গণপরিবহন কি নারীর যুদ্ধ ক্ষেত্র?
-এই মহিলা বাসে উঠা নিষেধ, মহিলা বাসে উঠা নিষেধ।
-ভাই যেতে হবে তো নিয়ে যান না।
-না, মহিলা উডা যাবে না অন্যদিকে যান।
এসব আচরণ রোজ সইতে সইতে দৃশ্যপটও মুখস্থ প্রায় ভুক্তভোগী সব নারীদের।ব্যস্ত নগরীর রাজপথের দৈনন্দিন চিত্র এটি।
বর্তমান দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি নারীর হাতেই । দেশের রেমিটেন্স থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা সমপর্যায়ের চেয়েও অধিক আর অর্থনীতির কাণ্ডারি নারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে রোজ চাতক পাখির মত হা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে একটি বাসের অপেক্ষায় পায়ে ঝিম ধরাতে হয়। সিটিং সার্ভিস থেকে শুরু করে লোকাল বাসেও পুরুষদের আধিপত্যে মেয়েদের উঠা নিষেধ।
নিষেধ এ কারনেই যে আমাদের ভাইয়ারা সংরক্ষিত আসনেরও গা এলিয়ে আরাম করে যাচ্ছে যে। আর বাস কর্মীদের ‘অন্যদিকে যান’ কথা শুনলে মনে হয় তার কাছে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ভিক্ষা চাওয়া হচ্ছে যাতে তিনি বিরক্ত হয়ে অন্য রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছেন।
কোনমত উঠার পরেও শুনতে হয নানা কটূক্তি।
-এত্ত ভিড়ের মইধ্যেই মহিলা উঠাইছ কেন?
-ওই ড্রাইভার আর একটা মহিলাও উঠাইবা না।
দলে ভারী দেখে কোনমতে উঠা নারীটি নিজেকে ভাবতে শুরু করেন, অপরাধী জবুথবু হয়ে বাসে এক কোণায় দাড়ানোটাও যেন তার কাছে নিতান্তই পাপ। মনে মনে সে দোষ দেন হয়ত পরিস্থিতিকে, নিজেকে। তবুও পথে তো তাকে নামতেই হচ্ছেই ভেবে মেনে নিচ্ছেন সুবোধ বালিকার মতো সব কিছু।হয়ত মনে ভেসে উঠছে রবীন্দ্রনাথের সেই লাইন, ‘মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া যে এক নয়।’
আসা যাক ‘বাস যুদ্ধ’ পর্বে, প্রথম যুদ্ধ -বাসে উঠার পর প্রতিনিয়তই এই দৃশ্য দেখতে মেলে যে সংরক্ষিত নারী আসনে গেড়ে আছেন পুরুষরা । ‘ভাই এটা তো নারীদের জন্য’ বলার সাথে সাথেই প্রতি উত্তর- ‘তো আমি কী করব? আমি আগে বসছি আর আপনারা যে পুরুষ সিট দখল করে বসে আছেন? সেটা তো আমরা কিছু বলছি না।’
যদি শিক্ষার অগ্রগতির কথা বলি তবে শিক্ষাঙ্গনে বিংশ শতাব্দিতে প্রথম চরণ পুরুষেদেরই পরে যখন কি না তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থাপকদের মতে নারীদের পড়াশুনা ছিল পাপ্ আর হাতের লেখা দেখলেতো রক্ষেই ছিল না। যাই হোক সে ভিন্ন প্রেক্ষাপট আসা যাক বর্তমান পরিস্থিতে শিক্ষার হারের তালের সাথে জিপিএর দিক থেকেও পুরুষ সমাজ এগিয়ে। আর যারা দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াত করছেন স্যুট, টাই পড়া ভাইয়ারা নিশ্চই একবারে অজ্ঞ মূর্খ্য নয়, অন্তত আদর্শলিপি থেকে বানানটুকু তো তারা শিখেছেনই। তবে কেন রে ভাই প্রতিদিন একটা মেয়েকে বাসে সংরক্ষিত আসনের ব্যখ্যা দিতে হয়? আর সাধারণ আসন আর সংরক্ষিত নারী আসনের তফাৎ কেন আমদের এই শিক্ষিত ভাইয়াদের রোজ শেখাতে হয়?
এবার দ্বিতীয় যুদ্ধ- বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষরা বাসে উঠলেই শুরু হয়ে যায় তাদের নানান ব্যমো। গাছ থেকে ছেড়া তরতাজা ফুলের মতো বাসে উঠার পরক্ষণেই তারা নেতিয়ে পরেন। সুস্থ , সবল, হওয়ার পরেও বাসে নারীদের গা না ঘেঁষে তারা দাঁড়াতেই যেন পারেন না। আরে, জানিরে ভাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, তাই বলে সুযোগটা এভাবে লুফে নিতে হবে?
তৃতীয় যুদ্ধ, বাস থেকে সময় একটা নারীর জন্য যেনো ক্রমেই রাস্তা সংকুচিত হয়ে আসে। ভাই উঠতেও দিবেন না , নামতেও দিবেন না যাবটা কোথায়? আমাদের জীবনের রাস্তা আর সংকুচিত করবেন আপনারা?
এবার আসা যাক ভিন্ন দৃশ্যপটে আত্মীক বন্ধন কথাটা খুবই আপন। রক্তের সাথে সংযুক্ত যখনই কোন পুরুষের সঙ্গে তার মা বাসে উঠে, ঠিক কেমনে যেনো দৃশ্যপটই পরিবর্তন হয়ে যায়! তখন আর নারী আসন চিনতে গায়ের গেদু মিয়ারও সমস্যা হয় না। এমনকি নিজে কোমর হেলিয়ে বসার আয়েশ বিসর্জন দিয়ে মমতাময়ী মাকে বসার ব্যবস্থা করে দেন। বোনটিকে বসার ব্যবস্থা করার জন্য ব্যাকুলতা দেখেছি এই পুরুষের চোখেই আর মহান প্রেমিকা নিয়ে বাসে উঠলেতো কথাই নেই, নিজে হাজার ধাক্কা সহ্য করবেন কিন্তু প্রেমিকার শরীরে ফুলের স্পর্শও নয় আর একসাথে বসলেতো সোনায় সোহাগা।
নামার সময় নিজ প্রেমিকাকে এসএসএফ এর চাইতেও কড়া নিরাপত্তায় নামার ব্যবস্থা করে দেন আমদের এই পুরুষরাই। নাহ্ পুরুষ কোন গালি নয়। পুরুষ আমার বাবা, পুরুষ আমার ভাই, পুরুষ আমারই সন্তান। কিন্তু ভাইয়ারা যেই মায়ের কষ্টে আপনি সিটের নিশ্চয়তা খোঁজেন, যেই বোনের কষ্টে আপনি নিজে দাঁড়িয়ে যান।
যেই প্রিয়তমার জন্য আপনার এত্ত কড়া নিরাপত্তা। কে সেই নারী ? আপনি যেমন নিজের মা বোনকে ‘গার্ড অব অনার’ দিচ্ছেন, ঠিক একইভাবে আপনার অবর্তমানে অপরিচিত নারীদের সঙ্গে একই আচরণ করছেন না তো?
আমিও কোন বাবার আদুরে কন্যা, ভাইয়ের বোন, কারো প্রিয়তমা তবে আমার বেলায় এমন কেন???? আমিইতো সেই নারী।
লেখক: সাংবাদিক, রেডিও টুডে