সফলতা বনাম মানবিকতা: জীবনের প্রকৃত বিজয় কোথায়?

একবিংশ শতাব্দীর দ্রুতগতির সমাজে সফলতার সংজ্ঞা যেন প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। একসময় যেখানে মানুষের মূল্যায়ন হতো তার মানবিক গুণাবলী ও সামাজিক ভূমিকা দিয়ে, আজ তা মাপা হচ্ছে আর্থিক অর্জন, পদমর্যাদা ও বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে।
এই বাস্তবতায় দুটি জীবনধারার মুখোমুখি অবস্থান লক্ষ্য করা যায় —
একটি হলো সুপ্রতিষ্ঠিত, আত্মকেন্দ্রিক এবং অসামাজিক জীবন;
অন্যটি হলো কম প্রতিষ্ঠিত, তবে মানবিক এবং সামাজিক জীবন।
প্রশ্ন হলো, এদের মধ্যে কোন জীবনধারা প্রকৃত অর্থে বেশি সফল, বেশি অর্থবহ?সুপ্রতিষ্ঠিত, আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক জীবন
এই ধরনের জীবনব্যবস্থায় ব্যক্তি হয়তো পেশাগতভাবে চূড়ান্ত সফল। ব্যাংক ব্যালান্স, প্রমোশন, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ কিংবা ব্যক্তিগত উন্নয়নে তার ঘাটতি নেই। কিন্তু তার জীবন আবর্তিত হয় কেবল "নিজেকে" ঘিরে — নিজের সময়, নিজের প্রয়োজন, নিজের শান্তি।
প্রকৃষ্ট উদাহরণ (১)
মো. রফিকুল ইসলাম, একজন সফল কর্পোরেট নির্বাহী। দুই দশক ধরে একাধিক দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সবই অর্জন করেছেন — পদমর্যাদা, সম্পদ, সম্মান।
কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাকী। বাবা-মার মৃত্যুতে সময় দিতে পারেননি, সন্তান বড় হয়ে উঠেছে তাকে না চিনেই, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে।
তার সফলতা আজ এক নিঃসঙ্গ শিখর, যেখানে দাঁড়িয়ে কেবল নিজের ছায়াটিই দেখা যায়।কম প্রতিষ্ঠিত কিন্তু মানবিক ও সামাজিক জীবন
এই জীবনধারার মানুষরা হয়তো প্রচলিত অর্থে খুব "সফল" নন। তবে তারা সমাজের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত, মানুষের পাশে দাঁড়ায়, হৃদয়ে হৃদয়ে সংযোগ তৈরি করেন।
প্রকৃষ্ট উদাহরণ (২)
সালেহা বেগম, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোট্ট একটি গ্রামের স্কুলে তিনি ২৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন। বেতন সীমিত, সুযোগ-সুবিধা সীমিত — তবু তার ছাত্রদের চোখে তিনি একজন "নির্ভরতা", "ভরসা"।
ঈদের জামা না থাকা ছাত্রদের জন্য নিজের বেতনের কিছু অংশ তুলে রাখেন। অসুস্থ প্রতিবেশীর ওষুধ কিনে দেন নিঃশব্দে। তার জীবনে হয়তো নামি ডিগ্রি নেই, কিন্তু তার নাম রয়েছে শতশত হৃদয়ের তালিকায়।মানসিক শান্তি ও আত্মতৃপ্তি
আত্মকেন্দ্রিক জীবনে বহিরাগত সাফল্য থাকলেও, আত্মিক শান্তি প্রায়ই অনুপস্থিত। সম্পর্কহীনতায় জন্ম নেয় একরকম নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্বের প্রশ্নবোধ।
অন্যদিকে, মানবিক জীবনে অর্থের সীমাবদ্ধতা থাকলেও, আন্তরিক সম্পর্ক, কৃতজ্ঞতা ও মানুষের ভালোবাসা জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখে।সামাজিক ভূমিকা ও প্রভাব
একজন আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি সমাজে উপস্থিত থাকলেও, তার সামাজিক প্রভাব থাকে সীমিত।
বিপরীতে, একজন মানবিক মানুষ সমাজে কার্যকর ভূমিকা রাখেন — মানুষের কষ্ট লাঘব, শিক্ষা-সেবা, বন্ধন সৃষ্টি কিংবা মূল্যবোধ রক্ষা সবকিছুর সাথেই তিনি যুক্ত।উপসংহার
জীবনের পরিমাপক হিসেবে কেবল প্রতিষ্ঠার বহিরঙ্গ নয়, অন্তর্গত মানবিকতাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন ওঠে, আপনি কী হতে চান?
একজন সফল মানুষ, নাকি একজন প্রিয় মানুষ?
একটি প্রতিষ্ঠার চূড়ায় দাঁড়ানো একাকী ছায়া, নাকি অগণিত হৃদয়ে অমলিনভাবে বেঁচে থাকা এক নাম?
জীবনের প্রকৃত বিজয় হয়তো তখনই আসে, যখন সফলতা ও মানবিকতা হাতে হাত রেখে এগোয় — হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা থাকে মানুষ, মানুষের সাথে।লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন