শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: ‘আমিই প্রথম লাশ শনাক্ত করি’

একেএম শোয়েব বাশরী হাবলু
  প্রকাশিত : ৩০ মে ২০২৫, ১০:০৫
অ- অ+

জুন ১৯৮১। কবর খুঁড়ে চাদর ঢাকা লাশগুলো দেখা যায়। কিন্তু উপস্থিত সামরিক বাহিনীর সদস্য বা পুলিশ কেউই বোমা বিস্ফোরণ বা সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় কবরে নামতে সাহস পাননি। আমি জীবনের মায়া ত্যাগ করে লাফ দিয়েই কবরে নামি। চাদরটি তুলে প্রথম যে লাশটি দেখতে পেলাম সেটিই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের।

ডান চোখ, নিচের চোয়াল এবং বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল অসংখ্য বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা। গুলিতে নিচের চোয়াল উড়ে গেলেও তাকে চিনতে এতটুকু অসুবিধে হয়নি। ওই সময় তার পরনে ছিল সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। আর তার আধা-পাকা গোঁফগুলো ছিল রক্তমাখা। আরও আশ্চর্যের বিষয়, একই কবরে শায়িত লে. কর্নেল আহসান ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ দুটো ফুলে উঠলেও জিয়াউর রহমানের লাশটি একদম ফোলেনি। ৩০ মে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ছিল আমাদের ক্লাস টেস্ট। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আমরা জিয়াউর রহমানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাই। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পাশে অবস্থিত। কলেজের উলটো দিকে পোমড়া গ্রাম। গ্রামবাসীর সঙ্গে আমার বেশ সুসম্পর্ক ছিল। খবর শোনার পর আমি গ্রামে যাই। তখন ক্যাম্পাসের ছাত্রসহ গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল চাপা উত্তেজনা। রাস্তাঘাট ছিল প্রায় ফাঁকা।

গ্রাম থেকে ফেরার পথে আমি দেখলাম রাস্তা দিয়ে একটি আর্মি জিপ, একটি অ্যাম্বুলেন্স তিনটি সৈন্যভর্তি সাঁজোয়া গাড়ি খানিকটা সামনে গিয়ে থেমে যায়। ঘটনাটি আমার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করে। আমি লুকিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।

প্রথমে তারা অ্যাম্বুলেন্স থেকে ত্রিপলে জড়ানো একটি বস্তু নিচে নামায়। এরপর দুজন সৈন্য পার্শ্ববর্তী বাজারে চলে যায়। তারা সেখান থেকে দুজন শ্রমিক নিয়ে আসে। এদের দ্বারাই কবর খোঁড়ানো হয়েছিল। এরপর ত্রিপলে জড়ানো একটি বস্তু নিচে নামিয়ে মাটি দেওয়া শেষে সবাই স্যালুট প্রদর্শন করে। এতে আমার মনে সন্দেহ হয়, সম্ভবত এটাই শহীদ প্রেসিডেন্টের লাশ। সময় আমি একজন দাঁড়িওয়ালা সৈন্যকে খুব কান্নাকাটি করতে দেখেছি। এর পরে সেখানে চারজন সৈন্যকে পাহারায় রেখে গাড়িগুলো চলে যায়।

কিছু সময় পরে কলেজে ফিরে আমি অন্যান্য ছাত্রদের ঘটনাটি জানাই এবং বলি, যে করেই হোক রাতে আমি দেখব কার লাশ কবর দেওয়া হয়েছে। এজন্য আমি কলেজ ক্যান্টিনের পরিচালক মনসুরকে একটি কোদাল তিন-চারজন কর্মচারী দিতে বলি। মনসুর আমাকে সম্ভাব্য সাহায্য করেছিল।

কিন্তু কলেজ ছাত্রদের অনেকেই আমাকে কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়। এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ রেজাউল করিম আমাকে কাজ না করার জন্য অনুরোধ করেন।

তথাপিও রাতে আমি মনসুরের দেওয়া কোদাল এবং লোকসহ যথাস্থানে রওয়ানা দেই। কিন্তু রাতেও সৈন্যরা সেখানে পাহারায় থাকায় আমরা হোস্টেলে ফিরে আসি। একদিন পরে জুন রেডিওতে আমরা মঞ্জুর বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনি। খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়া থানায় গিয়ে খবর দেই এবং একজন সাব-ইন্সপেক্টরসহ ঘটনাস্থলে আসি। ইতোমধ্যে ঘটনা জানাজানি হলে সেখানে হাজার হাজার কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে যায়। একটু পরেই সামরিক বাহিনীর লোকজনও সেখানে উপস্থিত হন। যাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ এবং জিয়াউর রহমানের অন্যতম ঘাতক লে. কর্নেল মাহফুজ। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে কবর খোঁড়ার কাজ শুরু হয়। আর্মি সব বেসামরিক লোকদের দূরে সরিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কিন্তু উপস্থিত জনতার চাপে তারা শেষ পর্যন্ত আমাকে কবরের কাছে যেতে দেয়। জনতার দাবি ছিল, যেহেতু আমি প্রথম লাশের সন্ধান পেয়েছি কাজেই আমাকে ঢুকতে দিতে হবে।

কবর খুঁড়ে লাশ দেখে আর্মি বা পুলিশ কেউই ভয়ে কবরে নামেনি। আমিই প্রথম কবরে নামি। লাশ দেখার পর আমি উপরে উঠে সবাইকে বলি, ভাই সব জিয়াউর রহমানের লাশ পাওয়া গেছে। তখন সাধারণ মানুষের কান্নার দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এরপর জনতা দাবি তোলে জিয়াউর রহমানের প্রথম জানাজা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হতে হবে। জনতার দাবির মুখে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ আমাকে একটি হ্যান্ডমাইক দিয়ে জনতাকে শান্ত করার জন্য অনুরোধ করেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের প্রথম জানাজা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই হবে। যদিও পরে তারা কথা রাখেননি।

এরপরে লাশ গাড়িতে তোলার জন্য তারা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আরও তিনজন ছাত্রকে ব্যারিকেডের ভেতরে ঢুকতে দেয়। এরা হচ্ছেন-ইঞ্জিনিয়ার নাজিম (বর্তমানে বিদেশে কর্মরত), ইঞ্জিনিয়ার মহিউজ্জামান হানু (জয়দেবপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে চাকরিরত) এবং ইঞ্জিনিয়ার সামদানী (পেট্রোবাংলায় চাকরিরত) সহযোগীদেরসহ আমি পার্শ্ববর্তী পাহাড়তলী গ্রামের মসজিদ থেকে একটি স্ট্রেচার নিয়ে আসি। যেটি পরবর্তীতে আমি খালেদা জিয়াকে উপহার দিয়েছিলাম। আর মসজিদ কমিটিকে স্ট্রেচারের মূল্য পরিশোধ করেছি।

লাশ গাড়িতে তোলার পর আমি সবাইকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে জানাজায় অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাই। জনতাই তখন আমাকে দিয়ে এসব কাজ করিয়েছিল। ওই সময় গাড়িতে উঠার জন্য অনেক ছাত্রই চেষ্টা করলে আর্মি লাঠিচার্জ করে। এতে তারেক নামে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়। তারেক এখন ঢাকায় ব্যবসারত।

আর্মির গাড়িগুলো কলেজের কাছে এসে দ্রুত চালিয়ে যায় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আর উনার জানাজা হতে পারেনি। লাশসহ আমরা যে গাড়িতে ছিলাম লে. কর্নেল মাহফুজও ওই গাড়িতে ছিলেন। ওই সময় তাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। সে আমাদের বলেছিল, তার পাঁজরের ডান পাশ দিয়ে একটি, কাঁধের উপর দিয়ে গলার দুই পাশ দিয়ে দুটি গুলি চলে গিয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এত গুলি গেল তাহলে আপনি বেঁচে রইলেন কিভাবে? এতে মাহফুজ আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমাদের গাড়ির পেছনেই ছিলেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান। নোমান ভাই আমাকে পেছন থেকে চিৎকার করে বলেন, হাবলু তুমি গাড়ি থেকে নামবে না।

এদিকে লে. কর্নেল মাহফুজ এতই উদ্বিগ্ন ছিল যে, তার এক পা লাশের ওপর লেগেছিল। এবারও নোমান ভাই চিৎকার করে বলে, হাবলু ওকে লাশ থেকে পা নামাতে বল। গাড়ি কালুরঘাটের কাছে পৌঁছলে মাহফুজ এক সাধারণ সৈন্যের কাছে তার অস্ত্রটি চেয়েছিল। কিন্তু ওই সৈন্য তা দেয়নি। অস্ত্র চাওয়ার কারণ আজও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। কালুরঘাটে এসে লাশবাহী গাড়িটি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় না গিয়ে কক্সবাজারের রাস্তায় মোড় নেয়। এতে সামনের গাড়ির সৈন্যরা লাফিয়ে পড়ে পজিশন নেয়। মাহফুজ তাদের বলে, ভুল হয়েছে। এরপর গাড়ি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছলে আমাদের বিদায় দেওয়া হয়। তখন আমি ছিলাম খুবই ক্লান্ত। আমি চট্টগ্রামের চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করার পর হোস্টেলে ফিরে আসি।

পরদিন জুন পত্রিকায় আমার নাম ছাপা হলেও আমি কোনো পত্রিকা পাইনি। ওইদিন পত্রিকা ছিল খুবই দুর্লভ। অগত্যা এক বুড়োর হাত থেকে তার কেনা পত্রিকাটি পড়তে নিলে সে আমাকে প্রায় মারতে উদ্যত হয়। কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম, জিয়াউর রহমানের লাশ আমিই শনাক্ত করেছি। শুনে বুড়ো আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না শুরু করেন এবং আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করতে থাকেন।

এরপর আমরা চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া-রাউজান বর্ডার-যেখানে জিয়াউর রহমানকে প্রথম কবর দেওয়া হয়েছিল সেখানের নামকরণ করিজিয়ানগর পরে জিয়ানগরের উন্নয়নের জন্য তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী এমরান আলী সরকার ৫০০ মন গম বরাদ্দ করেন। বরাদ্দপত্রে লেখা ছিল, ‘This wheat shall be utilized on the development of 'Zianagar’.

লেখক : অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (এ্যাব) সাবেক সদস্য সচিব চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সাবেক ছাত্র

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে রাজশাহী সেবাকেন্দ্রে পরিদর্শন টিম
ঈশ্বরদী ইপিজেডের খাবার খেয়ে শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ
গাজায় ধ্বংসযজ্ঞে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে কোন কোন দেশ
‘হাইড এন সিক’-এ অন্য এক দীঘি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা