শিক্ষার্থীদের আনন্দ কমেছে, পড়াশোনা মাত্র ২ ঘণ্টা

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ জুন ২০২০, ২০:৩০ | প্রকাশিত : ২৬ জুন ২০২০, ১০:০৩
অনলাইনে যুক্ত হয়ে ক্লাস করছে একজন শিশু

নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পাঠদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে নানা পদক্ষেপের মধ্যেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় অনেক কমে এসেছে। আর প্রায় সব শিক্ষার্থীরই আনন্দ কমেছে। বেড়েছে মনোকষ্ট, ভয় ও দুশ্চিন্তা।

স্বাভাবিক সময়ে এই দুই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ১০ ঘণ্টা পড়াশোনায় ব্যয় করলেও এখন তা কমে মাত্র দুই ঘণ্টায় নেমেছে। অর্থাৎ তাদের পড়াশোনা ৮০ শতাংশ কম হচ্ছে। তবে পড়ায় না থাকলেও অন্তত ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পরিবারের কারণে আয়মূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাব ও অনলাইনে পাঠগ্রহণের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সারা দেশের ৪ হাজার ৬৭২টি পরিবারের ৫ হাজার ১৯৩ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই গবেষণাটি চালানো হয়।

চলতি বছরের ৫ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত এ গবেষণাটি করেন মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট অনিন্দিতা ভট্টাচার্য, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মনতাজিমা তাসনিম এবং রিসার্চ ইন্টার্ন ফারজিন মুমতাহেনা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৩ এপ্রিলের মধ্যে প্রথম সাময়িক, ৯ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে দ্বিতীয় সাময়িক এবং ২ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। আর ১৯ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পঞ্চমের সমাপনী পরীক্ষার সূচি রয়েছে।

কিন্তু করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিকের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এবারের এইসএসসি পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে গেছে।

টেলিভিশনে ক্লাস অনুসরণ কঠিন লাগছে

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার আগে গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে প্রতিদিন ৬২৫মিনিট পড়ালেখায় ব্যয় করলেও এখন তারা মাত্র ১২৪ মিনিট পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ালেখার সময় কমে এসেছে মাত্র ২ ঘণ্টায়। সেই হিসেবে ৮০% সময় কমেছে পড়াশোনার।

এছাড়াও টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি ফলে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ এই দুইটি অনুষ্ঠান দেখছে এবং ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। যারা টিভি ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে তারা আবার টেলিভিশনে ক্লাস অনুসরণ করাকে বেশ কঠিন বলে মনে করছে।

নিজে থেকে শিখছে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী

গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৫% শিক্ষার্থী নিজে থেকে শিখছে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব থাকার পরেও ৬% শিক্ষার্থী কোচিং এবং প্রাইভেট টিউটরের মাধ্যমে শিখছে বলেও দেখা গেছে।

তবে পড়াশোনার সময় তুলনামূলক কমে গেলেও বেড়েছে শিশুশ্রমের হার। গবেষণাটিতে দেখা গেছে─ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে যেখানে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ২ দুই ঘণ্টার বেশি আয়মূলক কাজে জড়িত ছিল এখন তার হার দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। আর গৃহস্থলীর কাজকর্ম এই হার ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা করোনার আগে ছিল মাত্র ১ শতাংশ।

শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অভিভাবকদের ভূমিকার বিভিন্ন বিষয়ও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। গ্রামের ২৪ ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশুনা সহযোগী হিসেবে মা এবং ১৪ ভাগ শিক্ষার্থী বাবাকে পাচ্ছে। যাদের বাবা-মা নিরক্ষর তাদের মধ্যে ১২ ভাগ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসগুলো দেখছে আর যাদের বাবা-মা এসএসসি কিংবা এর বেশি পড়াশোনা করেছে তাদের মধ্যে ২৪ ছেলেমেয়েরা সংসদ টেলিভিশনের ক্লাস করছে।

পড়ার চেয়ে কাজে বেশি সময়

গবেষণায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে পড়াশোনা ব্যতীত নানা ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে সময় পার করতে দেখা গেছে। সৃজনশীল কাজ, খেলা ও অবসরে সময় কাটায় ১১৪ মিনিট যা করোনার আগে ছিল মাত্র ৬৪ মিনিট। গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করে ৬৭ মিনিট যা আগে ছিল আধঘন্টা। ছোট ভাই বোনদের পড়াশোনার জন্য ১১মিনিট ব্যয় করে এবং আগে এ সময় ব্যয় করা হতো ১৩মিনিট।

ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ বেড়েছে। করোনার আগে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ২৮ মিনিট সময় ব্যয় করলেও এখন ৫৫ মিনিট সময় ব্যয় করা হয়। এছাড়াও ৩৮১ মিনিট সময় বা ৬ ঘন্টা অর্থাৎ ৫০ ভাগ সময় অজানা কারণে কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

কমেছে আনন্দ, বেড়েছে মানসিক চাপ

মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার বিষয়টিও উঠে এসেছে গবেষণায়। করোনার আগে আনন্দময় সময় কাটাতো ৮৭ ভাগ আর এখন ৭২ ভাগ, চিন্তামুক্ত থাকতো ৭৩ ভাগ শিক্ষার্থী আর এখন ৫৯ ভাগ, মনোকষ্টে রয়েছে ৩২ ভাগ শিক্ষার্থী যা আগে ছিল ১৪ ভাগ। ঘরবন্দী শিশুদের আগের তুলনায় ভয়ও বেড়েছে। করোনার আগে ১০ ভাগ শিক্ষার্থী ভয় থাকলেও এখন ৩৬ ভাগ শিক্ষার্থী ভয় থাকে।

গবেষণার এই তথ্যগুলো গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পাওয়া গেলেও শহরের বস্তি এলাকাও চিত্রটা একই রকম হবে বলে গবেষকরা মনে করছেন। বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিনের সঞ্চালনায় একটি ওয়েবিনারে এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।

ওয়েবিনারে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ গবেষণায় প্রাপ্ত ফল উপস্থাপন করেন। এসময় বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, ‘আমাদের দেশের মূল শক্তি হলো কম্যুনিটিভিত্তিক উদ্ভাবনী পদক্ষেপ। করোনায় এই মূল শক্তিটিকে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। সেটা হতে পারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে কিংবা, শিক্ষাখাতে ডিজিটাল ব্যবস্থার উদ্ভাবনে। আমাদের অবশ্যই হাতে হাত মিলিয়ে এব্যাপারে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারের শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় থাকা বাধাগুলোকে এভাবেই অপসারণ করা প্রয়োজন।

গবেষক নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশে শিশুদের পড়াশোনায় সময় ১০ ঘন্টা থেকে কমে ২ ঘন্টায় নেমে গেছে। গ্রামের শিশুরা এখন পরিবারের কাজের পিছনে দ্বিগুণ সময় ব্যয় করছে। শিক্ষামূলক কার্যক্রমে সময় না দিয়ে অ-শিক্ষামূলক কার্যক্রমে বেশি সময় দেওয়ায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পূরণ করা কষ্টসাধ্য।’

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের বিষয়টিও পরবর্তী গবেষণায় তুলে ধরার জন্য জানান ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।

(ঢাকাটাইমস/২৬জুন/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :