যে নিয়মে আম খেলে শরীরের ওজন ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে

আমকে ফলের রাজা বলা হয় কারণ এতে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আম বাংলাদেশের জাতীয় গাছ। ভারত, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইনের জাতীয় ফল। আম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা। কয়েক হাজার বছর ধরে আম চাষাবাদ হয়ে আসছে ভারতীয় উপমহাদেশে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উষ্ণ প্রধান জলবায়ুর অঞ্চলগুলোতে আমের চাষাবাদ হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি আম উৎপাদন হয় শুধুমাত্র ভারতেই। এর পর অন্যান্য যেসব দেশ আম উৎপাদন করে তার মধ্যে আছে চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা প্রভৃতি। বাংলাদেশের রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় ভালো মানের এবং রপ্তানিযোগ্য আম চাষ হয়ে থাকে।
আমের স্বাদের যে ভিন্নতা সেটি মূলত এর জাতের ওপর নির্ভরশীল। ১৫০০টিরও বেশি জাত ও ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি রয়েছে আমের এবং সবগুলো জাতই একে অপরের থেকে আলাদা। টক আর অতি মিষ্টি এবং এর মাঝখানে যত রকম স্বাদ রয়েছে সবই আমাদের আমের জাতগুলোতে রয়েছে।
কাঁচা বা পাকা দুই ধরনের আমই শরীরের জন্য ভালো। যেসব আম পাকা না সেগুলো টক কারণ এতে অ্যাসিড বেশি এবং চিনি কম থাকে। অন্যদিকে, পাকা আম মিষ্টি হয় কারণ এতে কম অ্যাসিড এবং বেশি চিনি থাকে।
আমে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্রুক্টোজ, গ্লুকোজ এবং খাদ্য আঁশ। এই খাদ্য আঁশ এবং এন্টিওক্সিডেন্ট রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই সঙ্গে ব্লাড গ্লুকোজকে বাড়তে দেয় না। আমে বিদ্যমান ভিটামিন এ এবং সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। এছাড়া ভিটামিন কে, বি ভিটামিন্স, ফোলেট, ভিটামিন ই-ও আমাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে।
এই ফলের ক্যালোরির পরিমাণও নেহাত কম নয়। ১০০ গ্রাম ফলে মেলে ৬০-৬৫ ক্যালোরি। একটি আমের ওজন যদি ২৫০ গ্রামও হয়, তা হলে ক্যালোরির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০।
সে কারণেই ওজন ঝরানোর চেষ্টা করছেন যারা, তারাও এ ফল সরিয়েই রাখেন। কিন্তু এই যে প্রচলিত ধারণা, ডায়াবেটিস হলে আম বাদ, ওজন বশে রাখতে হলেও রসালো ফলটি উপযোগী নয়, তা কি আদৌ ঠিক?
এখনকার পুষ্টিবিদেরা কিন্তু সে কথা বলছেন না। তাদের মতে, ওজন কমা বা বৃদ্ধির সঙ্গে দৈনন্দিন ক্যালোরি গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কী খাচ্ছেন, কতটা খাচ্ছেন, কী ভাবে খাচ্ছেন এই সব বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধু আম খেলে ওজন বাড়বে তা যেমন ঠিক নয়, তেমনই ওজন বশে রাখতে হলে আম খাওয়া যাবে না, সে তথ্যও সঠিক নয়।
তবে পুষ্টিবিদদের মতে, আম খাওয়ারও নিয়ম আছে। ভাত, রুটি, ভরপেট খেয়ে আম খেলে এক ধাক্কায় শরীরে অনেক ক্যালোরি ঢুকবে। এ ক্ষেত্রে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। সে কারণে অনন্যা জানাচ্ছেন, সন্ধ্যা বা সকালে স্ন্যাক্স হিসেবে আম খাওয়া যেতে পারে। জলখাবার এবং দুপুরের খাওয়ার মাঝের সময় কিংবা সন্ধ্যায় অন্য কিছু না খেয়ে একটা আম খাওয়া চলতে পারে।
পুষ্টিবিদদের বক্তব্য ওজন বশে রাখতে হলে দৈনন্দিন কাজের জন্য যতটা শক্তি খরচ হয়, ততটাই খেতে হবে। আবার যিনি ওজন কমাতে চাইছেন, তার শরীরে ক্যালোরির ঘাটতি জরুরি। অর্থাৎ, হাঁটাচলা, বসা, ঘুম, বিপাকক্রিয়ায় কারও ১৮০০ কিলোক্যালোরি খরচ হলে তাঁকে তার চেয়ে একটু কম খেতে হবে। কিম্বা যদি তিনি সেই পরিমাণ খাবার খানও, তা হলে তাঁকে শরীরচর্চা করে অতিরিক্ত ক্যালোরি ঝরিয়ে ফেলতে হবে।
তাই মৌসুমি ফল হিসাবে আম খাওয়ায় ডায়াবেটিক বা ওজন যারা কমাতে চাইছেন, তাদের কারও কোনও অসুবিধা নেই। তবে দিনে তিন-চারটি আম খেলে বা অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেয়ে আম খেলে সমস্যা হতে পারে।
পুষ্টিবিদদের মতে, ফল হিসাবে আম অত্যন্ত উপকারী। এতে থাকা ভিটামিন এ এবং সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখে। ফলটিতে থাকা ফাইবার এবং উৎসেচক খাবার হজমে সহায়ক। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ত্বকের জন্য ভাল। এতে থাকা প্রাকৃতিক শর্করা দ্রুত শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। তাই আম বাদ দেওয়া মানে, এতগুলি উপকার বাদ পড়া।
আমে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকার কারণে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণসহ হার্ট ভালো রাখে। খাবার পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম, পানি, খাদ্য আঁশ ও অন্যান্য উপাদান থাকার কারণে এটি আমাদের পরিপাকতন্ত্রের জন্যও উপকারি।
পুষ্টিবিদদের মতে, আম এমনই একটি ফল যাতে মিষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি । তবে মিষ্টির পরিমাণ বেশি থাকলেও আম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত হয় । যদিও আমে শর্করা এবং সুগার রয়েছে, তাই বলে একেবারে আম খাওয়া যাবে না এমনটি নয়। একটু সতর্কতার সঙ্গে ডায়বেটিক রোগী তাদের খাদ্য তালিকায় আম রাখতে পারবেন।
একটি খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স র্যাঙ্ক বলতে ০-১০০ স্কেলে পরিমাপ করা হয়, যেখানে ৫৫ পর্যন্ত খাবারে চিনির পরিমাণ কম বলে বিবেচিত হয়। আমের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স র্যাঙ্ক ৫১, এমনকি সুগারের রোগীরাও এটি সীমিত পরিমাণে খেতে পারেন। পুষ্টিবিদদের মতে, যে নিয়ম মানলে ডায়াবেটিস রোগীরাও আম খেলেও রক্তে শর্করা বাড়বে না উল্লেখযোগ্য হারে৷
আম খাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিমাণ। আমের পরিমাণের ওপর আপনার ব্লাড গ্লুকোজ অনেকটা নির্ভর করবে। ছোট টুকরো করে কাটা ১/২ কাপ পরিমাণ আম খাওয়া যেতে পারে। একবারে অনেক বেশি পরিমাণ খাওয়া যাবে না। দৈনিক বরাদ্দকৃত শর্করার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিমাণ ঠিক রাখতে হবে। ব্লাড গ্লুকোজ সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ১/২ কাপ পরিমাণ আম থেকে ১০-১৩ গ্রাম এর মত শর্করা পাওয়া যাবে। তাই একবারে অতিরিক্ত পরিমাণ না খেয়ে অল্প অল্প করে খাওয়া নিরাপদ। ২-৩ স্লাইস আম অন্তত ৩ দিনের হিসেব করে খাওয়া ভালো।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, আমের টুকরো খান৷ রস করে কখনও খাবেন না৷ রস বার করলে আমের ফাইবারসুলভ সব গুণ নষ্ট হয়ে যায়৷
আমের সঙ্গে কিছু দানা বা বীজ বা বাদামজাতীয় জিনিস খেতে হবে ডায়াবেটিস রোগীদের৷ তাহলে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স দ্রুত বাড়বে না৷
লাঞ্চ, ডিনারের আগে বা সঙ্গে বা ঠিক পরে আম খাবেন না ডায়াবেটিকরা৷ এতে রক্তে শর্করার পরিমাণ এক লাফে বেড়ে যাবে অনেকটাই৷ স্বল্প পরিমাণে আম খেতে হবে ডায়াবেটিকদের৷ একবারে দু’ টুকরোর বেশি আম কোনওমতেই খাবেন না৷ সপ্তাহে এক বা দু’দিন আম খান৷ রোজ কখনওই আম খাবেন না৷
পুষ্টিবিদদের মতে, আম খেলে ডায়াবেটিস রোগীরা প্রাতরাশের সঙ্গে খান৷ তার পর দিনের সময় যত এগোবে, আম আর খাওয়া চলবে না ডায়াবেটিস রোগীদের৷ গবেষণায় দেখা গেছে, খাবার গ্রহণের সময় ঠিক রেখে, সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খেলে এবং শর্করার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আম খেলে তা ডায়বেটিক রোগীর জন্য অনেক ক্ষেত্রেই উপকারি। শরীরে কম পানি থাকা মানেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকা। তাই পর্যাপ্ত পানি পান জরুরি।
(ঢাকাটাইমস/২২ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন