বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্দশার হালচাল

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাই মানুষকে তার মনুষ্যত্ব অর্জনে সাহায্য করে। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সম্প্রীতি বাড়ায়, কুসংস্কার দূর করে সমাজকে আলোকিত করে। বাংলাদেশের মানুষের মেধা ও যোগ্যতা বিকাশের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর সংস্কারের দাবি এখন জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, সার্টিফিকেট সর্বস্ব হতে রক্ষা করার জন্য আলাদাভাবে ভাবনা-চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কয়েকটি জিনিসের প্রতি আলোকপাত করলেই সকলের নিকট প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব প্রতীয়মান হবে বলে মনে করছি:
(১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার:
প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত আংশিক পরিবর্তন সাপেক্ষে পূর্বের ন্যায় পাঠক্রম চালু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা প্রাইমারি স্কুলগুলো, হাই স্কুলগুলো এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকবৃন্দ নতুন শিক্ষানীতি যা বর্তমানে বাইরে থেকে আমদানিকৃত তার সাথে সুপরিচিত নয়, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে কি করে তারা শিক্ষার্থীদের তৈরি করবে?
সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের জন্য বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা নীতি সম্পূর্ণরূপে একরকম বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে একটি জরিপ চালালেই সত্যিকারের বাস্তব চিত্র সকলের নিকট উঠে আসবে।
বর্তমানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত (প্রাইমারি স্কুল) যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা পাঠদান করে থাকেন তারা অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং দীর্ঘমেয়াদি স্কুলের সময়সূচি নির্ধারণের কারণে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতিতে ভোগেন। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দের মধ্যে রয়ে গেছে প্রমোশনগত বৈষম্য নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা যা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান। প্রাথমিক শিক্ষাকে যদি ধরা হয় শিক্ষার্থীর মূল ভিত্তি আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দকে যদি ধরা হয় সেই ভিত্তি গড়ে তোলার মূল কারিগর তাহলে মূল কারিগরদের ওপর আরোপিত নির্দেশনামার মাধ্যমে কখনো কি আন্তরিকতার সঙ্গে কোমল-মতি বাচ্চাদের যত্ন সহকারে ভিত্তি গড়ে দেওয়া সম্ভব, ভেবে দেখার মতো বিষয় নয় কি?
(২) বিগত সরকার আমলে যেভাবে গণহারে বেসরকারি হাই স্কুলগুলোকে সরকারিকরণ করা হলো এবং শিক্ষকগণকে করা হলো আত্তীকরণ:
প্রশ্ন উঠতে পারে না যে, ওই শিক্ষকবৃন্দের দক্ষতার (প্রশিক্ষণ) ঘাটতি আছে কি না?
শুধুমাত্র সরকারিকরণ করে উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদানের মাধ্যমে রাজনীতিকীকরণ দেশের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মেরুদণ্ড কি ভেঙে দেয়নি ?
নিয়ম রক্ষার খাতিরে যেসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল তাতে কি কোনো রকমের মানদণ্ডের উন্নতি হয়েছিল, কিভাবে সম্ভব?
নতুন সিলেবাস, নতুন শিক্ষানীতি, নতুন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে খোঁজখবর নিলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে এবং আলাদা আলাদা কমিটি প্রণয়নের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়ে আশু পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই।
(৩) উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকবৃন্দের যে প্রশিক্ষণগুলো হচ্ছে তার বেশির ভাগই পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ:
সম্মানিত সে প্রশিক্ষকগণের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিন্দু পরিমাণ কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু অতঃপর শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে যখন রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে পরিণত করে এবং চাকরির ন্যায় বিবেচনায় নিয়ে টাকা উপার্জনের, পজিশনে বসার, বিত্ত বৈভবের এক দুর্নিবার নোংরা নেশায় মত্ত হয়ে পড়েন, তখন অবশ্যই বাছ বিচারের প্রশ্ন চলে আসে। শিক্ষকতা করার বা ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিকতার সঙ্গে সময় দিয়ে নিজের প্রস্তুতি সহকারে কতটুকু সময় ব্যয় করতে পারেন এ বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনের সম্মানিত শিক্ষকগণের বিবেকের ওপর ছেড়ে দেওয়া দায়িত্ব বলে মনে করছি। আর সুশীল সমাজ বা তথাকথিত নাগরিক সমাজকে উপরের অংশটুকু পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি বিনয়ের সঙ্গে।
আর উনাদের তত্ত্বাবধানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ কতটুকু প্রশিক্ষণ লাভ করেন বা উপকৃত হন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাও না হয় ছেড়ে দেয়া যাক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সম্মানিত শিক্ষক- শিক্ষিকাবৃন্দের বিবেকের বিচারে।
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মতো অনেক কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে এবং শিক্ষকবৃন্দকে আত্তীকরণ করে ওই সকল কলেজের শিক্ষকবৃন্দকে সরকারি শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত করা হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায়! তাহলে শিক্ষার বেহাল দশা হবে না তো কি হবে?
যার ফলস্বরূপ আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্বিষহ বিভীষিকাময় ফলাফল নিয়ে এক বিপর্যয়কর পরিণতি দাঁড় করায় (ফেল করে /পাস করার হার হয় ১০%-২০%)। কিন্তু কেন? রাষ্ট্রযন্ত্র কি কখনো ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে?
(৪) আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুধুমাত্র প্রমোশনের জন্য গণহারে কোন মানদণ্ডে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছি। এক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের একটি নয়, তিনটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে! পিএইচডি যেন ডালভাতের মতো সস্তা দরের লোভনীয় খাবার যা সহজেই ক্রয় করা যাচ্ছে!
(৫) যেভাবে কপি-পেস্ট করে আর্টিকেল পাবলিশ করা হচ্ছে তা এক কথায় শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবে!!
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে শিক্ষকবৃন্দের তুলনায় শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে থাকে উন্নত এবং আধুনিক গবেষণামূলক নিবন্ধ-প্রবন্ধ আর উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে! শিক্ষকবৃন্দ তো সময়ই পান না।
সত্যি সেলুকাস বিচিত্র এই বাংলাদেশ, তাই নয় কি?
নীতি-নির্ধারকদের ভেবে দেখার মনে হয় এখনি উপযুক্ত সময়। শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে সর্বদা পড়াশোনার সাথে এটাসড থাকা লাগে, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের সে সময় কোথায়?
(৬) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকবৃন্দের "মৌলিক লেখা" তা আর্টিকেল হোক অথবা বই হোক না কেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে! আর তাই যদি না হতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ কেনই বা লেখক বা লেখিকা! চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত নয় মর্মে প্রমোশনের পরিবর্তে মাঝে মাঝে ডিমোশন এবং হাইকোর্টের রিট করে সার্টিফিকেট আনার তোড়জোড়ে লিপ্ত হতে দেখা যায়! অভিযোগের অঙুলি উঠে এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে আরেক সহকর্মী কর্তৃক কারণটা কি?
(৭) সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকগণ যেভাবে গণহারে ২০-২৫টি দায়িত্ব নিয়ে দায়সারাগোছের ক্লাস-পরীক্ষার কার্যক্রম চালায় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেস্ট টিচাররা বকবক করে চলে আসেন, এতে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের নিকটও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ হাস্যাস্পদ হয়ে যাচ্ছেন!!!
(৮) বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, প্রোভিসি এবং কোষাধ্যক্ষগণের কার্যকলাপ অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে!
হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের অভিযোগ হয় দুর্নীতি নয় স্বজনপ্রীতির! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের পরিবারকেন্দ্রিক জরিপ চালালে দেখা যাবে নিজ নিজ পরিবারের ডজনখানেক কিভাবে যেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি করার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরিরত অবস্থায় আছেন এবং অতীব দ্রুত তড়তড় সিঁড়ি বেয়ে উঠার মতো করে উচ্চতর পদে প্রমোশন বাগিয়ে নেন অন্য অনেক বয়োজ্যেষ্ঠদের সুপারসিড করে। হয়তো বা তাদের অধিকতর যোগ্যতার বলে!
(৯) প্রশাসনিক দায়িত্ব পাওয়া যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের জন্য এক বিরল সৌভাগ্যের বিষয় বা সোনার হরিণ! আর ডিন, চেয়ারম্যান কিংবা বিভিন্ন কমিটির দায়িত্ব পাওয়া যেন অশ্ব ডিম্ব পাওয়ার নেয় আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মহামান্য উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর এ গ্রেডের, বি গ্রেডের প্রফেসরবৃন্দের নিকট, যা এক কথায় রসিকতার এবং হাস্যরসের উদ্রেক করে।
(১০) বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া অথবা দেশের অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিনারে অংশগ্রহণ করার দাওয়াত নিয়ে রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ডের মতো ঘটনাও হয়ে যায়।
সত্যিই এই বিষয়টির প্রতি কারো দৃষ্টি গোচরীভূত না হওয়ায় আমি এতদিন প্রমাদ গুনছিলাম। আমরা আমজনতা তাই তুলে ধরলেও কেউ গুরুত্ব দিবে না জেনেও বিবেকের তাড়নায় না লিখে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারলাম না সাবেক একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। আশা করি বিষয়টি নিয়ে সত্যিই যথাযথ কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব সহকারে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (চাকরি হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

মন্তব্য করুন