গণমানুষের ভাষা সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক শক্তি
জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস- রাজনীতির ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক- উভয় দিক থেকেই এ কথাটি সত্য। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে এ সত্য ভুলে যান। এই ভুলে যাওয়াটা কোনোকালেই কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য সুখকর হয়নি। কিছুদিন দুর্দান্ত প্রতাপে শাসন করা গেলেও জনগণ বা গণমানুষ এক সময় নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে সত্যি সত্যিই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড়ো ক্ষমতা হলো গণমানুষের ভাষা বুঝতে পারার ক্ষমতা। এ ক্ষমতা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যেমন থাকতে হয়, তেমনি ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোরও থাকতে হয়। গণমানুষের ভাষা বুঝতে পারলে ক্ষমতাসীন দল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো যদি বুঝতে পারে তাহলে একদিন জনগণ তাদের হাতেও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ যাবৎ দেশে দেশে যত গণবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তার সবগুলোই হয়েছে শাসকশ্রেণির পক্ষে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভাষা বুঝতে না পারার ব্যর্থতা থেকে।
গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। সরকারের বড়ো বড়ো এমপি, মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ প্রশাসন ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে। কেউ গ্রেফতার হয়, কেউ পালিয়ে থেকে আত্মরক্ষা করে। রাষ্ট্রপতি সংসদ বিলুপ্ত করে দেন। ক্ষমতাসীন দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একটানা দেড়দশক ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ কী এমন কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, যার ফলে দলটি এভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। এ উন্নয়নের সুফলও জনগণ ভোগ করছে। কিন্তু তারপরও জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করলো। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। তার মানে একটি দেশের উন্নয়নই শেষ কথা নয়। সরকার তো উন্নয়ন করে জনগণের টাকায়। শুধু উন্নয়ন নয়, সরকার পরিচালিতও হয় জনগণের টাকায়। তাই জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার দেশ পরিচালনা করবে- এটাই স্বাভাবিক। জনগণ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সুশাসন চায়; চায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো সরকার ব্যর্থ হলে সেই সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে না। জনগণ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটতে চায়। কিন্তু অধিকারবঞ্চিত হয়ে হাঁটতে চায় না। জনগণের কিছু মৌলিক অধিকার যখন কোনো সরকার খর্ব করে তখন সেই সরকারের উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পর পর তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, জনগণের টাকায় প্রতিপালিত আমলা ও পুলিশবাহিনী সংবিধান নির্দেশিত জনসেবার কথা না ভেবে যেভাবে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের মদদপুষ্ট আমলারা যেভাবে দুর্নীতি ও দখলদারিত্বের মাধ্যমে টাকার পাহাড় গড়েছে তার কোনোটাই জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। এসবের বিরুদ্ধে যারা মুখ খুলেছেন তাদেরকে কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ট্যাগ লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু মনের ভেতরে ক্ষোভ জমেছে। আর এই ক্ষোভ ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে। বিক্ষোভ দমন করার সকল চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড়ো দুটি কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের মতো জনযুদ্ধকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে দখল করে রাখা ও বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে পদদলিত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের সম্পদ মনে করার কারণে অন্যান্য দলীয় কিংবা নির্দলীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সর্বস্তরের গণমানুষ বেদনাহত হয়েছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ নামক জনযুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর ছাড়া সর্বস্তরের গণমানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তাঁদের আত্মত্যাগকে ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে এমনভাবে দখল করেছিল যে, অন্য দলমতের মানুষ মাত্রই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেত। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জনগণ মেনে নিতে পারেনি। কারণ আওয়ামীপন্থার বাইরে অবস্থান করা অসংখ্য মানুষ এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে দলীয় সম্পদে পরিণত করা আওয়াম ীলীগের আর এক নৈতিক পরাজয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করেছিল।বঙ্গবন্ধুকে সেই সম্মানজনক অবস্থানে ধরে রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা বিক্রি করে খেতে খেতে আওয়ামী লীগ আদর্শিকভাবে ফতুর হয়ে গিয়েছিল। আদর্শিকভাবে ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এই দলটিকে সাধারণ মানুষ আর মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাখ্যানের ভাষা আওয়ামী লীগ পড়তে পারেনি। ফলে গণআন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসে যেতে হয়েছে।
আওয়ামী শাসনামলে যে সকল রাজনৈতিক দল বিরোধী অবস্থানে ছিল তারাও জনগণের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিনেও তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ বার বার ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল হয়নি। জনগণ সেসব আন্দোলনে সাড়া দেয়নি। কারণ বিরোধী দলগুলোও গণমানুষের ভাষা পড়তে পারেনি। জুলাই বিপ্লবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সমর্থন থাকলেও আন্দোলনকে সংগঠিত করেছে ছাত্রসমাজ। সাধারণ ছাত্ররাই প্রথমে কোটাবিরোধী আন্দোলন, তারপর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। জীবন দিয়েছে। লক্ষ করার বিষয় হলো যারা জীবন দিয়েছে তাদের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের সন্তান। ফলে সাধারণ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার জন্য ছাত্রদের কাতারে এসে মিশে গেছে। অতীতে একই ডাক বিএনপি কিংবা বিরোধী পক্ষের অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যখন দিয়েছে তখন কিন্তু জনগণ সেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়নি। কারণ সেখানে জনগণ তাদের প্রত্যাশার জায়গা খুঁজে পায়নি। সেগুলোকে তারা মনে করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলন এবং ক্ষমতায় গিয়ে যে সবাই জনগণকে ব্যবহার করে- এ পূর্বঅভিজ্ঞতা জনগণ ভুলে যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হয়নি।
জুলাই আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলন হয়ে উঠলেও সেটা কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলন ছিল না। ছাত্ররা কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এ আন্দোলন করেনি। কিন্তু আন্দোলনের সুফল ভোগ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশ তৎপর হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করতে। প্রথম দিন থেকেই ঘুরেফিরে এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কথা হচ্ছে। গণমাধ্যমে এখন এটি একটি নিয়মিত আলোচনার বিষয়। সব রাজনৈতিক দল যৌক্তিক সময়ের কথা বললেও সেই যৌক্তিক সময় যেন খুব বেশি দিন না হয় সে ধরনের ইঙ্গিত আছে তাদের কথায়। কিন্তু সাধারণ জনগণের ভাবনা আলাদা। জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে- কমে নিত্যপণ্যের দাম কমবে? কবে অফিস-আদালতে গিয়ে কাজের জন্য ঘুষ দিতে হবে না? কবে তারা মানবিক মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে? জনগণ এক সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমীহ করতো। তাদের অসীম ক্ষমতা দেখে ভয় পেত। এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদেরকে সমীহ করতে হচ্ছে। তাহলে জনগণের অবস্থার পরিবর্তন কি খুব একটা হয়েছে? এক কথায় বলা যায় হয়নি। পরিবর্তনের সুফল পাওয়ার আশায় সাধারণ জনগণ চাচ্ছে এই সরকারের মেয়াদ একটু বেশিই হোক। এখনই কোনো দলীয় সরকার এসে সবকিছু তাদের মতো করে সাজিয়ে নিক- বিপ্লবী ছাত্র-জনতা সেটিও চাচ্ছে না। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে গণমানুষের এই মনোভাব বুঝতে হবে। শুধু বুঝলেই হবে না। গণমানুষের এই মনোভাবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে। পরমতসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সাধারণ জনগণ যখন বুঝতে পারবে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের আর প্রয়োজন নেই তখন জনগণই নির্বাচনের দাবি তুলবে। আর তখনই হবে নির্বাচনের উপযুক্ত সময়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে জনমনে স্বস্তি ও আশঙ্কা- দুটোই বিরাজ করছে। স্বস্তির কারণ হলো জনগণ এক দলীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়েছে। আর আশঙ্কার কারণ হলো দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো আরো বেশি আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তারা মুখে সহনশীলতার কথা বললেও অনেক ক্ষেত্রে সে সহনশীলতার বাস্তবরূপ দেখা যাচ্ছে না। হাট দখল, ঘাট দখল, কল-কারখানা দখল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন সভা-সমিতির পদ দখল ও প্রতিপক্ষের প্রতি হামলার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর হাইকমান্ড এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিফলন খুব একটা চোখে পড়ছে না। ফলে জনমনে স্বস্তির চেয়ে আশঙ্কাই বাড়ছে। কখনো যদি জনগণ বলতে শুরু করে ‘আগের সরকারই ভালো ছিল’ তাহলে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লব ও আত্মত্যাগ কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, জনমুক্তিও অধরাই থেকে যাবে। সে ধরনের কিছু হোক সেটি কারো প্রত্যাশা নয়। প্রত্যাশা হলো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভাষা বুঝে সে অনুযায়ী কাজ করুক। পুরোনো যা কিছু অকল্যাণকর তার সবকিছু বর্জন করে নতুন চিন্তা ধারণ করুক। ব্যক্তির পরিবর্তনের চেয়ে ব্যক্তিচিন্তার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। কারণ মানুষ যা চিন্তা করে সে অনুযায়ীই কাজ করে। আর গণমানুষের ভাষা বুঝে নিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করলেই সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণকর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক, পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়