ইসরায়েলে গোপন পারমাণবিক ভাণ্ডারের সন্ধান: মদদে আমেরিকা, শঙ্কায় বিশ্ব

ষাটের দশক থেকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ইসরায়েল। তবে দেশটি এখন পর্যন্ত কখনো তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। আবার সরাসরি অস্বীকারও করেনি। এই কৌশলগত অস্পষ্টতা—যাকে বলা হয় আমিমুত—নিয়েই চলছে তাদের পারমাণবিক নীতির বাস্তবায়ন।
সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময়ের প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি আরও প্রকট বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অথচ আমেরিকার কাছে ইসরায়েল এখন স্নেহধন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাতে পারমাণবিক মাত্রা যুক্ত হলে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে, যখন ফ্রান্সের সহায়তায় তারা দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ডিমোনার পাশে একটি পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলে। ওই কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল ‘শান্তিপূর্ণ গবেষণা’। তবে ১৯৬২ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা যায়, প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল প্লুটোনিয়াম চুল্লি নির্মাণ—যা মূলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করে।
ডিমোনার নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার আজও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) পরিদর্শনের বাইরে রয়েছে।
ইসরায়েলের সাবেক পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনু ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বিশ্বের সামনে এই গোপন কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরেন। ১৯৮৬ সালে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, তখন ইসরায়েলের কাছে ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল।
ভানুনুর তোলা ছবিতে দেখা যায়, চুল্লিতে প্লুটোনিয়াম নিষ্কাশনের সরঞ্জাম এবং পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী পরিকাঠামো বিদ্যমান। এই তথ্য ফাঁস করার অপরাধে তাকে ১৮ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো এর চেয়ে বেশি হতে পারে। কারণ চুল্লির উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ইসরায়েলের সরকারি ভাষ্যের চেয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ ভিন্ন। সরকারি তথ্য বলছে চুল্লির ক্ষমতা ২৬ মেগাওয়াট, কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন এটি অন্তত ৭০-১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার।
ইসরায়েল কখনো প্রকাশ্যে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। আবার অস্বীকারও করেনি। এই দ্ব্যর্থতার কৌশলকেই বলা হয় "আমিমুত"। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, "অস্পষ্টতা এমন এক অস্ত্র, যা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক।"
এই নীতির সমালোচকরা বলছেন, এই অস্পষ্টতাই মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। আর সমর্থকদের মতে, এটি ইসরায়েলকে টিকে থাকার কৌশলগত সুযোগ দিয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষর করেনি ইসরায়েল। ফলে তাদের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো IAEA’র বাধ্যতামূলক পরিদর্শনের আওতায় পড়ে না।
অপরদিকে ইরানসহ অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী। কিন্তু ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে সম্প্রতি ইরান NPT থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছে।
জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ ইনস্টিটিউটের মতে, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র এবং তাদের গোপনীয়তার নীতি মধ্যপ্রাচ্যকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়।
গবেষক জেভিয়ার বোহিগাস বলেন, "যখন আমরা ইসরায়েলের মতো দেশের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানি না, তখন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা অনুমান করতে হয় এবং দেখা যাচ্ছে, এই অনুমান বাস্তবতার কাছাকাছি হয়।"
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের উত্তাপ, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র, ইরানের সম্ভাব্য অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা—সব মিলিয়ে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চেষ্টার মুখে ইসরায়েলের এই অস্পষ্ট নীতির ভবিষ্যৎ কী হবে—তা এখন বড় প্রশ্ন। ইসরায়েল কি আমেরিকার স্নেহধন্য হয়েই থাকবে?
(ঢাকাটাইমস/২৩ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন