তৈলমর্দনের তেলেসমাতি: কর্মগুণ চাপা পড়ে ‘চামচা সংস্কৃতির’ চাতুর্যে

মোঃ সাইফুল ইসলাম মাসুম
  প্রকাশিত : ২৮ মে ২০২৫, ১১:৪৮| আপডেট : ২৮ মে ২০২৫, ১২:০১
অ- অ+

আধুনিক কর্মজীবনের করপোরেট প্রাসাদগুলো বাইরে থেকে যতটা ঝকঝকে, ভেতরটা ততটাই গুমোট—নিয়ম-নীতির মুখোশে লুকিয়ে থাকা চাটুকারিতার নোংরা রাজনীতি। দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম আর সততার জায়গায় আজ বিরাজ করছে চামচা বিদ্যার এক ভয়াবহ সন্ত্রাস। এ এক নীরব, কিন্তু বিষাক্ত প্রক্রিয়া—যার প্রভাবে ঝরে যাচ্ছে কত সম্ভাবনা, নিভে যাচ্ছে কত প্রজ্ঞার আলো।

দুপুর ১২টা নাগাদ করপোরেট অফিসের করিডোরে একদল চাটুকার কর্মী হাঁটছেন বসের কেবিনের দিকে। কারো হাতে দামি কফির কাপ, কারো পকেটে কোল্ডক্রিমের কৌটো—‘স্যার’-এর পছন্দের ব্র্যান্ড। কেবিনের দরজা খোলা মাত্রই যেন অভিনয়ের মহড়া শুরু—“স্যার, আজ আপনাকে একেবারে বিজনেস ম্যাগাজিনের কভারফেসের মতো লাগছে!” এই কথাগুলো বলার সময় তাদের চোখে কোনো সত্য থাকে না, থাকে ভবিষ্যতের পদের টান, ইনক্রিমেন্টের লোভ আর অনুগ্রহের প্রত্যাশা। আর ঠিক পাশের ডেস্কে বসে থাকা ফিরোজা আক্তার, যিনি তিন বছর ধরে মার্কেটিং রিপোর্ট তৈরিতে রাত কাটিয়েছেন, সেলস টার্গেট ছুঁয়ে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়—তিনি চুপচাপ, নিঃশব্দে নিজের কাজ করছেন। তার চোখে একরাশ ক্লান্তি, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কিন্তু মুখে কোনো অভিনয়ের পরত নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে—ফিরোজার জন্য কি কোনো প্রশংসার বাক্য সংরক্ষিত আছে? কোনো ‘বিশেষ স্বীকৃতি’? উত্তর হলো—না। কারণ তিনি চামচা নন, চরিত্রবান।

একটি করপোরেট কোম্পানিতে কর্মরত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হিসাবরক্ষক সোহেল সাহেব জানালেন, “আমি সৎ থাকতে গিয়েই পিছিয়ে গেছি। ফাইল তৈরি করেছি, অডিট ক্লিয়ার করেছি, অথচ প্রমোশন পেয়েছে সেই জুনিয়র ছেলেটা যে বসের বাচ্চার জন্মদিনে গিফট দিয়েছে আর নিয়মিত লাঞ্চে বসকে সঙ্গে নিয়েছে।” এই যে সামাজিক পচন—এটা শুধু একজন সোহেল সাহেবের নয়, বরং হাজারো অফিস-কর্মীর অভ্যন্তরীণ হাহাকার।

এই চাটুকার সংস্কৃতি একদিকে যেমন কর্মঠ মানুষদের মনোবল ভেঙে দেয়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই তৈরি করে একটা নৈতিক নৈরাজ্য। অফিসের যারা সত্যিকার অর্থে পেশাদার, তারা ধীরে ধীরে এক ধরনের মানসিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। বারবার বঞ্চনার যন্ত্রণা তাদের কর্মক্ষমতা নিঃশেষ করে, হৃদয়ে জন্ম নেয় অসহায় ক্ষোভ। একজন কর্মীর কণ্ঠে শুনেছিলাম—“এখানে কাজ করলে উন্নতি নয়, হয় ক্যানসার।” কথাটা ঠাট্টা নয়, যেন এক গাঢ় বিষাদে লেখা বাস্তব সত্য।

কেউ কেউ বলে থাকেন—চামচা হওয়া একটা ‘স্কিল’। কিন্তু এ যদি স্কিল হয়, তবে তা মানুষের বিবেক হারানোর, আত্মমর্যাদা বিসর্জনের স্কিল। এটি এমন এক মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে, আদরের নামে তোষামোদ করে, নিজেকে একটি যন্ত্রে পরিণত করে বসের মন জয়ের যুদ্ধে নামে। তবে এটিও সত্য, এরা অনেকেই জানে—তাদের যোগ্যতা কম, আত্মবিশ্বাস নেই, তাই কেবল তেলেই তারা পথ তৈরি করতে চায়।

এই সংস্কৃতির ভয়াবহতা এখানেই যে, এক পর্যায়ে পুরো অফিস কালচারে ছড়িয়ে পড়ে ‘যোগ্য না, ম্যানেজ করতে পারো কি না’—এই মানসিকতা। তখন নতুন আসা কর্মীরাও শেখে—কাজ না, তেলই বাঁচায়। আর প্রতিদিন যে কর্মী অতিরিক্ত সময় দিয়ে ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করছে, তার মাথার ওপর ছায়ার মতো ভাসে অনিশ্চয়তা।

এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বিপন্ন যে মানুষগুলো—তারা হলো “নীরব যোদ্ধা”। যারা বলে না, দেখায়; যারা চাটুকার নয়, চরিত্রবান; যারা বসের সামনে তোষামোদ না করেও অফিসের মূলভিত্তি ধরে রাখে। অথচ এই শ্রেণিটিই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। একেকজন কর্মীকে দিনের পর দিন, বছর বছরের মতো ঘাম ঝরিয়ে দিতে দেখা যায়, কিন্তু স্বীকৃতি, পদোন্নতি বা একটিবার কৃতজ্ঞতার বাক্য আসে না তাদের জন্য। বরং একসময় এই অবহেলা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে তারা চাকরি ছাড়ার কথা ভাবে, কিংবা হয়ে পড়ে এক নিষ্প্রভ ছায়া—চোখে কেবল যন্ত্রণার ছাপ।

প্রতিষ্ঠানের কাঠামো যদি এই চামচা বিদ্যাকে প্রশ্রয় দিতে থাকে, তবে সেখানে সত্যিই কর্মদক্ষতা নয়, বরং তৈলমর্দনই হয়ে দাঁড়ায় পদোন্নতির সিঁড়ি। এমন অফিসে প্রতিভা হারায়, উন্নয়ন থেমে যায়, আর উৎপাদনশীলতার গ্রাফ প্রতিনিয়ত নামতে থাকে। বস তখন বোঝেন না—যে মানুষটি প্রতিদিন তার চেয়ার পরিষ্কার করত, সে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নয়। যে ছেলেটি একা বসে পুরো প্রজেক্ট শেষ করেছিল, সেই ছিল মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।

এই লেখার মূল লক্ষ্য শুধু অভিযোগ নয়, বরং আত্মজিজ্ঞাসা—আমরা কি এমনই প্রতিষ্ঠান চাই? একটি সমাজ তখনই সুস্থ হয়, যখন সেখানে স্বীকৃতি পায় সততা, প্রতিভা, পরিশ্রম। নেতৃত্ব তখনই মহৎ হয়, যখন সে বুঝতে পারে কারা তার চারপাশে ‘লোক দেখানো মোমবাতি’ আর কারা সত্যিকারের আলো।

সময়ের দাবি এখন এটাই—চামচাদের তেল ফেলার জায়গা নয়, বসের কর্ণযুগল হোক মেধাবীদের কণ্ঠ শুনবার জন্য প্রস্তুত। প্রতিষ্ঠান হোক এমন এক ভূমি, যেখানে 'চাটুকার' নয়, 'চরিত্রবান'রাই গড়ে তুলবে আগামীর ভিত্তিপ্রস্তর।

চামচা দিয়ে নেতা বানালে সেই প্রতিষ্ঠান কাঁপে ভিতর থেকে। আর যোগ্যতার কণ্ঠরোধ করে রাখলে একদিন সেখানে জন্ম নেয় প্রতারিত হৃদয়ের বিপ্লব।

চামচা বিদ্যা কোনো পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং এটি কর্মসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক ধরনের মরণব্যাধি। এই ব্যাধি যেখানে বিস্তার লাভ করে, সেখানে মেধা অপমানিত হয়, যোগ্যতা পদদলিত হয়, আর নেতৃত্ব রুগ্ন হয়ে পড়ে এক চাটুকার-নির্ভর মায়াজালে। শুধু ব্যক্তি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিষ্ঠান—এর উৎপাদনশীলতা, মনোবল এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ড ভ্যালু। করপোরেট অফিসের এই বিষাক্ত প্রবণতাকে যদি এখনই লাগাম পরানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতের কর্পোরেট লিডাররা হয়ে উঠবে ‘ম্যানেজ করা লোক’, যোগ্য নয়; আর কর্মীরা হারাবে বিশ্বাস, ধৈর্য ও নিষ্ঠার অনুপ্রেরণা।

নীতিগত পরামর্শ (Policy Recommendations):

• পারফরম্যান্স রিভিউ সিস্টেমে স্বচ্ছতা আনুন: প্রমোশন ও রিওয়ার্ড নির্ধারণে স্পষ্ট, লিখিত ও মেট্রিকভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করা হোক।

• মাল্টি-লেভেল ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করুন: শুধুমাত্র বসের মূল্যায়ন নয়, সহকর্মী ও অধীনস্থদের গোপন মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে একজন কর্মীর আসল প্রভাব যাচাই করা হোক।

• চাটুকারিতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কৌশল তৈরি করুন: অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ, মূল্যবোধভিত্তিক কর্মশালা ও ‘নেতৃত্বে সততা’কেন্দ্রিক ক্যাম্পেইন চালু করা হোক।

• ইনসেনটিভ প্রোগ্রামে ‘সাইলেন্ট পারফর্মার’ ক্যাটাগরি যোগ করুন: যারা মিডিয়া বা জনসমক্ষে নয়, বরং নেপথ্যে অবিচল নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে যান—তাদের আলাদা স্বীকৃতি দিন।

• এইচআর বিভাগে স্বাধীনতা ও দায়িত্ব বাড়ান: মানবসম্পদ বিভাগ স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে কর্মীর মূল্যায়ন করতে পারে, শুধুমাত্র বসের সুপারিশেই সিদ্ধান্ত না নেয়।

• লিডারশিপ ট্রেইনিং প্রোগ্রামে মনস্তাত্ত্বিক দিক অন্তর্ভুক্ত করুন: বস বা ম্যানেজারদের শেখাতে হবে—কীভাবে চাটুকারিতার মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা যায়, এবং সঠিক প্রতিভাকে চিহ্নিত করা যায়।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ঝিনাইদহে দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ভোগান্তিতে জনজীবন 
ভোলায় কোস্ট গার্ডের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও র‌্যালি
ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়ছেন ইলন মাস্ক, কারণ কী?
মৌলভীবাজারে দুর্ঘটনার কবলে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা