৭ই মার্চের ভাষণের আগে-পরে

জাতীয় জাগরণ ও জাতিসত্তা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভাষণের ভূমিকা-প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ বলে পরিগণিত হয়েছে। একটি ভাষণই একটি জাতির ভাগ্য বদলে দিয়েছে এমন নজির ইতিহাসে বিরল নয়। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে, স্বাধীনতার প্রশ্নে, দেশ গঠনের প্রশ্নেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রীয় কর্তাদের ভাষণের প্রভাব অপরিসীম বলে মূল্যায়িত হয়েছে।
রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পর স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দাসপ্রথা উচ্ছেদার্থে শহীদদের স্মরণে গেটিসবার্গে মাত্র ২৭২ শব্দের তিন মিনিটের ভাষণ দিয়েছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। ভাষণটি আজও বিশ্বের অন্যতম ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ভাষণটি আমেরিকার জনগণের উপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল।
তেমনি এক ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণটির স্থায়িত্ব ছিল ১৮ মিনিট। এই ঐতিহাসিক ভাষণটি ইতিমধ্যে ডজনের বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি এতদিন বাঙালি জাতির গৌরবের ঐতিহ্য হিসেবে সমাদৃত হলেও এখন তা বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বীকৃত ও সমাদৃত। বিশ্বখ্যাত এ ভাষণটিকে ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) কর্তৃক বিশ্বের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ স্বীকৃতির মাধ্যমে ভাষণটি এখন বিশ্বের ঐতিহ্য ও গৌরবময় সম্পদে পরিণত হয়েছে।
ভাষণের পরিপ্রেক্ষিত: বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের গদি ত্যাগের পর ক্ষমতাসীন হন জেনারেল ইয়াহিয়া খান, তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সে মোতাবেক ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১৬২টি, পাঞ্জাব প্রদেশের জন্য ৮২টি, সিন্ধু প্রদেশের জন্য ২৭টি, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জন্য ১৮টি এবং বেলুচিস্তান প্রদেশের জন্য ৪টি আসন নির্ধারণ করা হয়। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিতব্য সদস্যদের মোট আসনসংখ্যা ছিল ২৯৩টি, এর সাথে যুক্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতি অঞ্চলের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসন এবং পরোক্ষভাবে নির্বাচিতব্য মহিলাদের জন্য ১৩টি আসন। এক্ষেত্রে নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে আওয়ামী লিগ ৭টি মহিলা আসন পেয়ে জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনের অধিকারী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
এই নির্বাচনে এককভাবে তো নয়ই, সারা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবেও আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার মতো অবস্থানে ছিল না। বাঙালিদের এ বিজয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা হতবাক হয়ে যায়। এ বিজয় ছিল তাদের অনুমিত প্রাক্কলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। পাক গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল. ‘মুজিব ৩৭% আসন জিতবেন, ভাসানীও প্রায় কাছাকাছি থাকবেন আর বাকি ২৫ ভাগ অন্যান্য ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।’ মামুন, মুনতাসীর। পাকিস্তানি জেনারেলদের মন। ঢাকা। সময় প্রকাশন। ২০১১ (তৃতীয় মুদ্রণ)। পৃষ্ঠা: ২৮৬।
কিন্তু বাস্তবে তেমনটা না হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের অনুকূলে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার নানা ফন্দি ফিকির। এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেকোনো দিন আর মসনদের দেখা পাবে না, সে বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তোলে। এছাড়া উচ্চাভিলাষী জুলফিকার আলী ভুট্টোও যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়বে সেই বাস্তবতাও তার কাছে এবং জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়ে পড়ে।
সে অবস্থায় শুরু হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান নিয়ে টালবাহানা। প্রতিশ্রুত ১ মার্চের অধিবেশনটি কোনো কারণ ব্যতিরেকে বাতিল করা হয়। গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নেও সৃষ্টি করা হয় ধূম্রজাল। এহেন সংশয়ের সরোবরে নিপতিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় দাঁড়াতে হয় জনতার সম্মুখে। যে জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সংগ্রামী জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন এতদিন, সেই জনতাকে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করণার্থে এবং পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রদানের প্রত্যয়ে উপস্থিত হন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে। সেদিন মার্চের ৭ তারিখে প্রদান করেন তাঁর কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ।
১৯৭১ সাল, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: মুখ্যত সেদিনই তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার আহ্বান জানিয়ে রাখেন। শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকতে বলেন। এবারের সংগ্রামকে মুক্তির সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে ঘোষণা করেন। তিনি যদি নাও থাকেন তাও সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে রাখেন। সে ভাষণে তিনি পাক শাসকদের দুরভিসন্ধির ইতিবৃত্ত তুলে ধরে বজ্র কণ্ঠে বলেন:
‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।...
‘...আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলি¬তে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি¬র মধ্যে আলোচনা করবÑএমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।...
‘ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেওয়ার পর এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো।...
‘...কি পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
‘টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ডটেবিল কনফারেন্স হবে।
‘আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
‘ভাইয়ের আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, যে ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি¬ কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন ‘মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলি¬তে বসতে আমরা পারি না।
‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমার এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।... রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুই, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’
‘তোমরা (নিরাপত্তা বাহিনী) আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার লোকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।...
‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!’
পাকিস্তানিরা যে বাঙালিদের কাছে কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, ইতিমধ্যে তা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা ১৯৫৪-৫৭ সালের মতো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যে বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনতাইয়ের পাঁয়তারা করছিল, সেটিও আর অপ্রকাশ্য ছিল না। নির্বাচনের পূর্বে ইয়াহিয়া যে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করেছিল, সে অর্ডারের ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদে শর্তের বেড়াজাল দেওয়া হয়।
এ সমস্ত শর্তের বেড়াজাল সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরল বিশ্বাসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আইন পরিষদে বসে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়নে সচেষ্ট ছিলেন। এ পর্যায়ে নতুন করে শাসকবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কোনো আবশ্যকতা না থাকলেও তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে রাহুমুক্ত করার জন্য তাদের সঙ্গে খোলা মনে আলোচনায় বসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ইচ্ছে করলে উপরোক্ত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের ক্ষমতাবলে আইন পরিষদে পাসকৃত পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী যেকোনো বিলের উপর তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন, এ জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। কিন্তু পশ্চিমা শাসকচক্রের প্রতিভূ অতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতেও সাহসি হননি। তিনি অধিবেশনের আগেই একটি ফয়সালা করতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন এবং পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধকরণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।
ইয়াহিয়ার এ সমস্ত দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্যই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৭ মার্চে যেমন স্বাধীনতার আহ্বান জানানো হয়, তেমনি আলোচনার দরোজাও উন্মুক্ত রাখা হয়। একই সাথে পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট যাতে তার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের ক্ষমতাবলে কোনো বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
এ ধরনের শর্তারোপের ফলে পাকিস্তানি কুচক্রি মহলের ষড়যন্ত্রের দ্বার রুদ্ধ করা হয় এবং সঙ্গতকারণেই তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। ফলে পরবর্তী সময়ের আলোচনাও আর আলোর মুখ দেখেনি বা পাকিস্তানিরা সমস্যা সমাধানের ইতিবাচক পথে হাঁটেনি।
আর্মি আক্রমণের প্রস্তুতি: সেদিন বঙ্গবন্ধু যেন স্বাধীনতা ঘোষণা না করেন, সে বিষয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কর্মাধ্যক্ষ কর্তৃক আগাম জানিয়ে রাখা হলেও সে ভাষণের মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বাধীনতারই আহ্বান জানিয়ে রাখা হয়। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে পরিস্থিতি কি হতো, তা সামরিক জান্তাদের কথার সূত্রেই সহজে অনুমেয়। তারা নিঃসন্দেহে সেদিন আর একটি জালিওয়ানাবাগের নজির সৃষ্টি করত। সে প্রস্তুতিই তারা পুরো মাত্রায় নিয়ে রেখেছিল।
এ বিষয়ে জেনারেল (অব.) খাদিম রাজা লিখেছেন: আমি এবার একটা শক্ত সতর্কবাণী দিলাম তাদের। আমি গুপ্তচর দুজনকে বললাম শেখ মুজিবকে জানাতে যে, তার ভাষণের সময় আমি আগ্নেয়াস্ত্র ও ট্যাঙ্ক বহরসহ আমার বাহিনী নিয়ে যেকোনো সময় সামনে এগোনোর জন্য ক্যান্টনমেন্টে সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় থাকবো। শেখ মুজিবের ভাষণ রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি শোনার ব্যবস্থাও আমি করে রাখবো। যদি শেখ মুজিব দেশের অখণ্ডতার উপর কোনো আঘাত হানেন বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসেন, আমি আমার অধীনে ন্যস্ত সকল শক্তি নিয়ে সাথে সাথে আমার দায়িত্ব পালনে নেমে পড়বো কোনো ইতস্তত না করে। মিটিং ভঙ্গ করার জন্য আমি আমার বাহিনীকে সাথে সাথে মার্চ করিয়ে দেবো সেদিকে এবং যদি দরকার হয় ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে।...
‘বেশির ভাগ লোকই বিশ্বাস করছিল যে, ৭ মার্চের ভাষণটিকে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণার কাজে লাগাবেন। ঐ রকম পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি ও রকম কোনো ঘোষণা না দিয়ে বিপদ এড়ানো ও ঢাকার রাস্তায় বাঙালির রক্তপাতের সম্ভাবনা বাতিল করার জন্য কৃতিত্ব পাওয়ার অধিকারী।’ রাজা, মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন। এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি। অনুবাদ: শাহরীয়ার শরীফ। ২০১৩। ঢাকা। দি স্কাই পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা: ৬০।
খাদিম রাজাদের এ ধরনের হুমকির কারণে যে বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করেননি, এমনটি ভাবারও কোনো কারণ নেই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আগাগোড়া একজন প্রাজ্ঞ পলিটিশিয়ান। তিনি গণতান্ত্রিকতার পথে থেকেই অভীষ্টে পৌঁছতে চেয়েছিলেন, সেভাবেই তিনি এগুচ্ছিলেন, বাংলাকে কোনো বায়াফ্রা করার ঝুঁকি তিনি সঙ্গতকারণেই নিতে চাননি। এছাড়াও তিনি ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নেতা, সংখ্যাগরিষ্ঠরা কখনো সংখ্যালঘিষ্ঠের কাছে আলাদা হবার আবদার করতে পারে না এটিও তাঁর বিবেচনায় ছিল। যে কারণে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তিনি সেদিন তাঁর বক্তব্য পেশ করেছিলেন, সে বক্তব্যে যেমন স্বাধীনতার আহ্বান ছিল তেমনি অবারিত রাখা হয়েছিল আলোচনার দরোজা। অধিকন্তু পুরো সিভিল প্রশাসনের উপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা জানান দেয়া হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর জীবনাশঙ্কা: এছাড়া ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানিরা যেকোনো মুহূর্তে তাঁকে আটক বা হত্যা করতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কিত ছিলেন। যে কারণে তিনি ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘...আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
এ প্রসঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে বঙ্গবন্ধু যে প্রতিক্রিয়া বা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, সে সম্পর্কে আলোকপাতকালে জনাব ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেনÑ “৭ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু, হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল, শেখ শহীদ, শাশুড়ি ও আমাকে নিয়ে খাওয়ার সময় গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে।’ সেদিন থেকে এ নিয়ম আমরা ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত পালন করেছি।” ওয়াজেদ মিয়া, এম এ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ। ঢাকা। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। ১৯৯৭ (তৃতীয় মুদ্রণ), পৃষ্ঠা: ৭১।
সাত মার্চ-ফারল্যান্ড: বাঙালিদের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমেরিকাও ছিল উদ্বিগ্ন। কৌশলগত কারণে তাদের কাছে পাকিস্তানের বিভাজন কখনোই কাম্য ছিল না। তাদের এ বিরোধিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালের পুরোটা সময় বহাল ছিল। বঙ্গবন্ধু যেন সাতই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা না দেন, সে ব্যাপারে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন উৎকণ্ঠিত ও তৎপর। সেদিনÑ৭ মার্চ সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মি. ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। ফারল্যান্ড শেখ মুজিবের কাছে আমেরিকার নীতিমালা পরিষ্কার করে তুলে ধরে বলেন, ‘একতরফাভাবে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘোষণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাবে না এবং এজন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের আশায় যেন তাকিয়ে না থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু। একাত্তরে বন্দী মুজিব। ঢাকা। সূচীপত্র। ২০১২। পৃষ্ঠা-১১।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও ৭ মার্চের ভাষণের ব্যাপারে ছিলেন বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত। তিনি এ বিষয়েÑটেলিফোনে মুজিবের সঙ্গে ৬ মার্চ রাতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন এবং তাঁকে রাজি করানোর চেষ্টা করে বলেন, ‘এমন পদক্ষেপ যেন তিনি না নেন-যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ এরপর তিনি মুজিবের উদ্দেশে টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে এই বার্তাটি ঢাকার সামরিক আইন সদর দপ্তরে পৌঁছে। বার্তায় লেখা ছিল: ‘অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাক্সক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি করবে।’ একজন ব্রিগেডিয়ার নিজে ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে এলেন।
শেখ মুজিব ছিলেন অত্যন্ত কৌশলী ও বিজ্ঞনেতা। স্থির করলেন তাঁর লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন না।’ সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু। একাত্তরে বন্দী মুজিব। ঢাকা। সূচীপত্র। ২০১২। পৃষ্ঠ: ১১।
লেখক: সাহিত্যিক ও গবেষক।

মন্তব্য করুন