যুগে যুগে মহামারি ও অপ্রতিরোধ্য করোনাভাইরাস

ইতিহাস থেকে আমরা জানি, প্রায় প্রতি শতাব্দীতে পৃথিবীতে কোন না কোন ভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। ভাইরাস গুলো প্রথমে কোন এলাকা বা জাতী আক্রান্ত হলেও পরে সারা পৃথিবী ব্যাপী মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমরা যদি ধারাবাহিক ভাবে দেখি তাহলে বুঝতে পারবে পৃথিবীর কত সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সময় মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেনে ।
১৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে রোমে স্মল পক্স মহামারিতে বহু মানুষ মারা যায়, রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে বাঁচেনি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসের মারা গিয়েছিলেন। ২৫০ খ্রিষ্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারী রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। এর পর, পঞ্চম শতাব্দীতে একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে এই মহামারি পরাক্রমশালী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যকেই শেষ করে দেয়। আবার ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাগে সালে রোমান সাম্রাজ্যেও পূর্ব অংশের সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওয়ান, রোমান সাম্রাজ্যকে আবার আগের মত প্রতাপশালী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন, বিউবনিক প্লেগ মহামারিতে তাঁর মৃত্যু সেই সম্ভাবনাকেও শেষ করে দেয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়, যা তৎকালীন জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ।
১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ‘দি ব্ল্যাক ডেথ’ বলে পরিচিত প্লেগ মহামারি পৃথিবীর জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যুর কারণ হয়। এই রোগ সম্ভবত এশিয়ায় উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্লেগের কথা বিভিন্ন সাহিত্যে উঠে এসেছে, এবং আমরা দেখেছি গোটা ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গোটা ব্রিটেনের সামন্ত ব্যবস্থা এই প্লেগের কারণে বিপর্যস্ত হয় এবং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শর্ত তৈরি হয়। গ্রিনল্যান্ডের প্রতাপশালী ভাইকিং জলদস্যুরা এই মহামারির ফলে সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে, ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে স্প্যানিশ বণিকেরা নিয়ে আসে ভয়ংকর স্মলপক্স, বিউবনিক প্লেগ ও হামের মত জীবাণু। ইউরোপিয়ানরা এইসব রোগ প্রতিরোধী হলেও ক্যারিবিয়ানের মানুষের শরীরে এই রোগের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিলো না। এর ফলে প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী এইসব রোগে মৃত্যুবরণ করে। উপনিবেশিক শক্তি গোটা আমেরিকা মহাদেশে শুধু তরবারি দিয়েই হত্যা করে নি, রোগ বালাই নিয়ে এসেও মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৫২০ সালে ইউরোপিয়ানদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স নিয়ে আসলে গোটা এজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আদিবাসীদের এই গণহারে মৃত্যু গোটা আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্য করার সুযোগ করে দেয়।
১৬৬৫ সালের দিকে ‘দি গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’-এ লন্ডনের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে সৈনিকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবর্ষ ছাড়াও স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় দেড়শ বছরের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কলেরায় মারা যায়। ১৮৫৫ সালের দিকে চীন, হংকং ও ভারতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্লেগে মারা ভুগে যায়।
বিংশ শতাব্দী তে যদি আমর খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাই পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে বিজ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে ততই মহামারি আকারে ধারণ করছে যদি তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা খুব দ্রুত আবিষ্কারও হয়েছে। জেনে নেওয়া যাক বিগত শতাব্দীর মহামারি গুলোর নাম ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ -
স্প্যানিশ ফ্লু: ১৯১৮ সাল
এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল ছিল চীনে। চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে তা কানাডা হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে এই ফ্লু উত্তর আমেরিকায় দেখা দেয় এবং পরে ইউরোপে ছড়ায়। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। সালফা ড্রাগস ও পেনিসিলিন তখনো আবিষ্কৃত না হওয়ায় স্প্যানিশ ফ্লু অত্যন্ত প্রাণঘাতী রূপে দেখা দিয়েছিল। স্পেনের মোট ৮০ লাখ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি।
এশিয়ান ফ্লু: ১৯৫৭ সাল
হংকং থেকে এই রোগ চীনে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তা ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্তরাজ্যে ব্যাপকভাবে ছড়ায়। এ কারণে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়ে। ১৯৫৮ সালের শুরুর দিকে এশিয়ান ফ্লু দ্বিতীয়বারের মতো মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় এশিয়ান ফ্লুতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। পরে ভ্যাকসিন দিয়ে ওই মহামারি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল।
এইচআইভি/এইডস: ১৯৮১ সাল
১৯৮১ সালে এইডস প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। রোগ শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত এইডসে বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: এএফপি১৯৮১ সালে এইডস প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা সম্ভব হয়। রোগ শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত এইডসে বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
করোনাভাইরাস ২০১৯
একবিংশ শতাব্দীতে এসে মহামারি আকার ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত চীনের সাথে সাথে ১২১টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় যাতে ৮,৯৬০ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে আরো ২,১৯,৩৮৪ জন রোগী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৮৫,৭৪৯ জনের বেশি লোক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাথে সাথে বাংলাদেশে আক্রান্ত ১৭,সুস্থ ৩, মৃত্যু ১ (২০.০৩.২০২০, সকাল ১১ ঘটিকা পর্যন্ত )।
তথ্যসূত্র:
১.উইকিপিডিয়া
২. Pandemics That Changed History, হিস্ট্রি ডট কম
৩. প্রথম আলো

মন্তব্য করুন