পুলিশ কর্মকর্তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
 | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৫:২২

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ডকে মজবুত করতে পাঠাগারের বিকল্প নেই। পাঠাগার হচ্ছে জ্ঞান ভান্ডার। মানব সভ্যতার ইতিহাস আলোকিত করার শ্রেষ্ঠ অংশ পাঠাগার। আর পাঠাগার হলো বই, পুস্তিকা, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ও অন্য তথ্য সামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা- যেখানে পাঠক গ্রন্থপাঠ, গবেষণা ও তথ্য অনুসন্ধান করতে পারে। পাঠ্যবই পড়ে অর্জন হয় সার্টিফিকেট। নির্ধারিত এক শ্রেণির বিদ্যা। এটা মূলত গ্রন্থগত বিদ্যা। শ্রেণিভিত্তিক জ্ঞানের বাইরেও রয়েছে বিশাল একটি জগৎ। এই বিশাল জগতকে জানতে বই পড়ার বিকল্প নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কাছে এই বিশাল জগতটাকে পরিচিত করতে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরাঞ্চলে মগড়া ইউনিয়নের চৌরাকররা গ্রামে একজন কলেজপড়ুয়া ছাত্র নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার। সমাজের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়ানো তথা সুশিক্ষার কথা বিবেচনা করে, ‘এসো বই পড়ি, নিজেকে আলোকিত করি’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার’ নামে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা কলেজপড়ুয়া কামরুজ্জামান (সোহাগ) এখন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদে কর্মরত আছেন পুলিশ সদর দপ্তরে।

ছেলেবেলা থেকেই বই পড়তে পছন্দ করতেন কামরুজ্জামান । স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়তেন। ভাবতেন, গ্রামে একটি পাঠাগার থাকলে যখন ইচ্ছা বই পড়া যেত। মাধ্যমিক পাসের পর গ্রাম ছেড়ে টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন কামরুজ্জামান। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়ার সময় ২০১০ সালে নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন ওই পাঠাগারটি। তার সেই বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার এখন আলো ছড়াচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পাঠাগারটিতে বই পড়া, জ্ঞান আহরণ তথা তথ্য অনুসন্ধানের জন্য প্রতিনিয়তই পাঠকরা আসছে এই পাঠাগারে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোন বয়সের নারী-পুরুষ এখানে এসে জ্ঞানের অতল সমুদ্রে হারিয়ে যান। আবার কেউ চাইলে নির্দিষ্ট নিয়মে পাঠাগারের সদস্য হতে পারেন। কোন পাঠক ইচ্ছা করলে পাঠাগারে বসে বই পড়তে পারেন, আবার চাইলে বাড়িতে নিয়েও পড়তে পারেন।

কামরুজ্জামানের পুলিশে চাকরি হওয়ায় তার অনুপস্থিত সময়ে পাঠাগারটি থাকে স্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে। বিশেষ করে সাইফুল ইসলাম, আল আমিন, অনিক হাসান, হৃদয় আহম্মেদ, রিপন মিয়া, সাজ্জাদ হোসেনদের মতো বেশ ক’জন অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। তাদের সহযোগিতায় সদস্য হওয়া, বই নেয়া, বই ফেরত দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পন্ন হয়ে থাকে। তারাও তাদের কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করছেন। যদিও এটি পারিবারিক পাঠাগার তবুও গ্রন্থাগারটি পরিদর্শন ও অনুসন্ধান করলে বুঝা যায় এর গভীরের সৌন্দর্য। পাঠাগারের যাবতীয় কার্যক্রম সত্যিই অবাক হওয়ার মত। তবে, ফোনে যোগাযোগ, ছুটিতে এসে সমন্বয় ও অ্যাপের মাধ্যমে সবসময় প্রতিষ্ঠানটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন।

পাঠাগারটি এখন শুধু একটি ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। স্থানীয় বাজারে লোকমান হোসেনের ভাই-ভাই সেলুন, গোবিন্দের গোবিন্দ হেয়ার ড্রেসার, পলাশের পলাশ জেন্টস পার্লারসহ ৬টি সেলুনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বাতিঘর আদর্শ পাঠাগারের শাখা অনু-পাঠাগার। সেলুনে কাজ করাতে আসা মানুষ সময় নষ্ট না করে পড়ছেন বই। এদিকে ছোট বাসালিয়া কলেজ মোড়ে লায়ন নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বন্ধু ফাস্টফুড অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দেয়া হয়েছে বাতিঘর আদর্শ পাঠাগারের আরেকটি শাখা। এখানেও শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য পাঠক প্রতিনিয়ত পড়ছেন বই। জানছেন অজানা সব তথ্য। ভারি হচ্ছে জ্ঞানের পরিধি।

কামরুজ্জামান জানান, অনেক মানুষ আছেন, যারা বই পড়তে ভালোবাসেন। তবে নিয়মিত বই কিনে পড়ার সামর্থ নেই- তাদের জন্য সহজে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পাঠাগারটি শুধু বই পড়াকে ঘিরে নয়, আমরা বিনোদনের আয়োজনও করে থাকি। প্রতি বছর প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, বৃত্তি প্রদান, কবিতা আবৃতি, গান এবং কোরআনের হাফেজদের নিয়ে আল-কোরআন পাঠসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনা সভা করা হয়ে থাকে।

তিনি জানান, পাঠাগারের সংগ্রহে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ১৫ শতাধিক বই রয়েছে। ধর্মীয়, সাহিত্য, বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিহাসমূলক, জীবনী, চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, শিশু সাহিত্য ছাড়াও একাডেমিক বই বিদ্যমান। পাঠাগারটির উন্নয়নে যারা বই দিয়ে এবং বিভিন্ন সময় সুপরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক সরকারি সা’দত কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম জানান, আশেপাশে কোনো পাঠাগার না থাকায় বই পড়তে হলে আমাদের ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলা সরকারি গ্রন্থাগারে যেতে হতো। যা অনেক কষ্টসাধ্য ও দূরহ ছিল। তাই ইচ্ছা থাকলেও সবসময় বই পড়ার সুযোগ হতো না। এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ফলে আমরা খুব সহজে বই পড়ার সুযোগ পেয়ে অনেক উপকৃত হচ্ছি, তবে বইয়ের সংখ্যা এবং আসবাবপত্র আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

চৌধুরীমালঞ্চ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, পাঠাগারটি সাধারণ মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করছে যা তাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করবে। তাই পাঠাগারটির উন্নয়নে সমাজের শিক্ষানুরাগী ও বিত্তবানদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি ।

চৌরাকররা গ্রামের সমাজসেবক আব্দুল্লাহ (খোদাবক্স) বলেন, বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আজেবাজে আড্ডা না দিয়ে এই পাঠাগারে সময় দিচ্ছে যা তাদের বিভিন্ন আসক্তি থেকে দূর রাখছে। তাই আশা করি, এভাবেই এগিয়ে যাবে ‘বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার’। চারদিকে ছড়াবে জ্ঞানের আলো।

মগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাহারুল ইসলাম বলেন, এরকম একটি চমৎকার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পাঠাগারের সংশ্লিষ্ট সকলকে সাধুবাদ জানাই। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এই পাঠাগারটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমি প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে সবসময় পাশে থাকব।

(ঢাকাটাইমস/২৫জানুয়ারি/এলএ/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :