী: যা বলতে চাইছি তাই যখন নিজে থেকে বুঝছো তখন এই বন্ধকীতে হাত দিচ্ছে কেন?

শাবরিনা: হাত দেবো না বলে তো কারও কাছে নাখে খত দেইনি

আশরাফ বোয়ারী: শাবরিনা, তুমি কিন্তু তোমার সীমানার বাইরে বেরিয়ে কথা বলছো

শাবরিনা: যে বলছে সেও যেন জানে তার সীমানা

ন (আশরাফ বোয়ারী বসত ঘরে এসে শাবরিনার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে) ক্যাশে পাঁচ হাজার টাকা কম পিতলের কলসি, ভাঙা রেডিও বন্ধকী হিসাবে বড়োজার দেড় হাজার টাকা হতে পারে কোনো অবস্থায় পাঁচ হাজার টাকা না এভাবে বেহিসেবী হয়ে বন্ধকের কারবার করলে একদিন আমাদের জিনিসপত্রই বন্ধক রেখে লোকের কাছে টাকার জন্যে হাত পাততে হবে আমি শুধু তোমাকে শান্তভাবে বলতে চাইছি, তুমি সংসারে মন দাও, ব্যবসাটা আমি সামলাই আমার এই কথাটুকু বলতে চাওয়া কি আমার সীমানার মধ্যে দাঁড়িয়ে বলা না

শাবরিনা: আমি এখন বেরুবো সংসার মানে শুধু জমা খরচার হিসাব না সংসার মানে বীজ বপন এবং ফসল উৎপাদন সেই মুরোদ যার নেই সে আবার আমার কৈফিয়ত তলব করে

আশরাফ বোয়ারী: ডাক্তার তো বলেছে চিকিৎসার একটা পর্বে সব ঠিক হয়ে যাবে

শাবরিনা: যখন হবে তখন কথা হবে

আশরাফ বোয়ারী: তাহলে এখন তুমি ঐ ডাক্তারের সাথে এই অবজ্ঞার প্রসঙ্গ দিয়ে আমাদের দাম্পত্য জীবনটাকে ঘায়েল করেই চলবে

শাবরিনা: পাকা অভিনেতার পক্ষে অভিনয়ের বাইরে আর কিছু থাকে না অভিনয় দিয়ে সকলের মন ভোলানো চলে, আমার না অভিনয় পারে কিন্তু অভিনয়ের দলে ঠাঁই জোটে না, বহিষ্কৃত হয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় আবার আমার কৈফিয়তের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় কথা বলার রুচি যেখানে হয় না সেখানে আবার কৈফিয়ত

দৃশ্য-৬

[একটা নাটকের রিহার্সেল রুমের আদল মঞ্চের বন্ধক রুম এবং বসত রুমের সম্মুখে উপর থেকে মঞ্চের পর্দা নামানো লাইট রুম থেকে একটা বৃত্ত আলো নৃত্য শাবরিনা কে ধরেছে নৃত্য করছে শাবরিনা নৃত্যে সঙ্গও দিচ্ছে সাইফুল খান আলোর বৃত্তের বাইরে ফাস্ট উইংসের পর্দার আড়াল থেকে সব দেখছে শুনছে আশরাফ বোয়ারী নৃত্যের কথা: আমি এক এমন পাখি বুকেতে কষ্ট রাখি যেন আমি সুখ নিবাসী... নৃত্য শেষে প্রথমে শাবরিনা আর সাইফুল ইসলামের মধ্যে কথা হয় শেষ দিকে আশরাফ বোয়ারী কথা বলে]

সাইফুল ইসলাম: একই অঙ্গে এত রূপ তোমার শাবরিনা এভাবে এই চা বাগানে তোমাকে আমি ঝরেপড়া পাতার মতো ঝরে পড়ে যেতে দিতে পারি না

শাবরিনা: রূপের কী দেখলেন

সাইফুল ইসলাম: দেখলাম নৃত্যের তরঙ্গ ভঙ্গিমায় মরুতে ঝরনা ধারা খাড়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর স্রোতধারা আকাশের নীলিমায় রংধনুর বর্ণালি ধারা তোমাকে আমি মঞ্চ মিডিয়ায় এমনভাবে তুলে ধরব যে তোমার রূপ যৌবনের দাবানলে ঘিয়ের মতো গলে যাবে নয় থেকে নব্বইয়ের সব পুরুষ-নারী দর্শক শ্রোতা

শাবরিনা: দর্শক শ্রোতা আসবে আমায় দেখতে

সাইফুল ইসলাম: আসবে না তোমার ঘিয়ে রং-এর চামড়া ম্যাচিং স্কিন টাইট নাইটি আর উপরে ডিফ রেড স্কাট পরিয়ে যখন দামাদাম মাস্কেলেন্ডার গানের সাথে ডলবি সাউন্ড আর ইপার্ক আলো ফেলবো না তখন তুমি শাবরিনা হয়ে যাবে সব কামুক পুরুষের হৃদয়ের রানি

শাবরিনা: শুধুই নেচে রানি, কথা-বার্তায় কি আমার সাম্রাজ্য পরিচালনার কিছু থাকবে না?

সাইফুল ইসলাম: থাকবে না মানে তোমার পেছনে কুড়িটা ছেলে মেয়ে কোলে মাথায় ভরা কলসি নিয়ে হেলে দুলে চলবে আর তোমার গায়ে মাথায় পুষ্প ছিটাতে ছিটাতে নিজেরা ধন্য ধন্য করবে

শাবরিনা: আমি কি শুধু ছেলেমেয়ের মা হবো?

আশরাফ বোয়ারী : ওরে পাগলি আমার মেয়ে কি শুধু কন্যার মা হয় রে সে তো বউও হয় মঞ্চে হবে তোমার হাতেখড়ি টেলিভিশনে হতে তোমার পরিচিতি আর সিনেমায় হতে তোমার খ্যাতি তুমি কাজ পেয়েছো তা তুমি জান না আমি সাইফুল ইসলাম মঞ্চ মিডিয়া নিয়ে আমার কারবার চা বাগান থেকে তোমাকে আমি যদি জংগলে নিয়ে না ফেলি তবে, যেন আমি তোমার হাতের সব বালা নিজেই নিজের হাতে পরি আর তোমাকে নিয়ে যারা লিখবে, ছবি তুলবে সেরকম সাংবাদিক তো আমার পকেট ঝারলেই পরে ভূরি ভূরি আমার মতো নায়কের সাথে যখন তুমি নায়িকা তখন তোমায় দেশ বিদেশের কারোরই চিনতে এক তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা থাকবে না

শাবরিনা: ফাঁকা থাকার পরে যদি অন্য কেউ নায়িকার জায়গা করে নেয়

সাইফুল ইসলাম: ঘড়ির লাটাই যে আমার হাতে তা কেন তুমি বোঝো না অন্য নায়িকার সুতা আমি কেটে দেবো যদি তুমি আমার বুকের মাঝখানে বাসা বাঁধো

শাবরিনা: কোন চরিত্রের কোন ভাষা সেসব না জেনে কীভাবে বুকে বাঁধবো বাসা?

সাইফুল ইসলাম: অভিনয়ের চরিত্র তো পরে আগে বাস্তবে তুমি আমারে দাও ধরা

শাবরিনা: অভিনয় আর বাস্তব কি আলাদা বাস্তবিকভাবেই তো আমি অভিনয়টা করব কিন্তু তার আগে আমার চরিত্রটা কি সে তো আমাকে বুঝিয়ে দেন

শাবরিনা: অভিনয় নিয়ে কথা হচ্ছে না কথা হচ্ছে বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী যা করে তাই তুমি করো আমার সাথে

শাবরিনা: একি অভদ্রতা আমি কেন আপনার সাথে স্বামী-স্ত্রী, স্বামী-স্ত্রী বাস্তবতা করবো আমার নিজেরই তো স্বামী আছে আমার যা-কিছু বাস্তবতা সে তো তাকেই ঘিরে তার বাইরে আমি তো কাউকে নিয়ে অন্য কিছু ভাববো না

সাইফুল ইসলাম: না ভাবলে তো আমারও ভাবনা এগুবে না কিছু পেলে তো কিছু দিতে হবে

শাবরিনা: দেয় তো, আমার স্বামী বন্ধকের বিপরীতে কাস্টমারকে তার প্রাপ্য দেয় কাউকে তো খালি হতে ফেরায় না আমি অভিনয় করলে আপনিও তেমনি আমার প্রাপ্য সম্মানী আমাকে দেবেন

সাইফুল ইসলাম: তোমার স্বামী আশরাফ বোয়ারী কী দেয় তোমাকে সে একটা কিপটে, কঞ্জুস স্বার্থের বাইরে সে কিছুই দেয় না

শাবরিনা: তিনি কিপটেও না, কুঞ্জুসও না তিনি ব্যয় সংকোচনে বিশ্বাসী তিনি মিতব্যয়ী

সাইফুল ইসলাম: তাকে তো আমার দল থেকে বের করে দিয়েছি

শাবরিনা: আমার স্বামীর দল দরকার হয় না সে নিজেই একটা আস্ত দল

সাইফুল ইসলাম: তোমার মতো রূপসী, সুন্দরী নারীর যোগ্য স্বামী সে কিছুতেই না

শাবরিনা: আপনারা অভিনেতা, রূপ সৌন্দর্য না থাকলে দর্শক আপনাদের অযোগ্য ভেবে দূরে ঠেলে দেয় সংসারে স্ত্রীদের মনের রূপ সৌন্ধর্যের মূল্য দিতে যারা জানেন তাদের চেয়ে বড়ো যোগ্য স্বামী আর কে আছে আমার স্বামী আমার দেখা সেরা স্বামী যোগ্যদের মধ্যে যোগ্যতর স্বামী

[আশরাফ বোয়ারী পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে সোজা শাবরিনা এবং সাইফুল ইসলামের সম্মুখে হঠাৎ ঢুকে পড়ায় দুটো মানুষ প্রথমটায় থতমত খেয়ে চুপসে গেল থমকে গেল আশরাফ বোয়ারীর অনাকাক্সিক্ষত প্রবেশে উভয়ে অপ্রস্তুত কথা বলা শুরু করলো সাইফুল ইসলাম এবং আশরাফ বোয়ারী]

সাইফুল ইসলাম: বড়ো ভাই, আপনি আমার রিহার্সেল রুমে কী সৌভাগ্য আমার যে আপনার হাতে আমার হাতেখড়ি আমার অভিনয় প্রশিক্ষণ, আজ আমার যে উত্থান-প্রতিপত্তি-পরিচিতি সে সবই তো বড়ো ভাই আপনার জন্য সেই আপনিই আজ এসেছেন আমার এই পর্ণ কুঠিরে বড়ো ভাই আপনার উপস্থিতিতে আমি ধন্য দেন বড়ো ভাই একটু আপনার চরণধূলি দেন

আশরাফ বোয়ারী: সাইফুল তুই এই সিলেটের চা বাগানে কেন?

সাইফুল ইসলাম: ছি বড়ো ভাই, আপনি আপনি আমায় তুই কেন বলছেন আমি তো আপনার স্নেহের সাইফুল সমাজে আমার একটা সম্মান আছে তাছাড়া সহশিল্পীর সামনে তুই না আপনি আমাকে তুমিই সম্বোধন করেন

আশরাফ বোয়ারী: তোকে যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দে

সাইফুল ইসলাম: এভাবে কথা বললে উত্তর দিতে আমার আপত্তি তবুও আপনি যেহেতু আমার এক সময়ের অভিনয় শিক্ষাগুরু তাই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে বাধ্য আমি এখানে এসেছি বিসর্জন নাট্যদলের আমন্ত্রণে অভিনয় প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করতে

আশরাফ বোয়ারী: অন্য অভিনয় শিল্পীরা কোথায়?

সাইফুল ইসলাম: তারা আসবে যথাসময়ে

আশরাফ বোয়ারী: এখন কোন সময়

সাইফুল ইসলাম: এখন অভিনয়ের প্রিওয়ার্ক বিশেষ অভিনেত্রীর বুস্ট আপ ট্রেনিং

আশরাফ বোয়ারী: চরিত্রের নাম কী? নাটকের নাম কী?

সাইফুল ইসলাম: বড়ো ভাই আপনি এভাবে একের পর এক জেরা করতে পারেন না আমার একটা পরিচিতি আছে শিল্পী সমাজে আমি একজন গণ্যিমান্য ব্যক্তি আপনি আমাকে যথাযথ সম্মান দিয়েই কথা বলেন

আশরাফ বোয়ারী: এতক্ষণ তুই শাবরিনাকে কী বলছিলিস কীসের জন্য ফুসলাচ্ছিলিস?

সাইফুল ইসলাম: কই, আমি, না তো আমি আবার কী বলেছি আমি তো শুধু দেখলাম তার নৃত্যের স্টেপের সাথে সংগীতের ভাষা মেলে কি না এখানে ফুসলানোর কথা আসে কীভাবে বড়ো ভাই ছি ছি বড়ো ভাই, আপনি, কিন্তু একজন সুনাম ধন্য শিল্পীকে অ্যাক্টিংয়ের অন ডিউটির মাঝে অনুপ্রবেশ করে ইনসাল্ট করছেন ইটস ভেরি মাচ ইনজাস্টিস

আশরাফ বোয়ারী: ইনজাস্টি, জাস্টিস শিখতে হবে তোর মতো একটা লুচ্চা লম্পটের কাছ থেকে বারো বছর আগে তুই কুসুম কলির দিকে হাত বাড়িয়েছিলি সেদিন তোকে কিছু বলিনি বারো বছর পর আজ আবার তুই সেই হাতকে থাবা বানিয়ে অগ্রসর হয়েছিস আমার স্ত্রী শাবরিনার দিকে আজ তোর কী প্রাপ্য বল

সাইফুল ইসলাম: বারো বছর আগে কুসুম কলির দিকে আমি হাত বাড়ায়নি বরং আপনার হাত থেকে বাঁচাতে সে আমার হাত ধরেছিল বারো বছর পরে যাকে আপনি স্ত্রী বলছেন সে আপনার কাছে স্ত্রী হতে পারে কিন্তু সে আমার কাছে শুধুমাত্র একজন অভিনয় শিল্পী তার মতো অনেককে মেরে পিষে গড়ে তোলাই আমার কাজ ছিল শ্রদ্ধা-সম্মান ব্যতিরেকে আর কীই-বা আমার প্রাপ্য হতে পারে বড়ো ভাই বড়ো ভাই আপনি ঐ টুলটাতে বসেন আমাদের রিহার্সেল দেখেন কেউ নেই যে আপনার জন্য চা আনতে বলবো

আশরাফ বোয়ারী: সাইফুল চা আমি অবশ্যই খাবো তার আগে তোর হিসাবটা ক্লোজ করতে চাই তুই পরিচয় দিস শিল্পী বলে শিল্পী আসলে কী? শিল্পী লেখক কবিরা হলো জাতির বিবেক জাতির সভ্যতা অভিমুখী পথচলাকে মসৃণ সুশৃঙ্খলার আলোকে এগিয়ে নেওয়াই শিল্পীদের কাজ আর তোর মতো বদমায়েশ শিল্পীর মুখোশে থাকে একটা ভদ্রবেশী টাউট-লম্পট-বাটপার লোভ-কৌশল আর চাতুরি দিয়ে তুই সম্ভাবনাময় কচি কচি মেধাবীদের পথভ্রষ্ট করিস বারো বছর আগেও করেছিস বারো বছর পরেও একইভাবে করতে চলেছিস বারো বছর আগে কুসুমকলির প্রশ্নে আমি তোকে কিছু বলিনি কারণ সেদিন সে ছিল শুধুমাত্র আমার দলের একজন অভিনয় সহশিল্পী তার ব্যক্তি জীবন নিয়ন্ত্রণের তার জীবনের উপর অধিকার ফলবার মতো কোনো সম্পর্কে আমি বাধা ছিলাম না কিন্তু এবার তোর সর্পিল জিহ্বা কেটে ফেলতে কাউকে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না আমার এই পিস্তলে তিনটি বুলেট লোডেড তোকে আমি মাত্র তিন ঘণ্টা সময় দিচ্ছি এখনই এখান থেকে বের হবি সোজা বাসস্ট্যান্ডে যাবি টিকিট কেটে বাসে চড়ে সিলেট ছাড়বি এর বাইরে অন্যকিছু ভাবলেই তোর লুচ্চা মুখ ফুটো করবো এক এক এক তিনবার টাইম কাউন্টিং স্টার্ট নাউ ওয়ান...

সাইফুল ইসলাম: বড়ো ভাই, বড়ো ভাই একী করছেন একী করছেন যেতে হলে যাব তার জন্য টাইম কাউন্টের কী আছে বাসে না যেয়ে বিকেল চারটার ট্রেনে গেলে হতো না বাসে আবার আমার বমিটিং ভাব আসে তো তাই বলছিলাম ...

আশরাফ বোয়ারী: টু ...

সাইফুল ইসলাম: ছি ছি বড়ো ভাই জুতোটা তো পড়তে দেবেন আমার কাছে মঞ্চ আর রিহার্সেল উভয়ই তপস্যার মন্দির জুতো খুলে খালি পা ছাড়া আসি না বড়ো ভাই থ্রি গুনতে হবে না আপনি বড়ো ভাই একটা অনুরোধ করেছেন, সেকি আমি শুনবো না অবশ্যই শুনবো এখান থেকে বের হচ্ছি সোজা বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছি, বাসে চড়ছি তা হলেই তো আমি হচ্ছি সিলেটছাড়া বড়ো ভাই আমি ভুলিনি আপনি আমার নাট্যগুরু আপনার অনুরোধই আমার নির্দেশ আমি তাহলে আসি বড়ো ভাই আমি আমার কি একটা কাজ করলে চলে আমার যে ব্যস্ততা বড়ো ভাই গুড বাই, বড়ো ভাই, গুড বাই

[সাইফুল ইসলাম অভিনয় ভঙ্গিমায় অপমান লুকিয়ে পালিয়ে যায় শাবরিনা মাথা নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে শানে বিরিদাগ কেটে চলে]

আশরাফ বোয়ারী: শাবরিনা তুমি জ্ঞানী, প্রজ্ঞা এবং স্বাধীনচেতা তোমাকে আমার কিছু বলাই সাজে না তাছাড়া আমি কাউকেই কোনোদিন কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দিইনি, দিতে চাইও না তাছাড়া কীই-বা করতে পারি শাবরিনা আমি একটা সত্য বুঝে গেছি শিকল পরিয়ে একটা মানুষের দেহকে আটকালেও আটকানো যায় কিন্তু মানুষটার মনকে আটকাবো কী দিয়ে তাকে বেঁধে রাখবো কী দিয়ে জীবনভর কম্প্রোমাইস করা ছাড়া আমরা মানুষেরা আর কীই-বা করতে পারি শাবরিনা শাবরিনা আজ থেকে কোনোভাবেই কোনোকিছুতে আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না তুমি সম্পূর্ণত স্বাধীনভাবেই তোমার জীবন কাটাবে আমরা এক ছাদের তলায়ই থাকবো কিন্তু যে যার মতো করে থাকবো চল শাবরিনা বাড়ি চল তুমি একটু আগে বাড়ি যাও আমি একটু বাজার হয়ে আসি আজ যে আমাকে আরেকটা খাট কিনতে হবে ঘর একটা শুধু দুটো বিছানা চল শাবরিনা ঘরে চল

[শাবরিনা আগে বের হয় মাথা নিচু করে আর আশরাফ বোয়ারী ঘরে চন্দ্রবৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে আনমনে বের হয়ে যায়]

দৃশ্য : ৭

[বন্ধকের কারবারী ঘরের সম্মুখে ইজি চেয়ারে দর্শকমুখীভাবে বসে আছেন আশরাফ বোয়ারী চোখ তার বন্ধ বসত ঘরে দুটি বিছানা একটাতে চিত হয়ে শুয়ে আছে শাবরিনা শাবরিনা ঘুম ভেঙে ওঠে এ-ঘর সে-ঘর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে শাবরিনা আশরাফ বোয়ারীর অবস্থান ভালোভাবে দেখে নেয় শাবরিনা তারপর বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে বন্ধকের ঘরে ঢুকে আড়াল থেকে পিস্তলটা নেয় আরও নিঃশব্দে বন্ধকের ঘরের বাইরে এসে ইজি চেয়ারের উপর ঘুমন্ত আশরাফ বোয়ারীকে ভালোভাবে দেখে নেয় শাবরিনা তারপর দুই হাত দিয়ে শক্তভাবে বন্দুকটা চেপে আশরাফ বোয়ারীর কপালের ঠিক মাঝখানে তাক করে শাবরিনা ধীরতাল হয়ে চূড়ান্ত পিকে ওঠে টেনশান মিউজিক পিকের একটা মুহূর্তে হঠাৎ করে চোখ খোলা আশরাফ বোয়ারী কিংকর্তব্যবিমূঢ় আশরাফ বোয়ারী হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে আশরাফ বোয়ারী তারপর ধীর কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে কথা বলে চলে আশরাফ বোয়ারী]

আশরাফ বোয়ারী: শাবরিনা টিগারে টিপ দিতে কার্পণ্য বোধ করো না যদি তোমার মনে হয় এই পরিণতি আমার প্রাপ্য তবে তুমি নিঃসকোচে শ্যুট করো আমার চাঁদের কন্যা, সোনা জাদু, আমার লক্ষ্মী বউ শাবরিনা তোমাকে ভালোবাসি শুধু একদিনের জন্য নয়, তোমাকে ভালোবাসি বরাবরের জন্য তোমাকে ভালোবাসি বলেই একদিন তোমার দজ্জাল চাচা-চাচী খালার হাত থেকে রক্ষা করে তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে এনেছিলাম তোমাকে সুখী করার জন্য আমার মতো একজন মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব তার সবটুকুই করেছি যে তোমাকে আঁকড়ে আমার বাঁচামরা সেই তোমার হাতের আঙুল যখন পিস্তলের ট্রিগারে তখন আমার বাঁচার চেষ্টা করাটাই আত্ম-অপমান তোমার কাছ থেকে ফুলের পাপড়ি পেলেও আনন্দ, ফুলের কাঁটার আঘাতও আনন্দ আমি তোমার বিপদেও, আমি তোমার সম্পদেও আমি তোমার আপন জীবনেও, আমি তোমার আপন মরণেও শাবরিনা, আমি চোখ বুজে আছি শাবরিনা তুমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করো শাবরিনা তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা জীবনে, অন্তে, জনম-জনমে আই লাভ ইউ শাবরিনা

[আশরাফ বোয়ারী বরফ শীতল মুখাবয়বে কপাল পেতে, চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে বরণ করার অপেক্ষায় শাবরিনার মুখ প্রথমে ঘামে, তারপর দুই হাত ঘামে এবং সর্বশেষে কাঁপতে কাঁপতে শাবরিনা ছিটকে একটু দূরে পড়ে যায় বন্দুক নিচে পড়ে যায় শাবরিনা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে বন্ধকের দরজা, বন্ধকের টেবিল, ট্রান্সপারেন্সি গ্লাস, বসার ঘরের খাট ধরে ধরে নিজের বিছানায় যেয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে আশরাফ বোয়ারী ধীরে ধীরে চোখ খুলে একটু ধাতস্থ হয়ে বন্দুকটা তোলে ধুলো ঝেড়ে বন্দুকটা নিয়ে কণ্ঠে তুলে নেয় লায়নার একটি গান গানের কথা: ‘এই গগনেতে ডাকে দেওয়া, আসমান হইলো আন্ধিরে বন্ধু, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি, সোনা, বন্ধুরে, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’ গানটি গাইতে গাইতে আশরাফ বোয়ারী বন্ধক রুমে ঢুকে বন্দুকটি বন্দুকের জায়গায় রেখে বন্ধকের চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে টেবিলের উপর মাথা নুইয়ে শুইয়ে পড়ে মঞ্চের আলো নিভে যায়]

দৃশ্য: ৮

[দুপুরের পর থেকে বিছানায় শায়িত শাবরিনা প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে ভুল বকা শব্দ-বাক্যের চিৎকারে বন্ধকের টেবিল থেকে লাফিয়ে ওঠে আশরাফ বোয়ারী সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শব্দের চিহ্নস্থল নিশ্চিত হয়ে শশব্যস্ত হয়ে ঢোকে আশরাফ বোয়ারী দ্রুত শাবরিনার কাছে যেয়ে মাথায় হাত রেখে বোঝে প্রচণ্ড জ্বরে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য শাবরিনা আশরাফ বোয়ারী খাটের তল থেকে বালতি জগ বের করে বন্ধকের ঘর থেকে বের হয়ে মঞ্চের বাইরে যেয়ে পুনঃভরা বালতি নিয়ে ঘরে ঢোকে আশরাফ বোয়ারী শাবরিনাকে দর্শকদের দিকে চিত করে মাথা পাতিয়ে, মাথার তলে ক্লত বিছিয়ে ঠান্ডা জল ঢালতে থাকে একদিকে শাবরিনার ভুল বকা অপরদিকে আশরাফ বোয়ারীর সান্ত্বনা দেওয়ার প্রচেষ্টায় টেনশনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়ে চলে]

শাবরিনা: ওমা ওমা ছায়েম সাত্তার গেটি বাঁকা করে শটি বনে পড়ে আছে ও খালা তোমার শাড়ি পরে দৌড়াচ্ছে সাইফুল ইসলাম হি হি হি আমার বড়শি চেয়ে নিচ্ছে ম্যানেজারের ছাগল ওবাবা ওবাবা আমার ভয় করছে তুমি তো সন্ধ্যে বেলায় মরে গেলে এখন এলে কীভাবে ওবাবা তোমার পা নেই কেন ওমা আমার ভয় করছে আমার ভয় করছে, ভয় করছে

আশরাফ বোয়ারী: কোনো ভয় নেই শাবরিনা তোমার পাশে আমি আছি, আমি আশরাফ বোয়ারী আছি তোমার কোনো ভয় নেই

শাবরিনা: ওমা হারিকেনের সলতে নিয়ে যাচ্ছে খন্দকার জব্বার চাচী-খালা আমার শায়া ধরে টানছে বন্ধকের দোকানে লুট হয়ে গেল আমার মেকাপবক্স

আশরাফ বোয়ারী: কিছু লুট হয়নি শাবরিনা তোমার মেকাপবক্স এখন তিন দেশের তিন কোম্পানির তোমার যত দরকার তত এনে দেওয়া হবে শাবরিনা

শাবরিনা: মঞ্চের উপর দাপাচ্ছে তিন ভূত ভাত দে, ভাত দে, ভাত খা

আশরাফ বোয়ারী: তোমার অনেক জ্বর শাবরিনা গরমে তালু পুড়ে যাচ্ছে এই জল ঢালায় মাথা শীতল হলে সব ঠিক হয়ে যাবে

শাবরিনা: ওমা আমার ছেলেটা সবুজ ঘোড়াটা ধরতে যে কোথায় গেল

আশরাফ বোয়ারী: ছেলেটা আসবে তোমার কোল আলো করে

শাবরিনা: শোনেন, সাইফুল হারিকেনের আগুন দিয়ে গায়ে হলুদের হলুদ পুড়িয়ে খাচ্ছে

আশরাফ বোয়ারী: কিছু পোড়েনি, কিচ্ছু হয়নি তোমার শাবরিনা ঐ সাইফুল আর কোনোদিন এমুখো হবে না

শাবরিনা: মঞ্চের স্পট আলোয় কে আমার ঝলসায় চারিদিকে আগুন আর আগুন জল দাও ওগো জল দাও

আশরাফ বোয়ারী: খাও শাবরিনা জল খাও মাথায় জল ঢালছি মুখে করে জল খাও ভেতরে বাইরে শীতল হও শীতল হলে সব কিছু আমাদের ঠিক হয়ে যাবে শাবরিনা বিশ্বাস কর বউ তোমার কিছু হয়নি আমি ঐ সাইফুল খানের সাথে তোমায় দেখে কিছু মনে করিনি দলে যা কিছু ঘটেছে সেখানে আমার কিছু করার ছিল না বউ তুমি তো আর দশটা মানুষের সাথে মিশতেই পারো তাই না এতে লজ্জা কী? তুমি পিস্তল তাক করেছ এতেও আমি কিছু মনে করিনি মনে করার কিছু নেই তাই মনেও করিনি তোমার রাগ হলে রাগের প্রকাশ করবে না সেটাই বা কেমন কথা একবার আমিই তো আমার মাকে দাও দিয়ে দাবড়িয়েছিলাম কারণ মা আমাকে ঐটুকু শিশু বয়সে কাচা ঘুমের মধ্যে টেনে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছিলেন ঐ দাউ নিয়ে দাবড়ানো কি সত্যি ছিল ওটা তো ছিল রাগের বহিঃপ্রকাশ এবং সবটাই ঘুমের ঘোরে অবচেতনে যেই চেতন হলাম তখনি অনুশোচনা, কী অনুশোচনা আর তোমার তো অনুশোচনারও কোনো কারণ নেই কারণ ঐভাবে রিহার্সেলের রুমে আমার ঢুকেপড়া ঠিক হয়নি আমি তো তোমায় জিজ্ঞাসা করেই জেনে নিতে পারতাম তোমার আত্মসম্মানে আঘাত করাটা আমার ঠিক হয়নি ফলে রাগত হয়ে তোমার পিস্তল তাক করাটায় তুমি আর লজ্জিত হয়ো না সংসার করতে গেলে, সংসারে এক সাথে থাকতে গেলে এরকম টুকটাক সংঘাত-সংঘর্ষ তো হয়েই থাকে তাই বলে তো আমার দিকহীন, দিশাহীন হয়ে পড়লে চলবে না কৃতকর্মের মধ্যে দিয়ে হয় অভিজ্ঞতা; অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি আর উপলব্ধির ভিত্তিতে বর্জন-সংযোজন এবং সম্প্রসারণ জীবন মানেই তো বর্জন-সংযোজনের মধ্যে দিয়ে সামগ্রিক সম্প্রসারণ বউ, আমি তো তোমায় ভালোবাসি তুমি তো ছোটো মানুষ বিপদে সম্পদে তোমাকে দেখে শুনে রাখার আর কেই-বা আছে বউ, আমি কিছুতেই কিছু মনে করিনি কালকেই বউ আমি তোমায় নিয়ে দূরে যাবো এই সিলেট চা বাগান থেকে গ্রীনলাইনে চেপে ঢাকা যাবো সেখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সোজা কক্সবাজার সমুদ্রের জলে গা ভাসাবো বাতাসে তোমার খোপার চুল উড়বে সমুদ্রের পাশে রিসোর্টে বসে তোমাকে তোমার পছন্দের রূপচাঁদা মাছ খাওয়াব মাছের ঝোলে যদি বালির দানা লুকিয়ে থাকে, তবে আমি বেছে বেছে তোমায় খাওয়াব আমি আজ রাতেই বাসের টিকিট কাটতে যাবো আহারে বউয়ের আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে

দৃশ্য-৯

[বসতঘরে বিছানা দুটোকে একত্রিত করে শোয়ানো শাবরিনার রক্তাক্ত মৃতদেহ মুখপানে চেয়ে কোলের পাশে বসা আশরাফ বোয়ারী আশরাফ বোয়ারীর মুখ ঘর্মাক্ত দেহের পোশাকে রক্তাক্ত দৃশ্যের শুরুতে শিবরঞ্জনী রাগ বেজে চলেছে শিবঞ্জনী রাগের শেষে আশরাফ বোয়ারী অন্তিম স্বগতোক্তি]

আশরাফ বোয়ারী: বাসা থেকে বাস কাউন্টার তো মাত্র পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ এইটুকু পথ আমি পাড়ি দিতে কেন গেলাম আমি গেলাম কিন্তু মনটা তো আমার পড়ে ছিল ঘরে, বউয়ের কাছে ঘরে বউ একলা একলা ঘরে বউকে রেখে আসতে মনটা কিছুতেই চাইছিল না তবু আমি তো জানি, এখানে থাকলে বউ আমার কিছুতেই ভালো হবে না স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী করে তুলবে তাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য হলেও দূরদেশে আমাকে যেতেই হবে তাকে রক্ষা আমাকে করতেই হবে দেখলাম কী অপূর্ব সুন্দর তার হাতের কাজ একটা পাখি নীড়ে ফিরছে পাখিটির উপর তার হাতের নিপুণ সেলাই কিন্তু যেতে যেতে হঠাৎ করে মনে আমার বজ্রঘাত খেলে গেল কী হলো! বউ আমার গান গাইলো এই পৃথিবীর পান্থশালায় বারে বারে আসা যাওয়া/কেউবা হারায় কেউ খুঁজে পায় জীবনের চাওয়া পাওয়া... বউ আমার গান গাইলো তাও আবার আমার সামনে কই বউ তো কখনো আমার উপস্থিতিতে আমার সামনে গান গায়নি, গান গাইবার সাহস করেনি গাইলো তার মানে বউ আর আমার তার নিজের মধ্যে নেই সে যা করছে তা সে নিজে জেনে বুঝে করছে না এই অবস্থায় আমি বউকে ঘরে একলা ফেলে এসেছি এ আমি কী করলাম আমি আবার বাড়ির পথে পা বাড়ালাম দ্রুত হাটা শুরু করলাম চারিদিকে গভীর রাত দ্রুত হেঁটে হেঁটে বাড়ির কাছে আসতেই দেখি বাড়ির মুখটায় জটলা এত মানুষ এল কোথেকে, এলই-বা কেন বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো মাথাটা ক্ষণিকের জন্য ঘুরে গেল চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম ভিড় থেকে কে একজন যেন আমায় দেখে বললো, পাঁচটা মিনিট আগে এলে এত বড়ো বিপদ ঘটতো না পাঁচটা মিনিট আগে কেন এলেন না আর কে একজন বললো, আমরা বারণ করে চেচাচ্ছিলাম বন্দুক নামাও মা, বন্দুক নামাও তুমি গুলি করো না তবু সে ট্রিগারে চাপ দিল চিবুক হয়ে তালুতে গুলি ছুটলে কি একটা মানুষ বাঁচে? চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সামনের সব আলো একে একে নিভে গেল আমি যেন হাজার ফুট গভীরে এক খাদে পড়ে গেলাম পড়ার মুহূর্তেও ভিড়ের মাঝে একটি লোকের কথা এখনও কানে বাজে, নাক মুখ কান দিয়ে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছে জ্ঞান ফিরলে বউকে বন্ধকের ঘর থেকে পাঁজাকোলা করে এই বসতঘরে তুলে নিয়ে এসেছি কীভাবে এসেছি ভালো মনে নেই আজ এই ঘরে দুই বিছানায় একা শুয়ে আমার বউ কিন্তু আমার এই ঘর তো আমার বউয়ের ঘর এই ঘর আমার আর আমার বউয়ের কাল সকাল হলে মানুষ এসে খাটিয়া সাজায়ে মাটি দেবার জন্য নিয়ে যাবে বউ চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকবো বউটা তো আমার মরে গেল কেউ বলে জগতে ভালো যে হতে চায় তাকে ভালো হতে দিন এমন ভালো কথা কে বলে ভালো হয়ে কি সত্যিই ভালো থাকা যায় রাত এখন কটা বাজে বারোটা একটা না তিনটে সময়গুলো কীভাবে গুলিয়ে গেল বউটা আমার মরে গেল এখন আমি কী করি ...কার উপর অভিমান করি .... আমার সব কেমন গুলিয়ে যায়... এখন আমি কোথায় যাই... কী করি... গান ...(গানের কথায় মেহেদী হাসানের বিরহ গজল: পেয়ারে ভরে দো শারমিরে নাইন জিনসে মিলা মেরে দিলকো চাইন কহি জানে না কিউ মুঝসে সারমায়ে ক্যায়সে মুঝে তারপায়ে)

[ধীরে ধীরে মঞ্চের পর্দা নেমে আসে]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :