গোতাবায়া: শান্তির হিরো থেকে অশান্তির ভিলেন

সাইখ আল তমাল, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১২ জুলাই ২০২২, ২০:২০| আপডেট : ১২ জুলাই ২০২২, ২০:৩৬
অ- অ+

আশির দশকের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ-সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ হাজার। এছাড়াও গৃহযুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরো কয়েক হাজার। স্বাধীনতার পর ভারত মহাসাগরের এই ছোট্ট দ্বীপ দেশটির অবস্থা তৎকালীন সময়ে ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন।

১৯৭০ এর দশকের পূর্ব থেকে লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলাম (এলটিটিই) বা তামিল টাইগার নামে পরিচিত বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠনটি তাদের নানা তাণ্ডবে আতঙ্কে রাখতো শ্রীলঙ্কার সরকারসহ জনগণকে। সেসময় এলটিটিই বিশ্বের সবচেয়ে পরিশীলিত এবং শক্তভাবে সংগঠিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির একটিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭০ এর দশকে সংগঠনটি বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলা চালায়। ১৯৮৩ সালে তারা ১৩ সৈন্যকে হত্যা করলে পাল্টা আক্রমণে যায় শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী। তখন থেকে সরকার এবং এলটিটিইর মধ্যে বড় আকারের সহিংসতা শুরু হয়।

এলটিটিই এতটাই দুর্ধর্ষ ছিল যে ১৯৮৫ সালের মধ্যে তারা জাফনা এবং উত্তর শ্রীলঙ্কার জাফনা উপদ্বীপের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নির্দেশে এলটিটিই তার বেশিরভাগ তামিল প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে নির্মূল করেছিল। সংগঠন পরিচালনার অর্থ যোগান দিতে তারা তখন ব্যাঙ্ক ডাকাতি এবং মাদক চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরণের অবৈধ কার্যকলাপ পরিচালনা করতো। এছাড়াও সংগঠনটি বিদেশে বসবাসরত তামিলদের কাছ থেকে যথেষ্ট স্বেচ্ছামূলক আর্থিক সহায়তাও পেত।

এলটিটিই যোদ্ধাদের সংখ্যা কখনই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে অনুমান করা গেছে তাদের সংখ্যা প্রায় ১৬ হাজারের বেশি। ২০১১ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার ওপর তৈরি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ পুনর্বাসিত এলটিটিই যোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

দেশটিতে প্রায় ৩০ বছর ধরে চলে আসা এলটিটিই বনাম শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের নির্মম অবসান ঘটিয়ে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। ব্যক্তি হিসেবে তিনি উভয়ই, বিতর্কিত এবং দ্বীপরাষ্ট্রে একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। সিংহলি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাকে ‘যুদ্ধের নায়ক’ হিসেবেই মনে করে।

প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিবিদ এই গোতাবায়াই এখন অশান্তির ভিলেন। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে দেশটির রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। সেসময়টাতে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা সচিব। কিন্তু ২০০৯ সালে এলটিটিইর সুপ্রিমো ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মৃত্যুর সাথে সংঘাতের অবসান ঘটাতে গোতাবায়া রাজাপাকসের ভূমিকা বেশ বিভক্ত। কারণ তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকারও করেছেন।

যাইহোক, শ্রীলঙ্কার বর্তমানে চলা সবচাইতে সংকটময় পরিস্থিতির জন্যে তিনিই দায়ি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। শ্রীলঙ্কা আজকের পরিস্থিতিতে একদিনে এসে দাঁড়ায়নি। শুরুটা হয়েছে ২০১৯ সালের শেষের দিকে। তখন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে পপুলিস্ট ট্যাক্স কমিয়েছিলেন। করোনা মহামারী অর্থনীতিকে ধ্বংস করার কয়েক মাস আগে রাজস্বও হ্রাস করেছিলেন। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট গ্রাউন্ডেড এবং ধারাবাহিক লকডাউনের আদেশ দিয়েছিলেন।

সেসময়টায় শ্রীলঙ্কার প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকে তাদের চাকরিও হারিয়েছে। যদিও শ্রীলঙ্কা ভারতের মতো প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ক্রেডিট লাইন পেয়েছে, তবুও তারা নিয়মিত জ্বালানি এবং প্রয়োজনীয় খাবার আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে পারেনি। রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ২০২১ সালে রাজাপাকসের মূল বিষয় ছিল জৈব চাষ। কিন্তু এর ফলে সূত্রপাত হয়েছিল কৃষক বিক্ষোভের এবং সমালোচনামূলক চা ও ধান উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছিল।

বৈদেশিক-বিনিময় আয় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক ঋণ পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছিল দেশটি। উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীন থেকে ঋণের কারণে সেই বোঝাও কিছুটা বেড়েছে। ক্রমশ যখন দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখন নীতি নির্ধারকরা ঋণদাতাদের জানান, শ্রীলঙ্কা তার ঋণ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত অর্থপ্রদান করতে সক্ষম হবে না। এই পরিস্থিতির পর গত ১৯ মে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ওয়েরাসিংহে দেউলিয়ার ঘোষণা দেন।

সরকার যেভাবে সাড়া দিয়েছে

রাষ্ট্রপতি গত ৬ মে পূর্বের দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো জনসাধারণের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে আইন স্থগিত করার, লোকেদের আটক করার এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেন। দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়েছিল এবং স্থানীয় মিডিয়া জানিয়েছে, কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলে তা দমাতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতির সরকারী সমুদ্র উপকূলের বাসভবনে হামলার পর সংসদের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্দেনা ঘোষণা করেছিলেন, রাজাপাকসে পদত্যাগ করবেন। রাজাপাকসের ভাই মাহিন্দা পদত্যাগ করার পর মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে, তিনিও পরে পদত্যাগ করেন।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সোমবার (১১ জুলাই) গণবিক্ষোভের মুখে বাধ্য হয়ে পদত্যাগপত্রে সই করেন রাজাপাকসে গোতাবায়া, এরপর থেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া। সেদিন রাতেই সস্ত্রীক কলম্বো বিমানবন্দরে আসেন তিনি। সকালে যেতে চান আরব আমিরাত। তবে বাধার পাহাড় হয়ে আসেন অভিবাসন কর্মীরা। ফলে আর দুবাইয়ের ফ্লাইটে চড়া সম্ভব হয়নি পদত্যাগে বাধ্য হওয়া লঙ্কান প্রেসিডেন্টের।

পালাতে চেয়েছিলেন চেয়েছেন আকাশপথে। বিমানবন্দরে অভিবাসন কর্মীদের বাধায় পারেননি। আর এবার পালানোর চেষ্টা পানিপথে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুরে গোতাবায়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজে করে দুবাই পালানোর চেষ্টা করছেন। তবে তিনি যেতে পেরেছেন কি না সেটি নিশ্চিত জানা যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/এসএটি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকে মুখর
চাঁদপুরে বাসের ধাক্কায় অটোরিকশাচালকসহ নিহত ২
নির্বাচনে কোনো দেশের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়: জামায়াত আমির 
বিরাট কোহলির নামে থানায় অভিযোগ, যা বলছে পুলিশ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা