ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিতে খালেদা জিয়ার ভূমিকা রয়েছে: ব্যারিস্টার কাজল

অনলাইন ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২৫, ১৬:৫৪| আপডেট : ১১ জুন ২০২৫, ১৭:০৪
অ- অ+

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস‘র নোবেল পুরস্কার জয়ের পেছনে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ব্রিটিশ রাজ পরিবারের প্রিন্স চার্লস।

লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাবেক দ্বিতীয় সচিব ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচিত সদস্য ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বুধবার (১১ জুন) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানান।

ব্যারিস্টার কাজল তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে ইংল্যান্ড সফর করছেন। তিনি রাজা চার্লসের কাছ থেকে সম্মানসূচক পদক গ্রহণ করবেন এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী ‘নোবেলজয়ী’ হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু তার নোবেলপ্রাপ্তির পেছনে দু’জন ব্যক্তির ভূমিকা আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। একজন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, অন্যজন ব্রিটিশ রাজ পরিবারের প্রিন্স চার্লস, বর্তমানে যিনি রাজা ৩য় চার্লস।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বদান্যতায় বাংলাদেশ সরকারের একজন কূটনীতিক হিসেবে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। আমি ছিলাম হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব।

২০০৫ সালে রানি এলিজাবেথ কমনওয়েলথভুক্ত দেশের কূটনীতিকদের জন্য বাকিংহাম প্যালেসে একটি গার্ডেন পার্টির আয়োজন করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৎকালীন হাইকমিশনার মোফাজ্জল করিম, ডেপুটি হাইকমিশনার ড. সাইফুল ইসলাম খান ও আমি দ্বিতীয় সচিব মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল) সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলাম।

রাজকীয় রীতি অনুযায়ী প্রথমে রানি এলিজাবেথ, এরপর তার স্বামী ফিলিপস এবং প্রিন্স চার্লস সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারে সাথে কুশলাদি বিনিময় করেন। তাদের নিজ নিজ দেশের বিষয়ে আলাপ করেন।

রানি এলিজাবেথ ও তার স্বামী অনেকটা সৌজন্য করেই আমাদের সামনে দিয়ে গেলেন। এরপর এলেন প্রিন্স চার্লস। বাংলাদেশে তখন বন্যা চলছিল। প্রিন্স চার্লস বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর নিলেন। বাংলাদেশের প্রতি তার সমবেদনার কথা উল্লেখ করলেন।

বন্যা প্রসঙ্গ শেষ হতেই তিনি অকস্মাৎ বলে উঠলেন, What are you doing about Dr. Younus? (ড. ইউনূসের ব্যাপারে আপনারা কী করছেন?) এ কথা শুনে আমরা তিনজনই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আসলে বুঝতেই পারিনি তিনি কোন ড. ইউনূসের কথা বলছেন? আর প্রিন্স চার্লস বাংলাদেশের কোনো একজন একক ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলবেন, এটা তো আমাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। কিন্তু তাকে তো জিজ্ঞাসা করা যায় না যে আপনি কার কথা বলছেন? আমাদের এমন ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থার মধ্যে তিনি বলে উঠলেন, I & Hilary are trying for Younus’s Nobel prize. Your government should come forward. (ইউনূসের নোবেল পুরস্কারের জন্য আমি ও হিলারি চেষ্টা করছি। আপনাদের সরকারের এগিয়ে আসা উচিত)। হিলারি ক্লিনটনের নাম উচ্চারণ করাতে আমরা বুঝতে পারলাম, তিনি আজকের ড. ইউনূসের কথা বলছেন। আমাদের এ আলাপচারিতার আগে হিলারি ক্লিনটনকে দেশে এনে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ড. ইউনূস।

প্রিন্স চার্লস চলে যাওয়ার পর হাইকমিশনার আমাদের দু’জনের সাথে আলাপ করে প্রিন্স চার্লসের এই কথার গুরুত্ব সত্বর সরকারকে জানানোর কথা বললেন। বাকিংহাম প্যালেস থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম বাংলাদেশ হাইকমিশনে।

ডিপ্লোম্যাটিক প্রটোকল অনুযায়ী হাইকমিশনার বিষয়টি রিপোর্ট করবেন পররাষ্ট্র সচিবকে। আমি যেহেতু ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ছিলাম না, আমার আবেগের জায়গা থেকে আমি হাইকমিশনার স্যারকে বললাম, আপনি বিষয়টি সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জানান। প্রটোকল অনুযায়ী তিনি সেটিও করতে ইতস্তত বোধ করলেন। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আমার সাথে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমি তাঁকে ফোন করে হাইকমিশনার স্যারের সাথে কথা বলিয়ে দিলাম।

ড. কামাল সিদ্দিকী বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলে তিনি এ বিষয়ে হাইকমিশনারকে অবহিত করবেন। সম্ভবত সেদিন কিংবা পরদিন ড. কামাল সিদ্দিকী হাইকমিশনারকে জানালেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অবহিত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো, ‘বাংলাদেশের একজন মানুষ নোবেল পাবে, এটা তো আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়। আমাদের সরকার ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবে। ’

ড. কামাল সিদ্দিকী প্রিন্স চার্লসের সাথে কী কথা হয়েছে তার একটা হুবহু বর্ণনা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। সেই মোতাবেক হাইকমিশনার সেটি করলেন।

আগেই বলেছি, আমি ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট না। কাজেই এর পরে কী হয়েছে তা আমার আর জানার কথা ছিল না। আর নোবেল যেহেতু সুইডেন থেকে দেওয়া হয়, কাজেই লন্ডন মিশনের কাজের আওতায় এটা পড়ে না।

এদিকে বাকিংহাম প্যালেসের এই ঘটনার পর বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সুইডেনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বেশ পরিবর্তন ঘটে। লন্ডনস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোফাজ্জল করিম চাকরি শেষে দেশে ফিরে যান। সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়। আমি লন্ডন হাইকমিশনেই ছিলাম।

তখনও সুইডেনে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, লন্ডন হাইকমিশনের আমার সাবেক সহকর্মী, বর্তমানে রোমানিয়ার রাষ্ট্রদূত শাহনাজ গাজী।

২০০৫ সালের শেষার্ধে আমি পরিবারসহ বেড়াতে গিয়েছিলাম সুইডেনে। রাষ্ট্রদূত শাহনাজ গাজীর বাড়িতে ছিলাম। রাতে খাবার টেবিলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, সুইডেনে তো আমাদের দূতাবাসের কাজ কম। তো আপনি কী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন?

জবাবে তিনি যা জানালেন, আমাকে নিয়ে গেল বাকিংহাম প্যালেসে। তিনি বললেন, ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টি খালেদা জিয়া সরকারের টপ প্রায়োরিটি। আমাদেরকে সেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূস সাহেবকে নিয়ে নোবেল কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সাথে নিয়মিত বৈঠক করতে হয়। ঢাকায় রিপোর্ট করতে হয়। ড. ইউনূস নিজেও সুইডেন সফর করেছেন এবং আরও করবেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে।

শাহনাজ গাজীর কথার মর্মার্থ হলো, ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির অ্যাসাইনমেন্ট হলো পুরো বাংলাদেশের ইজ্জতের ব্যাপার। বিষয়টা যত না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, তার চেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার।

শাহনাজ গাজীর সাথে আমার আলাপচারিতা এখানেই শেষ। আমিও আর এ বিষয়ে খবর রাখিনি। পরবর্তীতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ২০০৬ সালে।

তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়া এত বেশি সিরিয়াস ছিলেন যে, সুইডেনে নিযুক্ত পরবর্তী রাষ্ট্রদূত জনাব আজিজুল হক যখন সুইডেনের রাজার কাছে তাঁর পরিচয়পত্র পেশ করেন, তিনি তখন ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন প্রকাশ করেন এবং সুইডেনের রাজার সহযোগিতা কামনা করেন।

এভাবেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল বিজয়ী হয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু এত বড় অর্জনের পেছনের দু’জন কারিগর, বেগম খালেদা জিয়া ও প্রিন্স চার্লসের ভূমিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। নিশ্চয়ই বেগম খালেদা জিয়া করেছেন দেশের টানে, প্রিন্স চার্লস হয়তো করেছেন বন্ধুত্বের টানে। দেশপ্রেম ও বন্ধুত্ব উভয়ই জাগরূক থাকুক।

(ঢাকাটাইমস/১১জুন/এলকে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার আরও যেসব কারণ সামনে আসছে
আহমেদাবাদ বিমান দুর্ঘটনা: নিহত বেড়ে ২৯১
মুরাদনগরে ট্রাফিক লাইনম্যানকে পিটিয়ে যখম করল এনসিপি নেতারা
নিষেধাজ্ঞার পর জেলের জালে ধরা পড়লো ৪৩ মণ ইলিশ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা