রাজাকারের তালিকা তৈরি কত দূর?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর চলে গেছে ৪৫ বছর। অদ্যাবধি তৈরি করা হয়নি স্বাধীনতার যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করা রাজাকারদের তালিকা। তালিকা না থাকার সুযোগে রাজাকাররা মিশে যাচ্ছেন সমাজে নানা ক্ষেত্রে; তৈরি করছেন নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অসংগতি।
দেশের ইতিহাসবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, রাজাকারের তালিকা তৈরি করা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের গঠনমূলক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। রাজাকারদের একটি বস্তুনিষ্ঠ তালিকা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজ সামনের দিনগুলোতে দুরূহ হয়ে পড়বে বলে তাঁরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
রাজাকারের তালিকা বিষয়ে ঢাকাটাইমস কথা বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের সাথে। এতদিনেও তালিকা তৈরি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ মুনতাসির মামুন বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা আমাদের জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই দাবি গত ৪০ বছর ধরেই করে আসছি। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।’
জামায়াত কর্মীদের নিয়ে রেজাকার বাহিনীর প্রথম ইউনিট
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী’র নাম ছিল ‘রেজাকার’। এটি অখণ্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী সমন্বয়ে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহকারী আমির এ কে এম ইউসুফ প্রথম রেজাকার বাহিনী গঠন করেন। তবে পরবর্তীকালে জনগণের কাছে 'রেজাকার' শব্দটি 'রাজাকার' শব্দে পরিণত হয়।
আরও যেসব বাহিনী ছিল
স্বাধীনতাবিরোধীরা ‘রাজাকার’ ছাড়াও শান্তি কমিটি, আল-বদর, আল-শামস, আল-মুজাহিদ ইত্যাদি নাম নিয়ে যুদ্ধের নয় মাস দেশব্যাপী হত্যা, ধর্ষণ, গুম, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজসহ নানাবিধ মানবতাবিরোধী নৃশংসতায় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে যারা সরাসরি অপরাধ করে থেকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধী” হিসেবে তদন্তপূর্বক চিহ্নিত হয়েছেন, বিশেষ আদালত তাদের বিচারের সম্মুখীন করছেন। কিন্তু যারা গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা করেছে তাদের বিষয়ে রাষ্ট্র কী করবে সেটি এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।
এ বিষয়ে ঢাকাটাইমস কথা বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাথে। তিনি বলেন, ‘রাজাকারদের সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনী এদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করতে পারত না। এই রাজাকাররা নিজেরা আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, আমাদের মা-বোনদেরকে পাক বর্বরদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ প্রতিটি মানবতা বিরোধী অপরাধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল কিছুই চিনত না। পাকবাহিনীর প্রতিটি কুকর্মে প্রত্যক্ষ্য-পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিল এই নরপশুরা।’
তালিকা কেন জরুরি
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সামনে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করে এই দুর্বৃত্তদের আইনি এবং সামাজিক বিচার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক।
ঢাকাটাইমস অনুসন্ধান করে দেখেছে, ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি এখন পর্যন্ত রাজাকারদের যে বেসরকারি তালিকা পাওয়া যায় তাতে কেবল হাজার খানেক রাজাকার এবং শ দুয়েক শান্তিকমিটি ও আলবদর সদস্যের নাম পাওয়া যায়। আল-শামস ও আল-মুজাহিদের সরকারি-বেসরকারি কোন তালিকাই এখন পর্যন্ত হয়নি।
এ বিষয়ে কথা হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের গেজেটেড তালিকাভুক্ত ৫০ হাজার রাজাকার ছিল। তারা সরকারি বেতন-ভাতা তুলত ঐ সময়ে। মেজর শামসুল আরেফিনের উদ্যোগে প্রতিটি থানা থেকে তথ্য নিয়ে রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা হয়নি, যা খুবই দুঃখজনক।’
যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ধ্বংস করেছেন জিয়াউর রহমান
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান এসে সেই তালিকা ধ্বংস করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের এই তালিকা আবার করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিমিত্তে গঠিত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মাত্র সাতশ অপরাধীর তালিকা পেয়েছে। বাকিগুলো খুঁজে বের করতে হবে।’
যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারও করারও দাবি করেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের বিচার চেয়েছি। কিন্তু আড়াই বছর হলো আইনমন্ত্রী আমাদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছেন যে, আইন সংশোধন করতে হবে। আইনে সংগঠন হিসেবে বিচারের কথা উল্লেখ থাকলেও তার শাস্তি কী হবে তা উল্লেখ নেই। এ জন্য আইন সংশোধন করতে হবে, কিন্তু আইন আর সংশোধন করা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ইসমত কাদির গামার সাথে কথা বলেছিল ঢাকাটাইমস। গামা বলেন, ‘রাজাকারের তালিকার ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখনও কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।’
সরকার কী ভাবছে?
স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির আদৌ কোন প্রয়াস সরকারের আছে কিনা, এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সামনে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করার পরই রাজাকারের তালিকা করার কাজে হাত দেবে সরকার। সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার জন্য প্রতিটি থানা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই শুরু হবে জানুয়ারি থেকে। এরপরেই আমরা রাজাকারের তালিকা করে ফেলবো।’
মন্ত্রী বলেন, ‘অতীতেও রাজাকারের তালিকা নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু নানা জটিলতায় তা সফল হয়নি। এবার আমরা রাজাকারের তালিকাটি নিরপেক্ষভাবে করতে চাই আমরা। এক্ষেত্রে অনেক জটিলতা আছে। আসলে সব কাজেই জটিলতা থাকে। আমরা সকল জটিলতা কাটিয়ে একটা নিরপেক্ষ রাজাকারের তালিকা করব ইনশাল্লাহ।’
(ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/জিএম/এসএএফ)

মন্তব্য করুন