রাত জেগে কাজ করলে কঠিন রোগের ঝুঁকি বাড়ে, সুস্থ থাকার উপায়

আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়তই আমরা অবিরাম গতিতে ছুটে চলছি। পাশাপাশি আধুনিক যুগে ছোট-বড় সবাই ডিজিটাল টেকনোলজিতে এতটাই বেশী আসক্ত যে সবকিছু ভুলে শুধু ভার্চুয়াল জগৎ নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকি। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন কঠিনতম হয়ে উঠেছে। বদলে যাচ্ছে কাজের সময়। কর্মব্যস্ত জীবনে প্রায়ই রাত জাগতে হয়। কাউকে আবার নাইট ডিউটি করতে হয় প্রায়ই। কখনও বা পরিস্থিতির কারণে রাত জাগতে বাধ্য হন অনেকেই। কেউ বা পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বা আড্ডাতেও রাত জাগেন।
আবার অনেক সংস্থাকেই বাইরের দেশের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করতে হয়। ফলে আমাদের যখন গভীর রাত, তাদের তখন দিন। অনেকেই আছেন রাত জেগে কাজ করতে ভালোবাসেন। তবে এর নানা ক্ষতিকর প্রভাবও কিন্তু রয়েছে। কারণ রাত জাগলে ঘুম নষ্ট হয়। সেই যতই বেলা পর্যন্ত ঘুমনো হোক না কেন। এছাড়াও মেজাজ গরম, কাজে মন না লাগা এসব থাকেই। আর এর ফলে সকালে উঠে শরীর চর্চার জন্য কোনও উৎসাহ থাকে না। সারা রাত জেগে একটানা কাজ করে যাওয়া সহজ নয়। তবে দীর্ঘ দিন করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। কিন্তু শরীরের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
সারা জীবন রাত জেগে কাজ করার কী ফল হতে পারে, সেটা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে বইকি। তবে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়-এর গবেষণা জানাচ্ছে, পর পর তিন দিন ‘নাইট শিফ্ট’-এ কাজ করলে ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ক্যানসারের মতো সমস্যা শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
অফিসে নাইট শিফ্টে অনেকেই কাজ করেন। সারা রাত জেগে একটানা কাজ করে যাওয়া সহজ নয়। তবে দীর্ঘ দিন করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়। কিন্তু শরীরের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়। থাকতে ঘুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘুমের ঘাটতি হওয়ার ফলে শরীরও দুর্বল হয়ে প়ড়ে।
পুষ্টিবিদেরা জানাচ্ছেন, রাত জেগে কাজ করার কারণে নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। হজমের গোলমাল তার মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও হরমোনজনিত সমস্যাও দেখা দিতে শুরু করে। গ্যাস-অম্বল তো বটেই, রাতভর কাজ করার ফলে ঘন ঘন মেজাজ বিগড়ে যাওয়া একটা বড় সমস্যা। বহু ক্ষেত্রে অনেক কঠিন অসুখের শুরুও হয় এই রাত জেগে কাজ করার ফলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টেই একথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে দিনের পর দিন রাত জাগলে শরীরের অন্দরে ক্ষয় এত বেড়ে যায় যে সেই ফাঁক গলে ক্যান্সার সেল দেহের অন্দরে বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়ে যায়।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। তাই এবার থেকে বেশি টাকা ইনকামের লোভে নাইট শিফট করার আগে একবার ভাববেন প্লিজ!
গবেষণায় দেখা গেছে রাত জেগে কাজ করলে কর্টিজল হরমোনের মতো স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ মারাত্মক বেড়ে যায়। ফলে সারা রাত কাজ করার ক্ষমতা জন্মালেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কমে যায়। ফলে নানাবিধ রোগ ঘাড়ে চেপে বসতে সময়ই লাগে না। প্রসঙ্গত, স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পেলে মানসিক চাপও বাড়তে শুরু করে, যা শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক।
দিনের পর দিন রাতে জেগে থাকলে খাবার ঠিক মতো হজম হতে পারে না। ফলে একদিকে যেমন গ্যাস-অম্বলের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, তেমনি ওজনও বাড়তে শুরু করে। আর যেমনটা আপনাদের সকলেরই জানা আছে যে ওজন বাড়লে ধীরে ধীরে সুগার, প্রেসার এবং কোলেস্টেরলের মতো মারণ রোগ এসে শরীরে বাসা বাঁধে। ফলে আয়ু চোখে পড়ার মতো কমে যায়।
শরীরের নিজস্ব ছন্দ বিগড়ে গেলে দেহের অন্দরে এমন কিছু নেতিবাচক পরিবর্তন হতে থাকে যে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে মা হওয়ার ক্ষেত্রে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সব মেয়েরা নিয়মিত নাইট শিফট করেন তাদের মিসক্যারেজ এবং প্রিটার্ম ডেলিভারি হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে কম ওজনের বাচ্চা জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তাই মা হওয়ার পরিকল্পনা করলে ভুলেও রাত জেগে কাজ করবেন না যেন!
সারাদিন যতই ঘুমোন না কেন, রাতে ঘুম আসতে বাধ্য। এমন পরিস্থিতিতে মনোযোগ যেমন হ্রাস পায়, তেমনি শরীরের সচলতাও কমতে শুরু করে। ফলে অফিসে চোট-আঘাত লাগার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
রাতের বেলা মস্তিষ্কের আরাম নেওয়ার সময়। তাই তো এই সময় দিনের পর দিন কাজ করলে ধীরে ধীরে ব্রেন পাওয়ার কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ডিপ্রেশন, হাইপোলার ডিজঅর্ডার, স্লো কগনিটিভ ফাংশন, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া সহ আরও সব সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
যারা রাত ১২-৩টার মধ্যে জেগে থাকেন ও ভোর ৪টার দিতে ঘুমান, তাদের ঘুমের চক্রটি নষ্ট হয়ে। ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ কাজগুলো সঠিকভাব সম্পন্ন হয় না। ঘুম কম হলে বা অনিদ্রার কারণে অলসতা বাড়ে ও কাজে মনোযোগ দেওয়া যায় না। আবার অনেকের ঘুম না হলে বমি বমি ভাব দেখা দেয়। এছাড়া শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে ঘুমের অভাবে। আসলে রাতে অর্থাৎ অন্ধকারে বাড়ে সেরোটোনিন হরমোন। এটি মনকে শান্ত করতে ও ঘুম পাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া এই হরমোন দ্রুত চোখের চলাচল (আরইএম) কে প্রভাবিত করে। যা ইলেক্ট্রোফিজিওলজিক্যাল, নিউরোকেমিক্যাল, জেনেটিক ও নিউরোফার্মাকোলজিক্যাল ভিত্তিতে ঘুমের ক্ষেত্রে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। ফলে মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠা বা না ঘুমনোর কারণে শরীর অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না, ফলে আপনি দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
রাত ১২-৩টার আগে না ঘুমালে বা এর মধ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠলে সেরোটোনিন হরমোন কমে যায়। এর পাশাপাশি ডোপামিন হরমোনের ঘাটতি হয়। ফলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় ও মস্তিষ্ক বিশ্রাম করতে পারে না।
রাত জাগলে ঘুমচক্র প্রভাবিত হয়। যা শরীরের জন্য এক ধরনের চাপ। এতে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় ও উদ্বেগের সমস্যা বাড়ে। যারা নিয়মিত রাত জাগেন তাদের মধ্যে মেজাজের পরিবর্তন ঘটে ঘন ঘন।
যারা রাত ১২-৩টা পর্যন্ত জেগে থাকেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের লোকেরা অল্প বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট সংক্রান্ত রোগের শিকার হতে পারে। কারণ শরীর অতিরিক্ত চাপ বহন করছে।
ঘুমের অভাবে হার্টের সমস্যা বাড়তে পারে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা রাত জাগলে রক্তনালি প্রভাবিত হয় ও হঠাৎ করেই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
যারা কম ঘুমায় তারা বিষণ্নতার মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সেরোটোনিন বা হ্যাপি হরমোনের ঘাটতির কারণেই বিষণ্নতা বাড়ে। যা নেতিবাচক চিন্তার জন্ম দিতে পারে।
যেভাবে নিয়ম মেনে চললে রাত জেগে কাজ করেও সুস্থ থাকবেন?
রাতে খিদে পেলে কাঠবাদাম, সয়াবিন, চিয়া বীজ, চিনে বাদাম, জাতীয় জিনিস খান। শুকনো মুড়িও ভাল। বেশি খিদে পেলে পোহা বা উপমা জাতীয় খাবার খেতে পারেন। তবে বাইরের খাবার একেবারেই খাবেন না। পিৎজা, বার্গার, বিরিয়ানির মতো খাবার এড়িয়ে চলুন
অনেকেই রাত জেগে থাকার জন্য কাপের পর কাপ চা, কফি খান। এতে কিন্তু শরীর আরও খারাপ হয়। রাত জাগলে এমনিতেই শরীর আর্দ্রতা হারাতে থাকে। ফলে আর্দ্র থাকা জরুরি। তার জন্য ৪৫ মিনিট অন্তর জল বা কোনও এনার্জি ড্রিঙ্ক খেতে থাকুন। গ্রিন টি, হার্বাল টি, লস্যি খেলে ঘুম পাবে না। অতিরিক্ত চা বা কফি এক আধ বার চলতে পারে। নরম পানীয় একেবারেই খাবেন না।
বেশি পরিশ্রম করলে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়য়। এমনকী বসে কাজ করলেও পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন। আর তাই রাতে কাজ করলে একঘন্টা ছাড়া ছাড়া এক গ্লাস পানি পান করুন। এতে শরীর পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
যাদের কোলেস্টেরল আছে তারা অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। কিন্তু যাঁরা সুস্থ স্বাভাবিক তারা রাতের রুটি বা ভাতে এক চামচ ঘি খেতেই পারেন। ঘি শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ রাখে। আর্দ্র রাখে। তবে ঘি এর পরিবর্তে টক দইও চলবে।
বাদাম- রাতে খিদে পেলে ফ্রিজ খুলে চকোলেট খান? কিংবা কফির সঙ্গে চিপস? আজই বাদ দিন এই অভ্যেস। খিদে পেলে একটা কাজুবাদাম কিংবা দুটো আমন্ড খান। এতে পেট ভরবে আর শরীরও ভালো থাকবে। সেই সঙ্গে ঘুমও ভালো হয়। আর কাজের মাঝে খেলে মনও ভালো থাকে।
শুকনো খেজুর খান কাজের মাঝে। খেজুরে আে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ। যা এনার্জি দেয়, রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রতিদিন ২-৩টে খেজুর অবশ্যই খান।
ফলের রস নয়, রাতে কাজ করতে বসে গোটা ফল খান। অনেকেই ভাবেন রাতে ফল খাওয়া ঠিক নয়, কিন্তু রাতে সবেদা, শাঁখালু, আপেল, পেয়ারা, পেঁপে এসব খেতেই পারেন। এতে পেটও ভরবে আর শরীর থাকবে ভালো। আর ফল শরীরে পুষ্টি দেয়। ফলে অনিদ্রা, হজমের গোলমাল এসব আসে না।
রাত জাগতে হলে দুপুরে রঙিন সব্জি খান বেশি করে। সবুজ শাকসব্জি হল অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের সমৃদ্ধ উৎস। এই উপাদান শরীর সতেজ রাখতে সাহায্য করে। টমেটো, গাজর, স্ট্রবেরি, সবুজ শাকসব্জি, লেবু, বেরি জাতীয় ফল এবং সব্জি বেশি করে খান। পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা করলে রাত জাগার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশই কাটানো সক্ষম।
(ঢাকাটাইমস/১২ মে/আরজেড)

মন্তব্য করুন