কারোনাদিনে স্বাধীনতা দিবস এবং কিছু কথা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২০, ০৯:৪২ | প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০২০, ০০:২২

পাখির মতো মানুষ আজ ঘরে ফিরে গেছে। বসে আছে। বাইরে করোনা আতঙ্ক। বের হওয়া যাবে না। ঘরে থাকতে বলা হয়েছে সবাইকে। নির্জন শহর। জনশূন্য পথঘাট। ব্যস্ত ঢাকার ফাঁকা রাস্তা দেখলে ভেতরটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। যদিও করোনায় পৃথিবীর অনেক দেশে লম্বা হয়েছে লাশের মিছিল।

মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনের অসামান্য এক মাস। একাত্তরের স্মৃতিকাতর স্মরণকাল। ৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে ডাক এসেছিল, ২৬ মার্চের সশস্ত্র সংগ্রামে তা পূর্ণতা পেয়েছে। কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই ২৫ মার্চ শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। রাতের অন্ধকারে। যখন মানুষ দিনের পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছিল শয্যায়। অপারেশন সার্চ লাইটের নামে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম এক অধ্যায় হিসেবে লেখা রয়েছে।

২৬ মার্চকে ঘিরে প্রতিবছরই নানা সরকারি-বেসরকারি আয়োজন থাকে। জাতীয় দিবস হিসেবে এই দিনটি সরকারি ছুটি। সবাই মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের দিনটিকে মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রমী এক স্বাধীনতা দিবস জাতির দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। এই দিনে ঘর থেকে বেরোতে মানা। একাত্তরে যেমন হানাদার বাহিনীর ভয়ে মানুষ যেভাবে লুকিয়ে ছিল, যে যেখানে পেড়েছে, আজ কভিড-১৯ ভাইরাসে ঘরের কোণে ঠাঁই নিয়েছে মানুষ। এটিও আমাদের জন্য বেদনার। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় অগত্যা মেনে নিতে হচ্ছে।

স্বাধীনতা দিবসের এবারের সব আয়োজন বাতিল করেছে সরকার। আগেই ঘোষণা এসেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১০ দিনের ছুটিতে ডুবে যাচ্ছে দেশ। অনেকে এই ছুটি কাটাতে গ্রামে ফিরেছেন। কেউ কেউ পথে বেরিয়েছিলেন, যানবাহনের অভাবে যেতে পারেননি। ফিরে এসেছেন ঘরে। যদিও করোনার কারণে ঘোষিত ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি যাওয়া মোটেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল ঢাকায় যার যার বাসায় থাকার জন্য। যাতে অনেক মানুষের জমায়েত তৈরি না হয়। লোক সমাগম হলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বড় আশঙ্কা থাকে। কিন্তু মানুষকে এই আশঙ্কার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন করা যায়নি। তারাও বিষয়টিকে নিয়েছেন মামুলিভাবে। যে কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে লঞ্চে, ট্রেনে বা বাসে চেপে বসতেও তাদের দ্বিধা হয়নি। এ বিষয়টি অনেকের মনেই বাড়তি আতঙ্কের তৈরি করেছে। অনেকে বলছেন, এতে ঢাকার বাইরেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে। যদিও আমরা কামনা করি, এই মহামারি যেন আমাদের ক্ষতি করতে না পারে।

০২.

স্বাধীনতা দিবস এলেই আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন করে জাগ্রত হয়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চর্চা বাড়ে। স্বাধীনতার সময়ের নানা বিষয় আলোচিত হয়। লেখা হয় বিশেষ প্রবন্ধ। কখনো মুক্তিযোদ্ধার কলমে স্মৃতিগদ্য। কখনো মূল্যায়ন। এই চর্চা আমাদের জাতীয় জীবনে অনিবার্য একটি বিষয়। এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই প্রজন্মের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চর্চা করছে। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে। তারা তাদের মতো করে স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাসকে জানতে চায়। এজন্য ইন্টারনেটসহ নানা বইপত্রের আশ্রয় নেয়। তবে বিপরীতে উল্টো চিত্রও আছে। একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি হয়তো স্পষ্ট হবে।

বছর দুই আগের ঘটনা। ধানমন্ডির সরোবর ঘেঁষে ছনের ছাউনি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। একটি টেবিল ঘিরে চারটি চেয়ার। তরুণদের আড্ডা। অদূরে বসে বসেছিলাম। আড়ি না পাতলেও আড্ডার বাতচিত আসছিল কানে। ওরা কথা বলছে স্বাধীনতা দিবস নিয়ে। ‘দোস্ত, বল তো স্বাধীনতা দিবস কবে?’ বন্ধুর এ প্রশ্নের জবাবে গোলগাল মুখে চশমা আঁটা ছেলেটি জবাব দিল, ‘কেন দোস্ত, ওই দিন কি তোর কোচিং বন্ধ থাকবে?’ ‘আরে না, ১৬ ডিসেম্বর টিউটোরিয়াল পরীক্ষা।’ প্রশ্ন, উত্তর আর প্রতি-উত্তর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখি আড্ডায় বসা তিন তরুণের বয়স বড়জোর বাইশ কি তেইশ। এরা এ প্রজন্মের তরুণ। এদের মতো অনেকেই আছে, যাদের মধ্যে জানার সীমবদ্ধতার তালিকায় আছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন জাতির গোড়াপত্তনের ইতিহাস। অথচ নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ফল করে পত্রিকার পাতায় ‘ভি চিহ্ন’ দেখানো ছবি ছাপা হচ্ছে এদের অনেকের।

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে জানাশোনা তলানিতে। এর দোষ পুরোপুরি তাদের, তা বলা যাবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রথম পাঠশালা পরিবারের দায়িত্বও কম নয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ঠিক। নতুন উদ্ভাবন কিংবা আবিষ্কারের সঙ্গে নতুনদের সখ্য বেশি হবে- এটাই স্বাভাবিক। কারণ, কিশোর-তরুণদের স্বচ্ছ মস্তিষ্ক খুব কম সময়ে অনেক জটিল বিষয় ধারণ করতে পারে। অনেক সূক্ষ্ম বিষয়ও তাদের ভাবনায় দ্রুতই ছড়িয়ে যায়। এভাবেই তাদের চিন্তাশক্তির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় ধীরে ধীরে। অন্তর্জালের বিস্তৃতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বান ডেকেছে। এই বানে পলি জমছে আমাদের চিন্তাশীল মস্তিষ্কের পরতে পরতে। এদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। যারা এ প্রজন্মের পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে পড়া তরুণদের মধ্যে একটি বড় অংশ এখনও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়ার কথা জানে না। জানার আগ্রহ নেই বলা যাবে না, তবে তা খুবই সামান্য। যে কারণে এখনও ধানমন্ডির মতো একটি অভিজাত এলাকায় বসে শুনতে হয়েছে, ‘স্বাধীনতা দিবস ১৬ ডিসেম্বর!’

০৩.

ভাসানী নভোথিয়েটারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি দুর্লভ ভাষণের ভিডিওচিত্র দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য কর, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ কর। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও দিতে হবে। উপায় নাই দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। একটু সময় নিয়ে কল্পনা করলে কারো পক্ষে তা বোঝা অসাধ্য হবে না। সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ আজ কোথায় উঠে এসেছে ভাবা যায়? আমরা তো এগিয়ে যাবই। এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র তো আমার জাতিসত্তার গভীরে রাখা। ওই দিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধুই তো বলেছিলেন, ‘আমি আমরা হার মানবো না। আমরা হার মানতে জানি না।’ যে জাতি হার মানতে জানে না, তাদের কি চাইলেও আটকে রাখা যাবে, স্লথ করা যাবে এগিয়ে যাওয়ার গতি? পিছিয়ে থাকতে শেখেনি বাঙালি। এই প্রজন্মের শিরায় তো পূর্বপুরুষের রক্ত বইছে। তবে তারা কেন পিছিয়ে রইবে?

০৪.

উন্নয়নের যে পথে বাংলাদেশ হাঁটছে, সেই পথ ভবিষ্যতেও পাড়ি দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মই নেতৃত্ব দেবে আগামীদিনের বাংলাদেশকে। তাই তাদের গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত আদর্শে। যে আদর্শের তাড়নায় তারা সৎ হবে। দেশপ্রেমে থাকবে অটল। প্রকৃত দেশপ্রেমের চেতনা শিরায় বইবে। এই দেশ নিয়ে গর্ব করবে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছে তরুণ প্রজন্ম। বেড়ে ওঠা এসব চারাগাছের দিকে এখন থেকে নজর না দিলে ভবিষ্যতের মহীরুহ শক্তপোক্ত ভিত গড়তে পারবে না। সামান্য দমকা হাওয়াতে দুমড়েমুচড়ে পড়বে।

লেখক: সাংবাদিক গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :