যে গুজবে মৃত্যু হয়েছিল ৬৭ জনের

মনে আছে নয় বছর আগের সেই গুজবের কথা? পাঁচ দিনে কেড়ে নিয়েছিল ৬৭ জনের প্রাণ। গুজবটি ছড়ানো হয়েছিল ‘বাশের কেল্লা’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে। এটিই দেশে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গুজবকেন্দ্রিক মৃত্যুর সবচেয়ে বড় ঘটনা।
এখনো সেই সহিংসতা, সেই বিভীষিকাময় তাণ্ডবের কথা মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন বগুড়ার শাহজাহানপুরের মইনুদ্দিন (৪৮)। তিনি ঢাকায় রিকশা চালান। বুধবার সকালে রাজধানীর রামপুরায় একটি রিকশার গ্যারেজে তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকাটাইমসের।
মইনুদ্দিন জানান, তখনো তিনি ঢাকায় রিকশা চালাতেন। ছোট মেয়ে ৯ বছরের জেসমিনের অসুস্থতার খবর পেয়ে বাড়িতে যান। ভোররাতে হঠাৎ মসজিদের মাইকে কিছু একটা বলে সবাইকে ঘরের বার হতে আহ্বান করা হয়। ভালোভাবে শুনতে না পেরে বাড়ির সামনে সড়কে নামেন মইনুদ্দিন। দেখেন, লাঠিসোটা হাতে অসংখ্য মানুষ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় এগিয়ে যাচ্ছে।
ঘটনা বোঝার জন্য মইনুদ্দিনও পিছু পিছু যান। তার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়। সেখানে তাণ্ডব শুরু করে ওই লোকগুলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ আসে। শুরু হয় গোলাগুলি।
ভয়ে থরথর মইনুদ্দিন দৌড়ে ফিরলেন নিজ বাড়ি। তখনো জানেন না প্রকৃত ঘটনা। পরে জানতে পারেন, ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে’ গুজবের কথা।
মইনুদ্দিন বলছিলেন ২০১৩ সালের ৩ মার্চ সেই বিভীষিকাময় ভোররাতের কথা। এর দুই দিন আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত।
এরপর চাঁদের ছবির সঙ্গে সাঈদীর ছবি মিলিয়ে সুপার এডিট করে ‘বাঁশের কেল্লা’ ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়। শুরু হয় সহিংসতা। ওই দিনই সারা দেশে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়। পরদিন শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত হয় ৩ জন ও শনিবার ৬ জন।পরদিন রবিবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জামায়াত। এর আগের রাতে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে, ফোন দিয়ে সাঈদীর মুখ চাঁদে দেখা গেছে বলে প্রচার করা হয়। গভীর রাতে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে বলা হয়, ‘চাঁদের গায়ে সাঈদীর মুখ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, তিনি ইমানদার লোক। তাকে বাঁচানো সবার ইমানি দায়িত্ব।’
গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ভোররাতে চাঁদ দেখতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। কেউ কেউ ঘরের ছাদে উঠে চাঁদ দেখা শুরু করে। মোবাইল ফোনগুলো সচল হয়ে ওঠে। একে-অপরকে বলেন চাঁদে সাঈদীকে দেখতে।
সেই রাতে মানুষের অভাবিত আচরণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তোলা হয়। চাঁদ ও সাঈদীকে নিয়ে গুজব তাদের মধ্যে তৈরি করে এক ধরনের হেলুসিনেশন।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চক্রটি শুরু করে ভয়ংকর তাণ্ডব। চলে গানপাউডার ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ, বোমা-ককটেল বিস্ফোরণ, লুটপাট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ। হামলা চালানো হয় থানাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে। সবচেয়ে বিভীষিকাময় অবস্থা সৃষ্টি হয় বগুড়ায়। সেখানে পাঁচটি থানা ও ছয়টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলা করা হয়। কয়েকটি ফাঁড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আব্দুল মান্নানের চকলোকমানের বাসভবন, আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের কালিতলা বাসভবন পুড়িয়ে দেয় উন্মত্ত মানুষগুলো।
প্রাণ নিয়ে পালান পুলিশ সদস্যরা। নন্দিগ্রামে উপজেলা পরিষদ ভবনের ১৬টি অফিস, থানা ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ওই দিন সারা দেশে নিহত হয় ২১ জন। এর মধ্যে বগুড়া জেলায় ১৮ জন। সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে ৬৭ জন মারা যান ওই গুজব থেকে সৃষ্ট তাণ্ডবে।
সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় ১০৪টি মামলা হয়। এসব মামলার কোনো কোনোটির বিচারকাজ শুরু হয়েছে। তবে এখনো কোনো মামলার রায় হয়নি।
বগুড়ার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল মতিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দাখিলের পর আদালত অভিযোগ গঠন করেছে। দু-একটি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও শুরু হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/আরআর/মোআ)

মন্তব্য করুন