মোনালিসাকে কোথায় আঁকা হয়েছে, রহস্যের জট খুলল

মোনালিসা পৃথিবী বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির এক অনন্য শিল্পকর্ম। মোনালিসার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়নি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের লুভর জাদুঘরের সংরক্ষিত আছে শিল্পকর্মটি। তবে ১৯১১ সালের ২১ আগস্ট লুভর থেকে চুরি হয়ে যায় মোনালিসা। পরে অবশ্য মোনালিসার সন্ধান মেলে। লুভরে ফেরে শিল্পকর্মটি। তবে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অন্যতম বিখ্যাত শিল্পকর্ম ‘মোনালিসা’ নিয়ে আগ্রহ ও গবেষণার শেষ নেই। এর কারণ মোনালিসার রহস্যময়ী সৌন্দর্য এবং চিত্রকর্মটির মডেলের পেছনে থাকা প্রকৃতি এবং ছোট্ট সেতুটি। মোনালিসাকে ধরা হয়ে থাকে লিসা দেল জিওকোন্দো নামে ইতালির একজন অভিজাত নারীর প্রতিকৃতি হিসেবে। ইতালির কোনো একটি গ্রামে ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে এই ছবি আঁকা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিখ্যাত এই চিত্রকর্মটির মডেলের পেছনে (ব্যাকগ্রাউন্ড) থাকা প্রকৃতি ও সেতুটির অবস্থান ঘিরে কয়েক শতাব্দী ধরেই বিতর্ক চলছে। ভিঞ্চির মোনালিসার পেছনের ল্যান্ডস্কেপ (প্রকৃতি) বিরামহীনভাবে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। শিল্প সম্পর্কিত ইতিহাসবিদ পরামর্শ দিয়েছেন, যে পেছনের দৃশ্যটি কাল্পনিক ছিল। তবে অনেকে একে ইতালির নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থান বলে দাবি করে আসছেন। সম্প্রতি মোনালিসা চিত্রকর্মটি ভিঞ্চি ঠিক কোথায় এঁকেছিলেন সেই রহস্যের সমাধান হয়েছে বলে দাবি করেছেন অ্যান পিজোরুসো নামের এক ভূতত্ত্ববিদ।
রেনেসাঁ যুগের শিল্প ইতিহাসবিদ এই ভূতাত্ত্বিক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তিনি অবশেষে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত চিত্রকর্মের রহস্য সমাধান করতে পেরেছেন। খবর দ্য গার্ডিয়ান
অ্যান পিজোরুসো তার দুটি বিশেষ অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা একত্রে কাজে লাগিয়ে দাবি করেছেন উত্তর ইতালির লম্বার্ডি অঞ্চলের লেক কোমোর তীরবর্তী লেকোর সুস্পষ্ট বেশ কিছু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এঁকেছেন ভিঞ্চি।
চিত্রকর্মের সেতু, পর্বতশ্রেণি এবং লেকের সঙ্গে লেকোর ১৪ শতকের আজজোন ভিসকন্টি ব্রিজ, দক্ষিণ-পশ্চিম আল্পস এলাকাটি এবং লেক গার্লেটের সঙ্গে হুবহু মিল প্রমাণ করেছেন পিজোরুসো নামের ওই নারী। লিওনার্দো ৫০০ বছর আগে ওই স্থান পরিদর্শন করেছিলেন বলে প্রমাণাদি রয়েছে।
অ্যান পিজোরুসো বলেন, ‘এই মিলগুলো অনস্বীকার্য, যা নাকচ করা যায় না। আমি এই বিষয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। আমি সত্যিই মনে করি এটি সুস্পষ্টভাবে সেই রহস্যের উম্মোচন করেছে।’
এর আগে ২০১১ সালের দাবি করা হয়েছিল মোনালিসার পেছনের সেতু এবং সড়কটি উত্তর ইতালির একটি ছোট শহর ববিওতে ছিল। এক দশক পরে ২০২৩ সালে বলা হয় লেওনার্দো আরেজ্জো প্রদেশের সেতু এঁকেছিলেন।
তিনি বলেন, শুধু সেতু নিয়ে পর্যালোচনা করাটা যথেষ্ট ছিল না। এমন খিলানযুক্ত সেতু সেই সময় ইতালি এবং ইউরোপের বিভিন্ন স্থানেই ছিল এবং সেতুগুলো দেখতে অনেকটা একই রকম ছিল। শুধুমাত্র একটি সেতু দিয়ে চিত্রকর্মটির আঁকার অবস্থান শনাক্ত করাটা বাস্তবসম্মত নয়। আগের সবাই সেতুর কথা বলেছেন তবে কেউ ভূতাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে কথা বলেননি।
তিনি বলেন, ভূতত্ত্ববিদরা চিত্রকর্মের দিকে বেশি মনোযোগী হন না। আবার শিল্পসম্পর্কিত ইতিহাসবিদরা ভূতত্ত্বের দিকে কম মনোযোগ দেন। শিল্পবিষয়ক ইতিহাসবিদরা বলেছেন, লিওনার্দো সর্বদা তার কল্পনা ব্যবহার করেছেন। তবে আপনি এই ছবিটি বিশ্বের যে কোনও ভূতাত্ত্বিককে দেখালে তিনি সহজে বুঝতে পারবেন আমি কেন লেকোর কথা বলছি। এমনকি একজন ভূতাত্ত্বিক নন এমন যে কোন সাধারণ মানুষও এই মিল খুঁজে পাবেন।
তিনি আরও বলেন, লেকোর শিলা এবং চুনাপাথর লিওনার্দো তার চিত্রে সঠিকভাবে ধূসর-সাদা রঙে চিত্রিত করেছেন। লেকো ছাড়া ববিও বা আরেজ্জোতে কোন হ্রদ বা লেক নেই। তাই এটি যে লেকো অঞ্চল তা সুস্পষ্টভাবে চিত্রকর্মে ফুঁটে ওঠেছে।
ভিঞ্চি ষোল শতকের শুরুতে এই কালজয়ী মোনালিসা চিত্রকর্মটি এঁকেছিলেন। চিত্রকর্মটি বর্তমানে প্যারিসের লুভর জাদুঘরে রাখা হয়েছে। প্রতিবছর লাখো মানুষ এটি দেখতে যান। তবে ১৯১১ সালে চিত্রকর্মটি চুরি হওয়ার পর থেকে এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে।
পিজ্জোরুসোর মতে, কেবল সেতুর সঙ্গে মিল খুঁজলে হবে না। কারণ এ ধরনের সেতু সে সময় ইতালি ও ইউরোপে অহরহ পাওয়া যেত। ‘সবাই সেতু নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু ভূতত্ত্বের দিকটা কেউ দেখলেন না।’
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মোনালিসার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৯০৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেইন্টিং হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মোনালিসার ছবি নিয়ে এ গবেষণা করার জন্য অ্যান পিজ্জোরুসো লেকো শহরও ভ্রমণ করেছেন। মোনালিসা ও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিষয়ে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞও তার তত্ত্বের সঙ্গে একমত হয়েছেন।
মনে করা হয়, লিওনার্দো ১৫০৩ বা ১৫০৪ সালে ফ্রান্সেসকো দেল গিওকন্ডো নামে এক ধনী ফ্লোরেনটাইন ব্যবসায়ীর অনুরোধে প্রতিকৃতিটি আঁকা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসায়ী তার স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনির একটি প্রতিকৃতি চেয়েছিলেন। পেইন্টিংটি তার নতুন বাড়ির জন্য এবং তার দ্বিতীয় পুত্র আন্দ্রেয়ার জন্ম উদযাপনের জন্য করতে বলা হয়। তবে, বিশেষজ্ঞ ও স্কলারদের মধ্যে তাদের পরিচয় নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। নামকরণের ক্ষেত্রে সেই সময়ে ইতালিতে, মোনা মানে ম্যাডোনা, এভাবে সব নারীকে সম্বোধন করা হত। এখন যেমন মিসেস সম্বোধন করা হয়। এই মোনা থেকেই নামকরণ মোনালিসা হয়েছে।
উল্লেখ্য, লিওনার্দো ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পেইন্টিংটির কাজ চালিয়ে যান। তিনি মারা যাওয়ার সময় এটি অসমাপ্ত ছিল। লিওনার্দো ছবি আঁকার যেসব কৌশল তৈরি করেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল স্ফুমাটো কৌশল, যার অনুবাদ করলে দাড়ায়, 'লাইন বা সীমানা ছাড়াই ধোঁয়ার পদ্ধতি'। তৎকালীন সময়ে শিল্পীদের জন্য রূপরেখা বা লাইন তৈরি করে আঁকা একটি সাধারণ চর্চা ছিল। সে জায়গায় লিওনার্দো লাইন বা রূপরেখা ব্যবহার করেননি। আলো এবং ছায়ার বিভ্রম তৈরি করতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে তিনি কাছের সাবজেক্টগুলোকে স্পষ্ট, আর দূরের সাবজেক্টগুলোকে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সেঙ্গ অস্পষ্ট করে তোলেন।
মোনালিসার বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় কারণ হল হাসি। লিওনার্দো দৃষ্টিকোণ এবং ছায়ার কাজের মাধ্যমে এমন একটি অনন্য হাসি তৈরি করেন, যা একধরনের অপটিকাল ইলিউশন তৈরি করে। দর্শক যখনই মোনালিসার চোখের দিকে তাকায়, মুখ হাসির মতো দেখায়। কিন্তু যখন দর্শকের দৃষ্টি হাসির উপর স্থির হয়, এটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন এটি কখনই হাসি ছিল না। আবার হাসির বিভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে, কেউ কেউ মনে করে যে, এটি একটি সুখী হাসি। আবার অনেকে বিশ্বাস করে এটি একটি দুঃখের হাসি৷ পেইন্টিংটি সৃষ্টির প্রায় ৫০০ বছরেও বেশি হয়ে গেছে। এর ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি বিবর্ণ হয়ে গেলেও মোনালিসার খ্যাতি সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলেছে।
(ঢাকাটাইমস/১৩ মে/আরজেড)

মন্তব্য করুন