দই এবং বগুড়া একই সুতায় গাঁথা (ভিডিও)
বগুড়া শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলা। তখন ইংরেজদের শাসনামল চলছিল। সে সময় শেরপুরের ঘোষ পরিবারের সদস্য ঘেটু ঘোষ প্রথম দই তৈরি করেন। তখন দই এরকম মিষ্টি ছিল না। চিনি বা গুড় ছাড়াই দই বানাতেন ঘেটু ঘোষ। এর স্বাদটা তখন ছিল টক। যে কারণে খাওয়ার সময় যাদের প্রয়োজন পড়তো তারা চিনি বা গুড় মিশিয়ে খেতেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে দইয়ের স্বাদেও টক থেকে চলে আসে মিষ্টতা। এরপর টক এবং মিষ্টি দুই ধরনের দইয়ের স্বাদই নিতে থাকে ভোজনরসিক মানুষরা। ঘোষেরা যখন দই তৈরি করতেন তখন দারুণভাবে এর গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো। যাতে করে বাইরের কেউ তাদের দই তৈরির ফর্মুলা জেনে না যায়। যে কারণে সে সময় বাইরের কেউ দই তৈরি করতে পারতেন না। তবে এত মজাদার খাবারের ফর্মুলা বেশিদিন তারা লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এক সময় জেনে গেছেন সবাই। তৎকালীন বাংলার ইংরেজ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন পর্যন্ত দই খাওয়ার পর এর স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৩৮ সাল। সে সময় তিনি প্রথম দই খাওয়ার পর ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। স্যার জন এন্ডারসনের হাত ধরেই সে সময় প্রথমবারের মতো বগুড়ার দই বিদেশে যাত্রা করে।
দই তৈরির সূচনা ঘেটু ঘোষ করলেও দইয়ের খ্যাতি এনে দেন গৌর গোপাল। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, দেশ বিভাগের সময় ১৯৪৭ সালে গৌর গোপাল ভারত থেকে বগুড়া আসেন পরিবার নিয়ে। এরপর শেরপুর উপজেলা সদরে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নেন। দই বানানোর পদ্ধতি তিনি আগে থেকে জানতেন। ফলে তিনি দই বানিয়ে বিক্রির চিন্তা করেন। এরপর যে ভাবা সেই কাজ। শুরু করেন দইয়ের ব্যবসা। তবে গৌর গোপালকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে দই ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে। দই তৈরির পর তিনি শেরপুর থেকে বগুড়া শহরের বনানী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ভাড় ভর্তি করে দই আনতেন বিক্রির জন্য। দইয়ের সঙ্গে তিনি বানাতেন সরভাজা। এ সরভাজা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় যে, ওই সময়ের জমিদারদের বাড়িতে সরভাজা সরবরাহের অর্ডার পেতে থাকেন গৌর গোপাল। এর এক পর্যায়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী বগুড়া শহরে তাদের নবাব প্যালেসের এক কোনায় আম্রকাননে দই বানানোর জায়গা করে দেন তাকে। সময়টা ছিল পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ। সে সময় তিনি শুধু বগুড়ার দুটি নবাব পরিবারের জন্যই দই তৈরি করতেন। পরে ঘোষ পরিবারের সুরেন ঘোষের সাথে ব্যবসা স¤প্রসারিত করে বগুড়ার দইয়ের এক নতুন যুগের সূচনা করেন। ফলে শুধু জমিদার বাড়ি নয়, সাধারণের মধ্যেও এ সরভাজার চাহিদা যায় বেড়ে। এ সরভাজাই গৌর গোপালকে এনে দেয় খ্যাতি। একটা সময় সরভাজাই সরার দই হয়ে খ্যাতির তুঙ্গে ওঠে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে ঘোষ পরিবারের আরেক সদস্য কুরানু ঘোষের দইয়ের কারবার। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে শেরপুরেই গড়ে তোলা হয় দইয়ের কারখানা। ষাটের দশকের প্রথমভাগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বগুড়ায় এসে দই খেয়ে মুগ্ধ হন। এরপর তিনি সে সময়ের ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের কাছে এবং মার্কিন মুল্লুকে বগুড়ার দই উপঢৌকন হিসেবে পাঠান। ব্রিটেনের রানীও এ দইয়ের ব্যাপক প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। এভাবেই বগুড়ার দইয়ের সুনাম দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় বগুড়ার দই জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভারতে। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর দেওয়া জায়গা আম্রকাননে ষাটের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত গৌর গোপালের উত্তরসূরিদের ঘর ছিল।
যেভাবে দই তৈরি করা হয়
শুরুর দিকে ঘোষেরা চালুনের ওপর (বাঁশের তৈরি অসংখ্য ছিদ্র বিশিষ্ট পাত্র) দই তৈরি করতেন। সে পদ্ধতির অধ্যায় চুকে গেছে অনেক আগেই। দেশ বিদেশে যে খাবারের এত খ্যাতি সে খাবারটি হুটহাট করেই তৈরি করা যায় না। করতে হয় দীর্ঘ তপস্যা। প্রায় ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় নিয়ে তৈরি করতে হয় সুস্বাদু এই দই। দই তৈরি করতে প্রথমে কড়াই বা পাতিলে গরুর দুধ, প্রয়োজন মতো চিনি মিশিয়ে চুলায় উঠিয়ে ৫ ঘণ্টা ধরে জ্বাল দিতে হয়। এ সময়টাতে অনবরত দুধ হাতা দিয়ে নেড়ে দিতে হয়। তা না হলে দুধ জ্বাল দেওয়ার পাত্রে পোড়া লেগে যেতে পারে। এভাবে দুধের কালার কিছুটা লালাভ রং ধারণ করা পর্যন্ত জ্বাল দিতে হয়। এরপর একটি চুলায় হালকা আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে মাটির হাঁড়ি বা সরা সাজিয়ে নিয়ে সেগুলোতে জ্বাল দেওয়া দুধগুলো ঢেলে রাখতে হয়। এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরাতেই দই বানানো হয়। সরা দেখতে অনেকটা মাটির সানকির (থালার মতো চ্যাপ্টা) মতো। এছাড়া ছোট ছোট হাঁড়ি এবং গøাসের মতো ছোট ছোট পাত্রেও জ্বাল দেওয়া দুধ ঢেলে দই বানানো হয়। তবে শুরু থেকে গত ২০ বছর আগ পর্যন্তও জ্বাল দেওয়া দুধ ডুঙ্গিতে ঢেলে দই বানানো হতো। দামে অল্প হওয়ায় ডুঙ্গির দই বিক্রি হতো বেশি। ডুঙ্গি দেখতে অনেকটা মেয়েলি শরীরের মতো! মুখটা গোল প্রশস্ত। আকর্ষণীয় কোমর আর ভারী নিতম্ব! ডুঙ্গি তৈরির প্রথম মৃৎ কারিগর হয়তো সুদর্শনা গড়নের নারীকে কল্পনা করেই এটাকে বানিয়েছিলেন! গরম জ্বাল দেওয়া দুধ এক এক করে সবকটি পাত্রে ঢেলে দেওয়ার পর বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশালাকার ডালা (টিপনি) দিয়ে সেগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়। এই ডালার এক পাশে খুব বড় নয় এমন গোলাকার ছিদ্র করে রাখা হয় যাতে করে ভেতরের গরম বাতাস বের হতে পারে। এরপর ৮ ঘণ্টা পর টিপনি তুলে খুব সামান্য পুরোনো দই জ্বাল দেওয়া দুধগুলোতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই পুরোনো দইকে বলা হয় দইয়ের বীজ। এরপর আরো বেশ কয়েক ঘণ্টা টিপনি দিয়ে ঢেকে রাখার পর দই প্রস্তুত হয়ে যায় খাবারের জন্য। দই তৈরির প্রক্রিয়ার সময় উপরের অংশে সুস্বাদু ঘন জমাট বাঁধা একটি স্তর পড়ে। অন্যান্য পাত্রের চেয়ে সরার মুখটি চওড়া হওয়ায় এতে সেই বিশেষ অংশটি বেশি পাওয়া যায়। এই পুরু অংশটি খেতে বেশ মজাদার। এ জন্য সরার দই অধিক জনপ্রিয় সবার কাছে।
দইয়ের প্রকারভেদ
গোড়ার দিকে শুধুমাত্র টক স্বাদের দই উৎপাদন করা হতো। সে সময় কেউ টক দই খেতেন আবার কেউ গুড় বা চিনি মিশিয়ে খেতেন। এরপর মিষ্টি দইও তৈরি শুরু হয়। দুই রকমের স্বাদের দই বাজারে মিলতে শুরু করে। টক দই দিয়ে ঘোল এবং রোস্ট তৈরির কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়। গত ক’বছর ধরেই ডায়াবেটিস রোগীদের কথা চিন্তা করে দই ব্যবসায়ীরা চিনি ছাড়া এবং দইয়ে টকের পরিমাণ কমিয়ে সাদা দই নামে এক ধরনের দই তৈরি করছেন যেটা চিনি ছাড়াও খেতে অনেক মজার। এছাড়া দইয়ের মতোই দেখতে আরেকটি দুগ্ধ জাত খাবার দই কারখানাতেই তৈরি করা হয়। এর নাম ‘ক্ষীরসা’। এটির মূল উপাদান দুধ। ‘ক্ষীরসা’ দইয়ের চেয়ে ঘন ও মিষ্টি হয়ে থাকে। দুধ বেশি পরিমাণ লাগে জন্য এর দামও বেশি। সেকালের দই, একালের দই: তখনকার দই আর এখনকার দইয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আগে দইয়ের পাত্র হিসেবে রাখা হতো ডুঙ্গিতে। তখন দইয়ে মিষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি থাকতো এবং দই হতো নরম। যে কারণে চামচে উঠালে দই এক পাশে দিয়ে পড়ে যেত। এখনকার দই বেশির ভাগই সরা নামক পাত্রে বানানো হয়। আর দইয়ে চিনির পরিমাণটাও কমিয়ে আনা হয়েছে। আর দইয়ের ঘনত্বটাও বেশি এবং স্বাদেও রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। এর কারণ বগুড়ার দইয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে কিছু প্রতিষ্ঠিত দই ব্যবসায়ী প্রতিনিয়ত দইয়ের গুণগত মান বজায় রাখতে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
দইয়ের বাজার
দই সনাতন ধর্মাবলম্বী ঘোষ পরিবারের সৃষ্টি হলেও এর স্বাদের খ্যাতির কারণে অনেক ব্যক্তিই দই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ফলে এক সময় দইয়ের বাজার ঘোষদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। কালক্রমে শেরপুরে গড়ে ওঠে অনেক দইয়ের কারখানা। বগুড়াতেও একের পর এক দইয়ের কারখানা তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করান মহরম আলী। এছাড়া বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া হোটেলও দই ব্যবসায় এগিয়ে আসে। ১৯৮৫ সালে আহসানুল কবির তার ‘দইঘর’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দই শিল্পে নিয়ে আসেন আধুনিকায়ন। দই তৈরির প্রক্রিয়া, প্যাকিং এবং বিপণনে তার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি দই শিল্পের নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়। স্বাদের উন্নতি এবং পরিবহনের সুবিধাজনক পদ্ধতির কারণে বগুড়ার দই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স¤প্রতি দইয়ের স্বাদে নতুনত্ব আনায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে এশিয়া সুইটমিট। এছাড়া চিনিপাতা, শ্যামলি, রুচিতা, সাউদিয়া, দইবাজার, ফুডভিলেজ নামের আরো শতাধিক প্রতিষ্ঠান দই উৎপাদন এবং বিপণন করছে।
বগুড়ার দইয়ের সমস্যা এবং সম্ভাবনা: বগুড়ার দইয়ের চাহিদা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েই আছে। যে কারণে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তাদের মোড়কে ‘বগুড়ার দই’ বলে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। এতে করে ক্রেতারা প্রতারিত হন এবং দই খাওয়ার পর তারা মনে করেন বগুড়ার দই শুধুমাত্র নামেই বিখ্যাত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বগুড়ার দই প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের ধারণা পাল্টে দিতে সক্ষম। বগুড়ার দই দেশের বাইরে নিয়মিত রপ্তানি করা যেতে পারে। যেহেতু এর খ্যাতি দেশের বাইরেও সমাদৃত। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এরকম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি নিয়মিতভাবে দই দেশের বাইরে রপ্তানি করা সম্ভব হয়, তবে বগুড়ায় দইয়ের কারখানাগুলো আরো প্রশ্বস্ত হবে। এর ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে অন্যদিকে অনেক বেকার নারী-পুরুষদের কর্মসংস্থানেরও একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দইয়ের বাজার মূল্য
বগুড়ায় অনেক দইয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানই দাবি করেন তাদের দই-ই গুণগত মানের দিক থেকে সেরা। যে কারণে বগুড়া শহরেই দইয়ের দাম একেক প্রতিষ্ঠানে একেক রকম। তবে শহরের সাতমাথা বা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যেসব দইয়ের দোকান আছে সেগুলো থেকে দই কিনতে চাইলে বর্তমান বাজার অনুযায়ী সাধারণ সরার দই ১৬০-২০০ টাকায় কিনতে হবে। এছাড়া স্পেশাল সরার দই ২০০ থেকে ২২০ টাকায় কিনতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/৩১ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/এজেড)

মন্তব্য করুন