চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশায় ভরা: প্রসঙ্গ প্রধানমন্ত্রীর নতুন মন্ত্রিসভা

গত ১০ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এবং নবগঠিত ৩৭ সদস্যের সরকার শপথ গ্রহণ করেন। এটি তার পঞ্চম তবে টানা চতুর্থ মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রিসভায় নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ১৭ জন শপথ নিয়েছেন। আগের মন্ত্রিসভার ১৫ জন মন্ত্রী এবং ১৩ জন্য প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়েছেন। এবার মন্ত্রিসভা যে অনেকটা ভিন্ন হবে সেটা আগে থেকেই অনুমান করা গেছে। গত মন্ত্রিসভায় কয়েকজন মন্ত্রীর পারফরমেন্স এবং কথাবার্তা নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যে বিব্রতবোধ করেছিলেন, সমালোচনা শুনতে হয়েছিল- সেটি সকলেরই জানা বিষয়। তাছাড়া গত দুই তিন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। দেশের অভ্যন্তরেও বিশ্ব অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্যের অভিঘাত পড়েছিল। ফলে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য গত মেয়াদটি ছিল বেশ কণ্টকাকীর্ণ। যদিও গত মেয়াদেই দেশে সবচেয়ে বেশি মেগাপ্রকল্প এবং উন্নয়ন ও টানা সমাপ্তি সম্ভব হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ একদিকে স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ বেশ কিছু সাড়াজাগানিয়া কর্মকাণ্ডের উদ্বোধন ও কার্যকারিতায় জনমনে দারুণ উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল। অন্যদিকে একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্য, আর্থিক খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে বেশ সমালোচনা ও অসন্তোষ বিরাজ করছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। সেই পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশি এবং আন্তর্জাতিক নানা বাধাবিপত্তির মুখে পড়েছিল। বাইরের প্রধান বিরোধী দল ছোটো ছোটো নামসর্বস্ব দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে ম্লান করে দেওয়ার প্রচার প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত করা না যায় সেই চেষ্টাও তারা বিদেশি কিছু রাষ্ট্র এবং দেশি নানা অপশক্তির ইশারায় বাধাগ্রস্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। নির্বাচনের আগে হরতাল অবরোধ, সরকার উৎখাত এবং নির্বাচন করতে না দেওয়া ও বিদেশিদের নানারকম দৌড়ঝাঁপ ছিল এবারের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য মস্ত বড়ো চ্যালেঞ্জ। ফলে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ইত্যাদি নিয়ে সরকারের মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশকে আর কখনো নির্বাচনের প্রাক্কালে এতগুলো সংকট একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়নি। বিরোধীদলগুলো যতটা নিজেদের শক্তিতে, তার চাইতে বেশি বিদেশিদের প্রশ্রয়ে বেশ কয়েকটি মাস দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ পেয়েছিল। একটা বড়ো ধরনের অনিশ্চয়তার কালো মেঘ বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন ছায়া ফেলেছিল। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের মতো বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এমন অপপ্রচার দেশ এবং বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত চালানো হয়েছিল। এসবকে মোকাবিলা করা বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের যেকোনো সরকারের পক্ষে অবিশ্বাস্য রকম চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেইসব চ্যালেঞ্জকে ঠান্ডা মাথায় একের পর এক মোকাবিলা করেছেন, নির্বাচনের পথে বাংলাদেশকে চালিত করেছেন।
নতুন মন্ত্রিপরিষদে ১৭ জন নতুন মুখ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে যাত্রা শুরু করেছেন সেটি তার জন্য বেশ বড়ো চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে এতবারের প্রধানমন্ত্রী পদের অভিজ্ঞতা যে প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে, তিনি এবার অতীতের অনেককিছুই বিবেচনায় রেখে দেশের সম্মুখে যেসব চ্যালেঞ্জ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেগুলো তিনি মোকাবিলা করার অবস্থান থেকেই বর্তমান মন্ত্রিসভার আকার এবং প্রকার নির্ধারণ করেছেন। শেখ হাসিনা বরবারই স্রোতের বিপরীতে রাজনীতি করে এসেছেন, নানা চড়াই-উতরাই তাকে পার হতে হয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ কারা, তাদের আদর্শ কী- এসবই তার জানা আছে। ১৯৯৬ সালে যখন তিনি প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে, এত বছর পর সামরিক এবং আধা-সামরিক সরকারের শাসন অতিক্রম করে আসা শেখ হাসিনার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা এবং অর্থনীতিতে পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার ওপর ভরসা রাখা কৃষি অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার চ্যালেঞ্জ নেওয়া কি সম্ভব হবে ? তিনি ঠিকই এইসব জাতীয় সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কাজসমূহ বিনা দ্বিধায় করতে পেরেছিলেন। একইভাবে ২০০৯ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্য উৎপাদন, ডিজিটাইলেজশন, রাস্তাঘাট, মেগা প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রেরণ, কোভিড-১৯ মোকাবিলা, জঙ্গিবাদ দমন, সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ, ছিটমহল সমস্যার সমাধান ইত্যাদি কঠিন চ্যালেঞ্জ শেখ হাসিনা মোকাবিলা করার ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হয়েছে। এই বড়ো বড়ো সমস্যার শেখ হাসিনার হাত দিয়ে সমাধানও ঘটেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবারই বিএনপি এবং দক্ষিণ পন্থার রাজনৈতিক শক্তি জটিলতা তৈরি করে। সেইসব চ্যালেঞ্জও তাকে একের পর এক মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের সম্মুখে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান অতীব জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতির কারণে বাংলাদেশে বেশ কিছু দ্রব্যসামগ্রী ডলার সংকটের কারণে হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে মুল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দামও আকস্মিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে অনেককিছুই চলে যাচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেট দানবীয় রূপ ধারণ করেছে। পৃথিবীর কোথাও কোনো কিছুর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে সেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার এক অস্বাভাবিক প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যখন ঐ পণ্যের দাম হ্রাস পায় তখন বাজারে সেই জিনিসের দাম কমতে দেখা যায় না। বাজার এখন অসংখ্য সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। অথচ দেশে ‘প্রতিযোগিতা আইন ২০১২’ থাকা সত্ত্বেও এর প্রয়োগ ও কার্যকর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে করছে না। এর ফলে বাজারে কতিপয় একচেটিয়া কারবারির কর্তৃত্ব ভাঙা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ভরা মৌসুমেও চালের দাম যখন-তখন বৃদ্ধি করার প্রবণতা রয়েছে। এককথায় গোটা বাজার ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলার মধ্যে নেই। এখানে দ্রুত শৃঙ্খলা কার্যকর করতে হবে। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে বাজার থেকে সিন্ডিকেট নামক ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিলোপ করবেন। আমরা আশা করবো- নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্বভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীগণ তাদের মন্ত্রণালয়ে সমস্যাসমূহ দ্রুততার সঙ্গে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। কোথায় কোন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমাধান দেওয়া তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। সেটি কীভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ একত্রিত হয়ে সমাধানের পথ নির্ধারণ করবেন, তা তারাই ভালো করে বুঝবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আবুল হাসান মাহমুদ আলী এসেছেন। তিনি অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ হওয়ায় সকলেই আশা করছে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যেসব সমস্যা ও অনিয়ম সরকারের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে তা তিনি একে একে সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। ব্যাংকিং খাতে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে রোধই করা শুধু নয়,পুনরুদ্ধারেরও উদ্যোগ তাকে নিতে হবে। দুর্নীতি এই সময়ের মস্ত বড়ো চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সুতরাং দেশের অর্থনীতির বিশাল খাতকে কীভাবে সঠিক পথে আনা যাবে তা অর্থ মন্ত্রণালয়কেই সমাধান করতে হবে। বিশেষত আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ, রাজস্ব আদায়, রপ্তানি আয় ইত্যাদিতে যে সমস্যাগুলো জট পাকিয়েছে সেগুলোর সমাধান খুবই জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ড. হাছান মাহমুদ এসেছেন। আগে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এখন তাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, কৌশল এবং ভাষাকে রপ্ত করে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথা না বলাই ভালো। সব মন্ত্রণালয়ই যেন নিজের পরিধিতে থেকে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উদ্যোগ নেয়। সেটিই সকলের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক জটিল মেরুকরণ সমস্যার মধ্যে অবস্থান করেও আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই বর্তমান মন্ত্রিসভাকে পাশে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার পঞ্চম বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্ব পালন দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন স্মরণীয় হয়ে থাকে, বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার নামও যেন বঙ্গবন্ধুর পরেই সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের সফল ইতিহাস তুলে ধরে- সেটিই সকলের কাম্য।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন