নাটের গুরু এইচ টি ইমাম এবং সিইসি নুরুল হুদার হু হু কান্না

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তখন দুর্দণ্ড প্রতাপশালী। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান করেন শেখ হাসিনা। সেবার দিনের ভোট আগের রাতে করার নাটের গুরু ছিলেন এই এইচ টি ইমাম।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর হতভম্ভ ও মুষড়ে পড়েছিলেন তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। কারণ এমন নির্বাচনের সব দায়ভার যে তার। ফলাফল ঘোষণার দুই দিন পর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে নিজের কক্ষে কয়েকজন কর্মকর্তার সামনেই হু হু কেঁদে ওঠেন তিনি। আর হতাশা প্রকাশ করছিলেন এইচ টি ইমামের কাণ্ডে।
এইচ টি ইমামের পুরো নাম হোসেন তৌফিক ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রশাসনে ছিলেন উপসচিব। স্বাধীনতার পর পদোন্নতি দিয়ে তাকে বানানো হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারের শপথ পড়ানোর সব আয়োজন করেছিলেন এইচ টি ইমাম।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। এরশাদ সরকারের শাসনামলে একপর্যায়ে আবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। স্বাভাবিকভাবেই চাকরি থেকে অবসর নেন ইমাম।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দুর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম। অবশ্য নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ পান তিনি।
তখন থেকে এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে আমলাদের পোস্টিং ও প্রমোশনের অভিযোগ উঠতে থাকে। সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আড়ালে-আবডালে তাকে ডাকতেন ‘হাতে টাকা ইমাম’। এক হাতে টাকা দাও, অন্য হাতে পোস্টিং-প্রমোশন নাও।
২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার প্রথম তিন মেয়াদেই উপদেষ্টা ছিলেন এইচ টি ইমাম। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা পক্ষের মধ্যস্থতায় নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয় বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবার তাদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় শুরু হয় সবগুলো দলের নির্বাচনী কার্যক্রম। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে শেখ হাসিনার সাথে কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান এইচ টি ইমাম।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন কে এম নুরুল হুদা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের বছর সরকার তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেয়।
এর আগে ২০০১ সালের বিএনপি সরকার নুরুল হুদাকে যুগ্ম সচিব হিসাবে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্টের রায়ে পূর্ণ সচিব হিসাবে পদোন্নতিসহ অবসরে যান তিনি। তারও প্রায় ৯ বছর পর তাকে সিইসি করে শেখ হাসিনার সরকার।
পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের নির্বাচনটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে করার নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে বসে পুরো নির্বাচন পরিচালনা করছিলেন এইচ টি ইমাম। তার প্রধান কাজ ছিল দেশের ৬৪ জন জেলা প্রশাসকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। সিইসি নুরুল হুদাকেও নানা রকম নির্দেশনা পাঠাতেন তিনি। আর স্বাধীন সাংবিধানিক পদে থেকেও এইচ টি ইমামের কথা সিইসি নুরুল হুদা মেনে চলতেন। নির্বাচনের সময় সিইসির নানা কথা মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয়।
এরপরও সিইসি নুরুল হুদার ধারণা ছিল নির্বাচনে ৭০ থেকে ৮০টি আসন পাবে বিএনপি। ভোটগ্রহণের সপ্তাহখানেক আগেও নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাকে এমন ধারণা দিয়েছেন।
কিন্তু সবকিছু উল্টে দেন এইচ টি ইমমা। প্রত্যেক জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কথামতো কাজ করার নির্দেশ দেন। ভোটগ্রহণের আগের দিন বলে দেন, রাতেই ব্যালট বাক্সে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যালট পেপার ভরে রাখতে হবে।
জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন অক্ষরে অক্ষরে এইচ টি ইমামের নির্দেশ পালন করে। এভাবেই রচিত হয় দিনের ভোট আগের রাতে করার কলঙ্কজনক ইতিহাস।
৩০০ আসনের ফলাফল ঘোষণার পর হতচকিত হয়ে যান সিইসি নুরুল হুদা। বিএনপি পায় মাত্র ছয়টি আসন! রাতের ভোটে যে এতটা কেলেঙ্কারি হবে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তিনি।
পরের দিন অফিসে নিজের কক্ষে উপস্থিতদের কাছে হতাশা প্রকাশের এক পর্যায়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন সিইসি নুরুল হুদা। বারবার বলছিলেন, ‘এইচ টি ইমাম বললেন কী, আর করলেন কী!’
(ঢাকাটাইমস/২৪জুন/এমএইচএল/মোআ)

মন্তব্য করুন