বছরের শুরুতেই আর্থিক চাপ, উপায় খুঁজছে মানুষ

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় একটি ভাড়াবাড়িতে বাস করেন মো. বিল্লাল মিয়া। মাসিক ২৬ হাজার টাকা বেতনে গ্রীন রোডের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করেন। এই বেতন থেকে বাসাভাড়া ১২ হাজার, বাজার খরচ ১০ হাজার, দুই সন্তানের লেখাপড়া ৫ হাজার এবং যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয় তার। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকার মতো ব্যয়। এতে করে বেতনের টাকা সম্পূর্ণ ব্যয় করার পরও প্রতিমাসে অন্তত ৪ হাজার টাকা ঋণের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে।
এই আর্থিক সংকটের মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বছর। বছরের শুরুতেই দুই সন্তানের নতুন শ্রেণিতে ভর্তি ও তাদের পড়ালেখা বাবদ নিয়মিত খরচের বাইরে অতিরিক্ত আরও ৫ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে।
এছাড়া বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাস থেকে বাসাভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পেয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে বছরের শুরুতেই ব্যাপক দুশচিন্তায় পড়েছেন বিল্লাল মিয়া। রয়েছেন চরম আর্থিক চাপে।
শুক্রবার দুপুরে আক্ষেপের সুরে ঢাকা টাইমসকে বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘বছরের শুরুতে আর্থিকভাবে ধাক্কা খেতে হচ্ছে। সন্তানদের নতুন শ্রেণিতে ভর্তি, নতুন বই কিনতে বাড়তি খরচ হয়েছে এই মাসে। এছাড়া বাড়ি ভাড়ার নোটিশও পেয়েছি। এরমধ্যে আবার বেড়েছে চালের দাম। আগে বস্তাধরে চাল কিনলেও এই মাসে খরচ বাড়ার কারণে কেজি হিসাবে চাল কিনছি।’
চাকরি থেকে উপার্জিত টাকায় সংসার চালাতে বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করেও মাস শেষে ঋণি হতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খরচ কমানোর জন্য মাছ মাংস কেনা একেবারে কমিয়ে দিয়েছি, ডাল ডিম এবং অন্যান্য নিরামিষ খাবার সারা মাস খেতে হচ্ছে, সকল ধরনের বিলাসিতা বাদ দিয়েছি, প্রসাধনী ব্যবহার বাদ দিয়েছি, আগে বাচ্চাদের নানা ধরনের খাবার খাওয়ালেও অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তা বন্ধ করেছি। এছাড়া চলাচলের জন্য রিকশা তো দূরের কথা বাসে চড়ার ক্ষেত্রেও অনেক হিসাব নিকাশ করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, এত উপায় অবলম্বনের পরও পেরে উঠছি না। মাস শেষে দেনা হতে হচ্ছে। এদিকে সমস্ত কিছুতে ব্যয় বাড়লেও বেতন বাড়েনি। এই অবস্থায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম একটি চাকরি খুঁজছি।
বিল্লালের মতো একই সংকটে পড়েছেন আরেক চাকরিজীবী শাহনেওয়াজ ইসলাম। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে মগবাজারের গাবতলী এলাকায় ১৪ হাজার টাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি। সম্প্রতি বাড়িওয়ালার ভাড়াবৃদ্ধির নোটিশ পেয়েছেন তিনিও। এছাড়া নতুন বছরের শুরুতে সন্তানদের নতুন শ্রেণিতে ভর্তি, বই কেনা, স্কুলের জন্য নতুন পোশাকসহ বেশকিছু বাড়তি খরচের মুখোমুখি শাহনেওয়াজ। এতে বছরের শুরুতেই নানামুখী আর্থিক সংকটে তিনি।
শুক্রবার দুপুরে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে শাহনেওয়াজ জানান, মাসিক ৩৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন তিনি। এই টাকায় সংসার চালালেও নতুন বছরে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাকে। বলেন, ‘চাকরি করে প্রতিমাসে যে টাকা বেতন পাই তার ওপর নির্ভর করেই সংসার চলে। বেতনের টাকা থেকেই বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে হয়। কিন্তু চলতি মাসে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, সন্তানদের পেছনে ভর্তি ফিসহ সাংসারিক কিছু খরচ বৃদ্ধিতে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।’
শাহনেওয়াজ বলেন, ‘সাংসারিক এসব খরচের পাশাপাশি বর্তমানে নাগালের বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। সবশেষ গত কয়েকদিনে চালের দামও কেজি প্রতি ৪ থেকে ৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, যা অন্যান্য বছর ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হতো। শীতের সবজিরও একই অবস্থা। সব মিলিয়ে বর্তমান সময়ে টিকে থাকাটা অনেক কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দামসহ জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে এমনিতেই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টে শুরু হয়েছে নতুন বছর। ফলে নিয়মিত খরচের সাথে বেশকিছু বাড়তি খরচ যোগ হওয়ায় সংসারের হিসাব সমন্বয় করতে গলদঘর্ম হচ্ছেন শাহনেওয়াজের মতো অনেকেই।
বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, সন্তানদের নতুন ক্লাসে ভর্তি, স্কুল-কলেজের নতুন পোশাক, বিভিন্ন বকেয়া পরিশোধ, বাসাবাড়ি সংস্কারসহ নানারকম বাড়তি খরচে প্রতি বছরের শুরুতেই এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের। এর বাইরে সম্প্রতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে চালসহ সব নিত্যপণ্যের দাম। সেইসঙ্গে গত কয়েকদিন ধরেই সারাদেশে মারাত্মক রকমের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলছে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা কমে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছে। এ অবস্থায় কমেছে দিনমজুরসহ সাধারণ শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়। সেইসঙ্গে সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, টনসিলাইটিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সের মানুষ। যে কারণে অন্যান্য খরচের সঙ্গে বছরের প্রথমেই চিকিৎসা বাবদ গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। ফলে আরও বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এমতাবস্থায় বছর শুরুর আর্থিক ধাক্কা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছেন তারা।
রাজধানীর মগবাজার, ইস্কাটন, বাংলামোটর, মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা এলাকার ডজনখানেক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা টাইমস। তারা বছরের শুরুতে বাড়ড়ি ব্যয়ের কথা বলেন।
তাদের ভাষ্য, খরচের তুলনায় আয় বেশি বাড়লে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু আয়ের চেয়ে বেশি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। যার কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
বেসরকারি চাকুরিজীবী রতন বিশ্বাস বলেন, ‘বর্তমান বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম খুবই বেশি। এছাড়া শীত মৌসুম চললেও বাজারে শীতকালীন সবজির দাম এখনো চড়া। চাল, ডাল, মাংস সবকিছুর দাম বেড়েছে কিন্তু আয় বাড়েনি।’
মৌচাক এলাকার একটি মেসে থেকে সিদ্দেশ্বরী কলেজে পড়াশোনা করেন সাইদুর রহমান। আগে বাড়ি থেকে ৬ হাজার টাকা আনতেন। এই টাকায় মেস খরচসহ যাবতীয় খরচ হয়ে যেত। তবে বছরের প্রথম মাসে এই টাকায় চলতে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে তাকে। ঢাকা টাইমসকে তিনি জানান, বছরের শুরুতে সেমিস্টার ফি’র টাকা গুনতে হয়েছে। যার কারণে এ মাসে বাড়ি থেকে বাড়তি টাকা আনতে হয়েছে।’
সাধারণ মানুষের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাজার ব্যবস্থা, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, ব্যবসায়ীদের মুনাফার পলিসি, সরকারের ট্রাক্সভ্যাট পলিসি সংস্কার করে ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম। এই মূহুর্তে সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেছেন না জানিয়ে ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘শুধু এখন না সারাবছর ধরে এমন হয়ে আসছে। ভোক্তারা অসহায়, তারা প্রতিবাদমুখর হতে পারছে না বা হচ্ছে না। সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে নাÍ এটা তাদের বোঝা দরকার। এই সমস্ত ব্যবসায়ীদের লুণ্ঠনমূলক মুনাফা থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করা প্রয়োজন।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শুধু বাজার অভিযান বা দাম বেঁধে দিয়ে কোনো কাজ হবে না। নীতি, সরবারহ বৃদ্ধির পদক্ষেপ এবং অনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমানয়ে কমে আসবে।’
এদিকে গেল বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ- ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪৮ পয়সায়। আর চলতি বছরের শুরুতেই যে আর্থিক চাপ শুরু হয়েছে তাতে একজন মানুষের সেই খরচ দাঁড়াবে ১২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১০ টাকার বেশি। সে হিসাবে প্রতি মাসে খরচ বেড়েছে ৩ হাজার টাকার বেশি।
তবে গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ ২০ শতাংশের বেশি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। অর্থাৎ- একটি গরিব পরিবারের খরচ এক-পঞ্চমাংশের বেশি বেড়ে গেছে। কারও কারও ক্ষেত্রে তা আরও বেশি।
(ঢাকাটাইমস/২১জানুয়ারি/এলএম/এসআইএস)

মন্তব্য করুন