কয়লার ময়লা যাবে কি?

মাসুদ কামাল
  প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৮, ০৮:২৫
অ- অ+

সোনার তুলনায় কয়লার দাম একেবারেই নগণ্য। কিন্তু ‘সোনা’ এবং ‘কয়লা’ এই দুটি ধাতুর সঙ্গে যখন ‘কেলেঙ্কারি’ শব্দটি যুক্ত হয়, তখন যেন অনেকটাই সমার্থক লাগে। দুটোকেই কালো দেখায়, ময়লাযুক্ত কালো।

গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ ব্যাংকে ভল্টের সোনা নিয়ে মিডিয়াগুলোতে বেশ আলোচনা শোনা গেছে। সরকারেরই আর একটা বিভাগ দাবি করেছে, ভল্টের সোনা নাকি পাল্টে দেয়া গেছে, বিশুদ্ধতায় হেরফের হয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। এই অভিযোগ-অস্বীকারের ধাক্কাধাক্কি শেষ হওয়ার আগেই সামনে চলে এসেছে কয়লা কেলেঙ্কারির কথা। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মজুদ থেকে বিশাল পরিমাণ কয়লা হঠাৎ করেই উধাও হয়েছে। আসলে হঠাৎ করে উধাও হয়নি, অনেক দিন ধরেই হয়তো হচ্ছিল, এবার কেবল ধরা পড়লো। সেটাও হয়তো পড়তো না, যদি না ধর্মঘটের কারণে খনির উৎপাদনে এই সময়ে কিছু ভাটা না পড়তো। এই খনি থেকেই নিয়মিত কয়লা সরবরাহ করা হতো বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এটি দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রতিদিন ৫ হাজার ২শ মেট্রিক টন করে কয়লা লাগে। কয়লা খনিতে মাঝে মাঝে উত্তোলনে বিরতি দিতে হয়। দেড়-দুই মাসের বিরতি। সেই হিসাবে গত ১৪ জুন থেকে বিরতি শুরু হয়, নতুন করে আবার আগস্ট মাস থেকে কয়লা তোলা শুরু হওয়ার কথা। মাঝের এই সময়টুকুতে আগের তুলে রাখা মজুদ থেকেই কয়লা সরবরাহ করার কথা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। খাতাপত্রে দেখা গেল প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা মজুদ আছে, তাই আগস্টের শুরু পর্যন্ত তেমন একটা চিন্তা নেই। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে দেখা গেল কাজির গরু কিতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই। এক লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বাস্তবে নেই, উধাও হয়ে গেছে। শুরু হলো হইচই। এত কয়লা গেল কোথায়?

কয়লা কি উদ্বায়ী পদার্থ? এমন তো নয় যে- ইয়ার্ডে কয়লা স্তূপ করে রাখা হলো, আর বাতাসে সেটা উড়ে চলে গেল। কেউ না কেউ সেটা সরিয়েছে। কিন্তু কে সরালো? আর কবেই বা সরালো। এক-দুই কেজি কিন্তু নয়, প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা। ট্রাক ভর্তি করে সরাতে গেলেও প্রায় ত্রিশ হাজার ট্রাক লাগবে! তাহলে কি এটা এক-দুই মাসে নয়, বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে সরানো হয়েছে? এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়েছে সেই ২০০৫ সাল থেকে। এই ১৩ বছরে কত কর্মকর্তা এসেছে, আবার চলেও গেছে। তাহলে এরা সবাই কি চোর ছিল? দু-একজনও কি ভালো লোক ছিল না? সবাই তাহলে অল্প অল্প করে কয়লা চুরি হতে দিয়েছে? না হলে ভালো লোকটির তো ধারাবাহিক এই চৌর্যক্রমে বাধা দেয়ার কথা ছিল। সাম্প্রতিক এই উত্তোলন কাজে কিছুটা বিঘœ না হলে হয়তো এই লোপাটের বিষয়টি ধরা পড়তে আরও কয়েক বছর লেগে যেত।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিকে ঘিরে দুর্নীতি অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই এটিকে কেন্দ্র করে নানা অভিযোগ, সমালোচনা শোনা গেছে। প্রথম বড় একটা অপকর্মের খবর পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণ তামার তার চুরির। সেটা ২০০৮ সালের কথা। খনি এলাকায় থাকা দুই কোটি নয় লাখ টাকা মূল্যের তামার তার উধাও হয়ে গেল। এই বিশাল চুরির জন্য তখন দায়ী করা হয় সামান্য এক শ্রমিকের বিরুদ্ধে। বলা বাহুল্য, আদালতের রায়ে সেই শ্রমিক পরে ছাড়া পেয়ে যায়। তাহলে তামার ওই তারগুলো কে চুরি করলো? এ নিয়ে আর কোনো ঘাটাঘাটি হয়নি।

খনির কয়লার সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যা চাহিদা, তার চেয়েও বেশি কয়লা উত্তোলন করার ক্ষমতা রয়েছে এই খনির। কয়লা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে একটা চীনা কোম্পানি। বাড়তি কয়লা বাইরে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। জানা গেছে, এই বাইরে বিক্রির ব্যাপারে খনির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আগ্রহ বেশি। খোলা বাজারে বিক্রি করতে গেলে কয়লার দাম বেশি পাওয়া যায়। তাছাড়া সেখানে এই কয়লার চাহিদাও অনেক। গুণগত মানের দিক দিয়ে আমাদের কয়লা অতি উৎকৃষ্ট। তাই ভারত থেকে আমদানিকৃত কয়লার চেয়ে বড়পুকুরিয়ার কয়লা পেতে সবাই আগ্রহী। বাইরে বিক্রির আর একটা সুবিধা হচ্ছেÑ ডিও লেটারের বাণিজ্য করা। ক্রেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় এতে স্থানীয় রাজনীতিবিদরাও জড়িয়ে পড়ে। কমিশন বাণিজ্য বেশি হয়।

আরও একটি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল একাধিক ব্যক্তি। এটিকে অনেকটা ‘দৃশ্যত বৈধ আয়’ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। কয়লা উত্তোলনের একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উত্তোলন করা গেলে বাড়তি কিছু কমিশন পাওয়া যাবে। কমিশনের টাকা বৈধভাবেই ভাগ হবে চায়নিজ কোম্পানি এবং খনির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। এমনকি সেই কমিশনের অর্থ খনিকে নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছেও আসবে। এটা বৈধ আয়। অনেকের মতে, এই বৈধ আয়ের অবৈধ বাস্তবায়নই আসলে এবারের কয়লা উবে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অতটা উত্তোলন না হওয়া সত্ত্বেও কমিশনটা পেতে সংশ্লিষ্টরা কাগজে-কলমে বাড়তি পরিমাণটা দেখিয়েছে। কাগজে-কলমে দেখানো সহজ হলেও বাস্তবে তো আর দেখানো যাচ্ছিল না। তার উপর এবার যখন উত্তোলনে একটা বিঘœ তৈরি হলো, তখন পুরো ফাঁকিটা ধরা পড়ে গেল।

আসলে এভাবেই হয়েছে, নাকি গত এক যুগ ধরে কিছু কিছু করে কয়লা বাইরে গোপনে বিক্রিই করা হয়েছেÑ সেসব হয়তো তদন্তে ধরা পড়বে। এর মধ্যে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি নাকি তাদের রিপোর্ট জমাও দিয়ে দিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও মাঠে নেমেছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী বেশ কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হজে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি যেতে পারবেন কি না তা নিয়েও দেখলাম আলোচনা হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতিক্রিয়াকে একেবারে মন্দ বলা যাবে না। মনে হয়, পানি বোধকরি অনেকেরই কানে ঢুকে গেছে।

এই যে কানে পানি যাওয়া, এটা কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। এই দেশে এমনি এমনি কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বশীলতা থেকে তেমন কিছু হয় না। হয় যে না, সেটা তো এই খনির কয়লা নিয়ে গত ১২ বছরেই দেখা গেছে। এবার যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয় তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করলেন, কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন, অমনি সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো। এই ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে ‘দায়ে পড়ে করা,’ কিংবা ‘দায়বদ্ধতা’Ñ কোনটা কতটুকু আছে বলা মুশকিল। হয়তো কিছুদিন পর দেখা যাবে, সবকিছুই কেমন ঝিমিয়ে গেছে। কয়লার অভাবে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘœ ঘটছে। আগামী মাস থেকে কয়লা উত্তোলন আবার শুরু হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়মিত হবে। তখন হয়তো সবাই বিষয়টি নিয়ে আর অতটা সিরিয়াস নাও থাকতে পারে। হয়তো তখন লোক দেখানো একটা তদন্ত রিপোর্ট আসতেও পারে।

এতসব আশঙ্কার কথা এমনি এমনি বলছি না। আসলে সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম দেখতে দেখতে আমরা সাধারণ মানুষ এখন বিচারহীনতাকেই যেন স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। দৃষ্টান্তমূলক কোনো বিচার দেখলেই বরং এখন অনেক বিস্মিত হতে হয়। চুরি, দুর্নীতি এখন যেন অনেকটা মজ্জাগত হয়ে গেছে। এত বিপুল কয়লা গায়েব যখন হয়ে গেছে, তখন মানতেই হবেÑ দুর্নীতি সেখানে হয়েছে। যারা করেছে এই দুর্নীতি, তারা তো এই সমাজেই বাস করেন, তাদেরকে সমাজে সম্মানীয় বলেই বিবেচনা করা হয়। তারা হয়তো আদর্শ পিতা, দায়িত্ববান স্বামী হিসাবেই পরিচিত। অনেকে আবার দৃশ্যত বেশ আচারনিষ্ঠ ধার্মিকও। নামাজ-রোজার পাশাপাশি হজও করেন। তদন্তের দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তারাও এই সমাজেই থাকেন। সকলের সঙ্গে মিলেমিশেই তাদের বসবাস। কে যে কার কোন দিক দিয়ে ঘনিষ্ঠ সেটাও বলা কঠিন। আর কয়লা বেচে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা যারা আয় করেছে, পাপ ঢাকতে তারা সবাই মিলে ওখান থেকেই অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ও করতে পারেন। কাজেই ঝাঁপাঝাঁপি আর লাফালাফি দেখেই দারুণ কিছু আশাবাদী হওয়ার মতো উৎসাহও যেন অনুভব করতে পারছি না।

তারপরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন, দেখা যাক কয়লার ময়লা যায় কি না।

মাসুদ কামাল: লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নীলফামারীতে কাঁচামরিচের কেজি ১০ টাকা, হতাশ মরিচ চাষিরা
মা হারালেন অর্ষা, হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিনেত্রীর স্বামীর ক্ষোভ
নারী কেলেঙ্কারির ভিডিও ফাঁসের পর আত্মগোপনে শরীয়তপুর ডিসি!
নতুন বাজার অবরোধ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা