মির্জাপুরে নৌকার পক্ষে কাজ করায় তিন পরিবার একঘরে
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় তিন পরিবারের ২৩ জন সদস্যকে সমাজ থেকে একঘরে করে (বন্ধক) রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মসজিদে নামাজ পড়া ও মারা গেলে কবরস্থানে দাফন না করা, আর্থিক লেনদেনসহ তাদের সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধানও করা হয়েছে।
সামাজিক এই নিষেধাজ্ঞার ফলে নারী ও শিশুসহ তিন পরিবারের ২৩ জন সদস্য দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে বলে জানা গেছে।
অমানবিক মানবিক এই ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নের গেরামারা গ্রামে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের পক্ষে আব্দুল বারেক মির্জাপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছেন।
জানা গেছে, গত ১৬ এপ্রিল মির্জাপুর উপজেলার বহুরিয়া, লতিফপুর, ফতেপুর, তরফপুর, আজগানা ও ভাওড়া ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন ওই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু সাঈদ ছাদু। আর বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন শিল্পপতি রেজাউল করিম বাবলু। দলীয় মনোনয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান পদে আবু সাঈদ ছাদুকে নৌকা প্রতীক দিলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে শিল্পপতি রেজাউর করিম বাবলু আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
এদিকে শিল্পপতি রেজাউল করিম বাবলুর গেরামারা গ্রামের বাসিন্দা ও তার সমাজের সদস্য হয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচনে কাজ করেন আব্দুল বারেক (৬০) শামসুল আলম (৬০) ও সুরুজ সিকদার (৪২)-সহ তাদের পরিবারের সদস্যরা। নির্বাচন চলাকালে আনারসের পক্ষে কাজ করার জন্য নানাভাবে চাপ দেয়া হলেও তারা নৌকার পক্ষ কাজ করতে থাকেন। পরে ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বাচনের আগের রাতে আনারস প্রতীকের লোকজন তাদের ওপর হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে গুরুতর আহত করে এবং ৪/৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় শিল্পপতি রেজাউল করিম বাবলুসহ তার কয়েকজন কর্মীর নাম উল্লেখ করে মির্জাপুর থানায় একটি মামলা করেন।
এদিকে নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে শিল্পপতি বাবলু কিছু ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলে তাদের প্রতি ক্ষোভ বেড়ে যায়। একদিকে নির্বাচনে পরাজয় অপরদিকে মামলা দিয়ে হয়রানি করায় ওই তিন পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে নানাভাবে চাপ ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন আনারসের লোকজন। কিন্তু তারা মামলা তুলে না নেয়ায় গত ১৯ মে বৈঠক ডেকে তিন পরিবারকে সমাজের বন্দক দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে সমাজের পক্ষ থেকে মোস্তফা (৫২) লিটন (৪০) ও দেলোয়ার (৪২) তাদের সিদ্ধন্তের কথা জানিয়েছেন দেন। বৈঠকে মসজিদে নামাজ পড়া ও মারা গেলে কবরস্থানে দাফন না করাসহ তিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সমাজের সবাইকে আর্থিক লেনদেনসহ সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে সমাজের ওই সদস্যকে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধানও করা হয়।
সামাজিক এই নিষেধাজ্ঞার ফলে তিন পরিবারের নারী ও শিশুসহ অন্য সদস্যরা দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। বন্দক থাকা পরিবারের সদস্য মো. সরোয়ার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মসজিদের আমাদের নামাজ পড়তে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া আমাদের মুদি দোকান থেকে কাউকে কিছু কেনাকাটা করতে দেয়া হচ্ছে না। সমাজের কাউকে আমাদের জমি জমাতেও কাজ করতে দিচ্ছে না তারা।’
আব্দল বারেক বলেন, ‘আনারসের নির্বাচন না করায় সামাজিকভাবে একঘরে রাখার পাশাপাশি তারা আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে এবং প্রায়ই হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।’
গেরামারা মসজিদের ইমাম মাওলানা রফিকুল ইসলাম অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সমাজের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
গেরামারা সমাজের সভাপতি শিল্পপতি রেজাউল করিম বাবলুর ভাতিজা সারফুল ইসলাম রাসেল তিন পরিবারকে বন্দক দেয়ার কথা স্বীকার করলেও তিনি নিজে এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলে জানান। চাচাসহ অন্যরা এই সিদ্ধান্ত নেয়ায় তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে অসহায় বলেও স্বীকার করেন। তবে সামাজিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে চাচা বাবলু সাহেবের নির্বাচন করা ঠিক হয়নি বলেও রাসেল উল্লেখ করেন।
শিল্পপতি রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘তারা এলাকাবাসীর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনই করেনি। নির্বাচনের সময় তার কর্মী ও সমর্থকে মারপিট করাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতে ধরিয়ে দিয়ে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করিয়েছে।’
সমাজের বন্দকের বিষয়ে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা সমাজবাসীর সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আমার কোনো কথা নেই। তবে সবাই মিলেমিশে চলবে এটা আমিও চাই।’
এ ব্যাপারে মির্জাপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
(ঢাকাটাইমস/০১জুন/প্রতিনিধি/জেবি)
মন্তব্য করুন