ভেষজ অ্যান্টিবায়োটিক সরিষার তেল

বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে সরিষার তেল প্রাচীনকাল থেকে মিশে আছে। ভেষজ ঔষধি গুণাগুণের জন্য আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে সরিষার তেল। সরিষা বীজ থেকে তৈরি হয় সরিষার তেল। সরিষা উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম ব্রাসিকা জানসি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়। সরিষার তেল গাঢ় হলুদ বর্ণের এবং বাদামের মত সামান্য কটু স্বাদ ও শক্তিশালী সুবাস যুক্ত তেল।
করোনাভাইরাস মহামারীতে চিকিৎসকরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপদেশ দিচ্ছেন। সম্প্রতি জার্মানির বিজ্ঞানীরা সরিষার তেলকে ভেষজ অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় শ্বাসনালি এবং মূত্রনালি ও ব্রঙ্কাইটিস ইনফেকশন সারাতে সরিষার তেল বিশেষ ভূমিকা রাখে।
গবেষকদের মতে, সরিষার তেলের উপাদানে রোগজীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। সরিষার তেলের উপাদান শরীর ক্ষুদ্রান্ত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করে এবং ফুসফুস ও বৃহদান্ত্রের প্রয়োজনীয় জীবাণুকে কোনোরকম ক্ষতি না করেই কিডনির মাধ্যমে তা নিষ্কাশিত হয়। কারণ সরিষার তেল বৃহদান্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও হজমে সহায়তা করে।
বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ এবং ই, আলফা ওমেগা থ্রি এবং আলফা ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়রন, ম্যাংগানিজ এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস হওয়ায় সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, রান্নায় এবং অ-ভোজ্য উদ্দেশ্যে সরিষার তেল ব্যবহার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করে। চিকিৎসকদের মতে, সরিষার তেলে ভরসা রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিয়মিত সরিষার তেলের ব্যবহার বিভিন্ন জটিল সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
ব্যাকটেরিয়া দূর করে
অ্যাজমা ও সাইনুসাইটিসের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে সরিষার তেল অত্যন্ত কার্যকরী, ঠান্ডা-কাশি নিরাময়েও চমৎকার কাজ করে সরিষার তেল, ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে, এতে অ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট নামক অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান থাকে বলে ছত্রাকের ইনফেকশন নিরাময়ে কাজ করে। জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশিতে আরাম পেতে হালকা গরম সরিষার তেলে কালোজিরে, রসুন মিশ্রণ বুকে-পিঠে মাখুন, উপকার পাবেন।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে যা অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই ক্যানসারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে সরিষার তেল। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যানসারর থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
আর্থ্রাইটিস রোগে উপকার করে
আর্থ্রাইটিস রোগ নিরাময়ের জন্য সরিষার তেল বেশ কার্যকর। সরিষার তেল আর আদা—এই দুটিতেই এমন উপাদান থাকে, যা প্রদাহজনিত উৎসেচকের ক্রিয়ার গতি কমিয়ে তোলে। ফলে ব্যথার থেকে আরাম পাওয়া যায়। জয়েন্টের ব্যথার হাত থেকে নিরাময় পেতে সরিষার তেলে পরিমাণমতো কর্পূর মেশান। তেল গরম করে ঠান্ডা হতে দিন। এবার সেই তেল দিয়ে মালিশ করুন। আরাম পাবেন।
হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়
বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হল করোনারি হার্ট ডিজিজ । আর রান্নার তেলের কারণে এই হার্টের রোগের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়ে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সরিষার তেল মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত যা কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে এবং করোনারি হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
কার্ডিওভাস্কুলার উপকারিতা
সরিষার তেল মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাটে সমৃদ্ধ বলে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। এর ফলে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমে।
উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচন তন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে সরিষার তেল। খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে ম্যাসাজ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্ম গ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
সরষের তেলে উপস্থিত স্বাস্থ্যকর ফ্যাট স্মৃতিশক্তি বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সঙ্গে মনোযোগ বৃদ্ধি এবং সার্বিকভাবে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার উন্নতিতেও সাহায্য করে।
প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন
সরিষার তেল খুব ঘন হয় এবং এতে উচ্চমাত্রার ভিটামিন ই থাকে সেহেতু এই তেল ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে ত্বককে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই স্কিন ক্যান্সার ও প্রতিরোধ করতে পারে। ভিটামিন ই বলিরেখা ও বয়সের ছাপ দূর করতে পারে। তাই সানস্ক্রিন লোশনের মতোই ব্যবহার করতে পারেন সরিষার তেল।
লোহিত রক্তকণিকা শক্তিশালী করে
প্লাজমা, কোষের লিপিডস এবং কোষের ঝিল্লির উপাদান হিসাবে বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনের জন্য আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় চর্বিগুলোর একটি প্রধান উৎস সরিষার তেল। এই তেল কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে এবং লোহিত রক্তকণিকার ঝিল্লি গঠনের উন্নতি করে।
কার্ডিওপ্রোটেক্টিভ প্রভাব
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সরিষার তেল খেলে অ্যারিথমিয়াস, হার্ট ফেইলিও এবং এনজাইনা হ্রাস পেয়েছে। কার্ডিওভাসকুলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের জন্য সরিষার তেল স্বাস্থ্যকর হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি ট্রাইগ্লিসারাইড, রক্তচাপ এবং প্রদাহ কমাতেও সহায়তা করে।
ঠোঁটের যত্নে
শুষ্ক ঠোঁটের যত্নে সরিষার তেল চমৎকার প্রতিকার হিসেবে কাজ করে যেখানে লিপ বাম বা চ্যাপ স্টিক অকার্যকর। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনার নাভির মধ্যে এক বা দুই ফোঁটা সরিষার তেল দিন। তাহলে আর কখনোই আপনার ঠোঁট শুকাবে না বা ফাটবে না।
ত্বকের তামাটে ভাব দূর করে
সরিষার তেল ত্বকের তামাটে ভাব ও দাগ দূর করে ত্বককে প্রাকৃতিক ভাবে উজ্জ্বল করতে পারে। এজন্য বেসন, দই, সরিষার তেল ও কয়েকফোঁটা লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে মিশ্রণটি আপনার ত্বকে লাগান। ১০-১৫ মিনিট পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফল পেতে সপ্তাহে ৩ বার ব্যবহার করুন।
চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
সরিষার তেল চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, অকালে চুল সাদা হওয়া রোধ করে ও চুল পড়া কমায়। সরিষার তেল ভিটামিন ও খনিজে পরিপূর্ণ থাকে। বিশেষ করে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন থাকে এতে। বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন এ তে রূপান্তরিত হয়ে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি এসিড ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। প্রতিরাতে চুলে সরিষার তেল মালিশ করে লাগালে চুল কালো হয়।
ক্ষুধা বৃদ্ধি করে
ক্ষুধার উপর সুস্বাস্থ্য বহুলাংশে নির্ভর করে। পাকস্থলীর পাচক রস উদ্দীপিত করার মাধ্যমে ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে সরিষার তেল। যাদের ক্ষুধার সমস্যা আছে তারা রান্নায় সরিষায় তেল ব্যবহার করতে পারেন।
পোকামাকড় প্রতিরোধক
সরিষার তেল প্রয়োগের সুবিধাগুলো কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক হিসাবেও অর্জন করে। এই তেল ত্বকে লাগালে মশা বা অন্যান্য পোকামাকড় দূরে থাকে। এছাড়াও, এই শক্তিশালী তেলটি এসিড অ্যালবোপিকটাস মশার প্রভাবকেও নিরপেক্ষ করে।
(ঢাকাটাইমস/৩ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)

মন্তব্য করুন