বাতাসে বিষ: বাঁচার উপায়?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:০৩ | প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:২২

ইশরাতকে দুদিন ধরে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছেন না মা। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বন্ধ খেলাধুলাও। জানালার কাচ গলিয়ে ঘরে আলো ঢুকলেও বাতাসের পথ রুদ্ধ। মেয়েকে নিয়ে একরকম বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন মিরপুরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা মৌমিতা। প্রয়োজন না হলে নিজেও ঘরের বাইরে যান না। স্বামীকেও মাথায় ক্যাপ আর নাকে মুখোশ পরে অফিসে যাতায়াত করতে হয়। জানতে চাইলে মৌমিতা বলেন, ছোটবেলা থেকে মেয়ের শ্বাসনালীতে সমস্যা। ধুলোবালি থেকে হয়েছে। এটি ওর জীবনের শত্রু। কিন্তু ঢাকায় যে অবস্থা, বাসা থেকে বের হলে নিশ্বাস নিয়ে শান্তি নেই। দূষণে বুক ভারী হয়ে আসে। ইদানীং বেড়েছে। জানালা খুললে আসবাবপত্র ধুলায় সাদা হয়ে যায়। কী করবো বলেন?’

মৌমিতার মতো ঢাকার বাসিন্দাদের হাল প্রায় একই। ধূলিধূসর পরিবেশে বাঁচতে হচ্ছে। নিশ্বাসে প্রতিমুহূর্তে ভেতরে যাচ্ছে বিষাক্ত বায়ু। অসুস্থ হচ্ছে শিশু, নারী ও বয়স্করা। অমল বায়ুর সন্ধানে হাঁসফাঁস করা মানুষের জীবন কাটছে দারুণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকাগুলো একই দশা। কোথায় যাবে তারা? এ থেকে বাঁচারই বা উপায় কী? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

বিশ্বের এক নম্বর দূষিত বায়ুর শহর বলে পরিচিত ভারতের দিল্লি। কদিন আগে আমাদের ক্রিকেটাররা সেখানে খেলতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, মুখোশ পরে নামতে হয়েছে অনুশীলনে। সেই দিল্লিকে ছাপিয়ে গেছে ঢাকা! দূষণে। দিল্লির চেয়ে ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত। বিষাক্ত।

গত ২৮ নভেম্বর বায়ুমান সূচকে (একিউআই ইনডেক্স) দিল্লির স্কোর ছিল ১১২। আর ২০৩ স্কোর নিয়ে শীর্ষে উঠেছে ঢাকা। এটি আমাদের জন্য আশঙ্কার খবর বটে। দিল্লি সম্প্রতি বায়ুদূষণ ঠেকাতে সচেষ্ট হয়েছে। নিয়েছে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। যাতে পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমরা গেছি পিছিয়ে। ‘অতি অস্বাস্থ্যকর’ এই পরিবেশ থেকে রক্ষার উপায় নিশ্চয়ই আছে। দিল্লি পেরেছে। আমরা কেন নয়?

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়তই অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ হয়। এতে জনদুর্ভোগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এটিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার প্রস্তুতিও থাকতে হয়। যেটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। ঢাকার রাস্তায় এখন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ হচ্ছে। মাটির নিচে ক্যাবল লাইনে কাজ হচ্ছে। প্রতিদিনই খোঁড়া হচ্ছে রাস্তা। খোঁড়াখুঁড়ির ধুলোমাটি পড়ে থাকছে পথে। দিনের পর দিন। এগুলো একসময় রোদে শুকিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। নিশ্বাসে ঢুকছে মানবদেহে। এর বাইরে আছে নাগরিকসৃষ্ট বর্জ্য, গাড়ির জ্বালানি পোড়া ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য। তবে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে ইটভাটার কারণে। ঢাকার কোলঘেঁষা এলাকায় এসব ভাটা থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে বাতাসকে ভারী করে তুলছে। দূষিত করে তুলছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের ৫০ ভাগ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ ভাগ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে। ১০ ভাগ দূষণ হয় গাড়ির জ্বালানি থেকে। শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকে ১০ ভাগ।

পরিবেশবিদরা বলছেন, উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে বায়ুদূষণ দূর করা যাবে না। কাজ চলবে পাশাপাশি। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে হবে। যেসব জায়গায় খোলা পরিবেশে ধুলোবালি তৈরি হচ্ছে, সেখানে পর্যাপ্ত পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রাস্তার পাশে বা খোলা জায়গায় ধুলো-মাটি ফেলে রাখা যাবে না। হয়তো ঢেকে দিতে হবে অন্যথায় বদ্ধ পরিবেশে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে আমাদের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বরাবরই এ ব্যাপারে উদাসীন। অস্বাস্থ্যকর এই পরিবেশ যে মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, এটি তারা ভুলে কখনো ভেবেছেন বলে মনে হয় না। যদি তাই হতো, তাহলে আরও আগেই উদ্যোগ চোখে পড়তো।

শিশু ও বয়স্করা বেশি ভুগছে এমনিতে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুদূষণ বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। মার্চের পরও কয়েক মাস বায়ুদূষণ অতিমাত্রায় লক্ষ্য করা গেছে। এটি আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বায়ুতে মিশে থাকা এই ‘বিষে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও প্রবীণরা। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। দূষিত পরিবেশ তাদের স্বাস্থ্যহানির বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকরা বলছেন, এখনকার সময়ে বেশি রোগী আসছে শ্বাসকষ্ট বা এই জাতীয় রোগ নিয়ে। এছাড়া মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও কমে আসে দূষিত বায়ুর প্রভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস ক্যানসার তো আছেই। সাধারণত মানুষ এসব ব্যাপারে সচেতন না হওয়ায় দিনকে দিন নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্তের হার বাড়ছে।

নীতিমালা প্রণয়নে হাইকোর্টের নির্দেশ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ অবস্থা গেছে যে, দেশের উচ্চ আদালতও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বায়ুদূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আর কী কী উপায়ে বায়ুদূষণ রোধ করা যায়, সে ব্যাপারেও এ কমিটিকে সুপারিশের আদেশ দেওয়া হয়েছে। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এলাকায় অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দেয় আদালত। দুই মেয়রকে ঢাকায় পানি ছিটানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

উদাসীনতা দায়ী?

নগরীর পরিবেশ নিয়ে আমরা এতটাই উদাসীন যে, আদালতের নির্দেশের পর আমাদের নড়েচড়ে বসতে হয়। এর আগে কি এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মতো কেউ ছিলেন না? পরিবেশ অধিদপ্তর এখন যে ভ্রাম্যমাণ্য আদালত পরিচালনা করছেন, এতদিন এটি কেন করা হয়নি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর কী আছে? সমস্যা সমাধানের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। এটি জানা থাকার পরও আমরা কেন ভোগান্তি এড়াতে পারি না?

ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দুটো ভাগ করা হয়েছিল সেবার মানবৃদ্ধি এবং কার্যক্রম যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় সে জন্য। কিন্তু দুই নগর কর্তৃপক্ষ কি তাদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পেরেছে বা পারছে? কদিন আগে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কতটা উদাসীন নগর কর্তৃপক্ষ। এখন ধুলো নিয়ে যা হচ্ছে, এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের কোনো উদ্যোগ কি অব্যাহত ছিল? আদালতের নির্দেশের পর ঢাকার কিছু রাস্তায় পানি ছিটাতে দেখা গেছে নগর কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু এর আগে তারা কোথায় ছিলেন?

অস্বীকার করছি না, ঢাকার পরিবেশকে বাসযোগ্য ও স্বাস্থ্যকর করে তুলতে শুধু নগর কর্তৃপক্ষের সক্রিয় থাকলেই হবে না, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও সক্রিয়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা প্রয়োজন। কিন্তু পথ তো দেখাতে হবে নগর কর্তৃপক্ষকেই। বায়ুদূষণ নিয়ে এখন যেমন আলোচনা হচ্ছে, যেসব তৎপরতা চোখে পড়ছে ইতিপূর্বে তো এটি দেখিনি। যদি তারা আগে থেকেই উদ্যোগী হতেন, তাহলে হয়তো বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে ঢাকার নামটি উঠে আসতো না।

আমাদের নগরকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাজের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন। কিন্তু এটি হচ্ছে না। কার কী দায়িত্ব এই হিসাব করতে গিয়ে ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের। ওয়াসার কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়া হলে এবং পথের পাশে মাটি ফেলে রাখলে নগর কর্তৃপক্ষ সেদিকে চোখ তুলেও তাকায় না। এগুলো তাদের কাজ না বলে ফেলে রাখে। কিন্তু ওয়াসাকে চাপ সৃষ্টি করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার উদ্যোগ তো তারা নিতে পারে, সেটি কি করা হয়? যদি করাই হবে তাহলে খুঁড়ে রাখা রাস্তার দুই পাশে কেন বালুমাটির স্ত‚প পড়ে থাকে? কেন খোলা জায়গায় পড়ে থাকে বর্জ্য? এই দায় কার? নাগরিকের? তারা তো ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। প্রতিনিধিরা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন?

আসুক সমাধান দোষারোপের অধ্যায় তোলা থাকুক, সাধারণ মানুষ পরিত্রাণ চায়। এখন ঢাকায় যে পরিবেশ বিরাজ করছে এটি যদি দ্রুত ভালোর দিকে উত্তরণ না হয় তাহলে এর চরম মূল্য দিতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড়আয়ু কমছে। মানুষ ঘনঘন নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বাঁচার উপায় বের করতে সবাইকে আরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু পদক্ষেপই নয়, বাস্তবায়নের বিষয়টিও দৃশ্যমান হতে হবে। কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না, সুফলও মিলতে হবে। সেই সঙ্গে সুফল হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :