মানসিক চাপ দূর করতে নিজেকে জানতে হবে সর্বাগ্রে

নন্দিনী লুইজা
 | প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২৪, ১৩:০৪

মানুষ প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতিতে গাছপালা, লতা-পাতা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত যা কিছুই দেখি না কেন সবকিছুই প্রকৃতির সম্পদ। আর এই সম্পদগুলো ব্যবহার হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জন্য। কেননা মানুষ এমন একটি প্রাণী যার মধ্যে রয়েছে বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান, দুঃখ, কষ্ট বোঝার উপলব্ধি এবং ভালো-মন্দকে চেনার ক্ষমতা। সবকিছুই রয়েছে এই মানুষের মধ্যে।

মানুষের মন এক বিচিত্র ধরনের অনুভূতির ভান্ডার। এই মনের মধ্যে যে অনবরত কত ধরনের খেলা চলে, কত রং-বেরঙের ভাবনা সে ভাবে, তার সবটাই মানুষ সব সময় একই মাত্রায় বুঝতে পারে না; পুরোপুরি অনুধাবনও করতে পারে না। সত্যিকার অর্থে সে কী চায় আর কী পায় ও কী পায় না- এই দ্বন্দ্বের কারণে তার মধ্যে চলে অবিরাম এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে সে দিনে দিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যেটা কিনা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় খুবই কম।

শারীরিক অসুস্থতা থাকলে দেখা যায় যে- ওষুধ খেয়ে তার নিবারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু মনের মধ্যে যে অসুস্থতা তৈরি হয় তা অনেক সময় সাধারণ মানুষ বাইরে থেকে বুঝতে পারে না। তার আচার-আচরণ বিধি, চলাফেরা কোনোটাতেই সে বুঝতে পারে না যে- সে আসলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে ক্রমাগত।

তাই কারো মানসিক ভারসাম্যের বিষয়কে যদি বুঝতে হয় তাহলে একটা মানুষকে নিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে অনেক ধরনের গবেষণা করতে হয়। তার জীবনের অনেক নেপথ্য ইতিহাস ঘাটতে হয়। অনেক কথা বলতে হয়। সময় দিতে হয়। সেই কারণে একটা মানুষের মানসিক অবস্থা কী, সে কী অবস্থায় চলছে তা অনেক সময় কাছের মানুষরাও টের পায় না; সেই মানুষটার ভেতরে কোনোভাবেই পৌঁছাতে পারে না, সে ক্ষেত্রে অন্য বিষয়ে তারা যত অভিজ্ঞ মানুষই হোক না কেন? তার মনের অবস্থা পারিপার্শ্বিকতা এবং সে কী বলতে চায় তার কোনো একটা বিষয়ের কাছেই কেউ যেতে পারে না- যতক্ষণ পর্যন্ত না মনোবিজ্ঞানের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে এবং মানবিকবোধসম্পন্নভাবে ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে তার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়।

তাই আমরা সবার আগে যে কাজটি করবো সেটা হলো- একজন মানুষের মনের বর্তমান অবস্থাটা প্রথমেই বুঝতে চেষ্টা করা। জন্ম থেকেই একটা শিশু তার পারিপার্শি^ক পরিবেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা নির্দিষ্ট মানসিকতার মধ্যে, একটা চিরপরিচিত পরিমণ্ডলে বড়ো হতে থাকে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুরা কথা বলতে পারে না বটে তবে আচরণ দিয়ে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকে ঠিকই। যেহেতু মায়ের গর্ভে সে জন্মগ্রহণ করে, মায়ের সঙ্গেই তার নাড়ির সম্পর্ক- আর এ কারণেই মা তার যেকোনো আকার ইঙ্গিত সহজেই বাবা এবং পরিবারের অন্য যেকোনো সদস্যের চেয়ে আগে ও দ্রুত বুঝতে পারেন। সেই জন্য তো সকল সমাজেই মাকে বলা হয় সন্তানের জন্য প্রথম আদর্শ ব্যক্তি। বলা হয়ে থাকে- সন্তানের জন্য এম এ পাস মায়ের আসলে কোনো প্রয়োজন নেই, দরকার হচ্ছে সুষ্ঠু জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন একজন সৃজনশীল মা। নেপোলিয়ন বলেছিলেন- ‘আমাকে একটি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি জাতি উপহার দেবো’। এখান থেকেও সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে- একজন নারী, একজন মা একটি জাতির জন্য কত বড়ো ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বলার অপেক্ষা রাখে না- নারীরা যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয় তাহলে পরিবার ও সমাজ হবে অনেক সুন্দর; পৃথিবীও হয়ে ওঠবে অত্যন্ত মনোরম, সমাজটাও পাল্টে যাবে ভালোর দিকে, শুভ ও কল্যাণের দিকে। সে কারণেই নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশপাশি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে সবদিক থেকে এবং সেটাই সবার আগে।

সুশিক্ষিত হয়ে প্রতিটি নারীকে সুন্দর মন-মানসিকতা নিয়ে, প্রগতিশীল চেতনায় এবং সৃজনশীল ভাবনায় এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রত্যেক পরিবারেরও রয়েছে একটা নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদিও আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে নারীরা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। তবে লেখাপড়ার দিক থেকে নারীরা যতটা এগিয়ে এসেছে, প্রগতিশীলতা, ইতিবাচক মন-মানসিকতা এবং পারিপার্শ্বিকতায় আবার ততটা এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। এটা যে সবার বেলায়ই সত্যি তাও অবশ্য নয়- এটা কারো-কারো বেলায় হয়তো সত্যি। এতে করে যে অসুবিধাটা হচ্ছে সেটা হলো- নারী নিজেকে সঠিক মূল্যায়ন না করে উল্টো পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছে। মনে রাখতে হবে- এখানে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতাটা বড়ো কথা নয়- সবকিছু সমন্বয় করে নিজের যোগ্যতা, মেধা ও সৃজনশীলতাকে সঠিক জায়গায় পরিমাপ করাটাই হলো মূল কাজ। সে ক্ষেত্রে নারীকে তার সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রগতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নিজের অবস্থানকে তৈরি করতে হবে। তাহলেই নারী নিজের জন্য একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে পারবে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি- আমাদের চারপাশে বর্তমানে যে হারে মানুষের মানসিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে- এর পেছনের সবগুলো কারণ আমরা অনুসন্ধান করতে পারিনি। তবে আমরা বেশিরভাগ মানুষই ‘চিল কান নিয়ে গেছে’ মনে করে চিলের পিছে কেবল প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি, কেউ কানে হাত দিচ্ছি না। এই যে নিজেকে বিশ্লেষণ না করা, এটা একটি সাংঘাতিক ভুল। নিজের অক্ষমতা, নিজের প্রাপ্তি সম্বন্ধে সঠিকভাবে না জেনে অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া, অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা- এটা কখনোই ইতিবাচক নয়, মঙ্গলজনকও নয়। এভাবে নিজেকে বুঝতে না পারা যে মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে দারুণ অন্তরায়, এটা সবাইকে বুঝতে হবে।

নিজেকে বুঝার ক্ষেত্রে সবার আগে পরিবারের ভূমিকাই প্রথম। কেননা পরিবারের মধ্যে যারা বাস করেন তাদের মধ্যে যদি খোলামেলা আলোচনা, একে অপরকে চেনাজানা বেশি হয় তাহলে এই প্রভাবগুলো আস্তে আস্তে প্রতিবেশী, পাড়া, মহল্লায় এমনকি কর্মক্ষেত্রেও প্রকাশ পেতে শুরু করে। যেমন: যদি বলি একজন শিক্ষক ক্লাসের পঞ্চাশজন বাচ্চাকে পড়ায়। সে প্রত্যেকটা ছাত্রের অবস্থা প্রতিদিন দেখে; পঞ্চাশটা পরিবারের চালচিত্র সে পরোক্ষভাবে হলেও বুঝতে পারে। তাকে পঞ্চাশটা পরিবারে স্বশরীরে যেতে হয় না। তাই পরিবারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে সবাইকে। পরিবারের সদস্যরা যদি একে অপরের প্রতি ধৈর্য্য, সহ্য, সহনশীলতা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায় এবং খোলামেলাভাবে পারস্পরিক আচরণগত মহত্তের প্রকাশ ঘটায়, বিশুদ্ধতার চর্চা করে তাহলে তারা সঠিকভাবে মানসিক বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হবে- অন্যদিকে তাদের সৃজনশীল বিকাশও ঘটতে থাকবে। যদি সমাজের প্রত্যেকটি পরিবারে একটা সুস্থ ধারার প্রবাহ চলতে থাকে তাহলে প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক উৎকর্ষ খুবই আশাব্যঞ্জকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমানে খেয়াল করলেই দেখা যায় যে- এ সময় মানসিক রোগীর সংখ্যা আমাদের সমাজে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তরুণ তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রেমের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আজকে প্রেম হচ্ছে, কালকে বিয়ে করছে, পরশু ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। এই যে সমাজের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে এটা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি, এই ব্যাধি সাড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে মানুষের মানসিক বিকারগ্রস্ততা আরো বাড়তেই থাকবে। তখন ধ্বংস হবে পরিবার; পরিবার থেকে সমাজ; সমাজ থেকে রাষ্ট্র- যা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না।

পরিবারের সদস্যদের একে-অপরের সঙ্গে বোঝাপড়া সেভাবে হয়ে ওঠে না বলে বাবা-মাও তার সন্তানদেরকে অনেক সময় সঠিকভাবে চিনতে পারেন না। অন্যেরা ধরিয়ে দিলেও তা বিশ্বাস করতে চান না। মনে রাখতে হবে- সন্তানরা বাবা-মার সঙ্গে যে আচরণটা করে সেটাই বাইরে তাদের মূল আচরণ নাও হতে পারে। এই যে সন্তানদের সম্বন্ধে না জানা, না বোঝা- এটা কিন্তু মানসিক দীনহীনতারই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সন্তানের প্রতি ভালো-মন্দের প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাবা মায়ের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এর ফলে সন্তানরা আত্মবিশ্বাসী তথা আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত ভুলে যায়। পরিবারে বাবা মায়েরা সন্তানগুলোকে ‘আমার-আমার’ বিষয়কে এত বেশি বলতে শেখায় যে- অন্যের সন্তানের সঙ্গে প্রতিনিয়তই প্রতিযোগিতা আর তুলনা করতে তারা পছন্দ করে। এর ফলে এই সন্তানগুলো অনেক সময় নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে না পেরে নিজের উপরই অত্যাচার, নির্যাতন করে ফেলে- যা বাবা-মা মোটেও টের পায় না।

আবার দেখা যায়- কেউ ঠাণ্ডা মাথায় সুস্থ মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে না। সবার মধ্যে কেন জানি একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেউ কাউকে চিনছে না, জানছে না, বুঝছে না- যখন যেটা মন চাচ্ছে সেটাই করছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি বড়ো বড়ো সিদ্ধান্তের কাজ হয়ে থাকে সেটাকে আমরা কখনোই সুস্থধারার কাজ বলতে পারি না। দুঃখের বিষয়- পারিবারিক, রাজনীতিক, সামাজিক কোথাও সুস্থতার চর্চা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রাজনীতির অঙ্গনে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে কোথাও সুস্থধারার প্রবাহ দেখছি না। ফলে আমরা মানসিকভাবে এতটাই বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছি যে, কোনটা করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না তা স্থিরভাবে চিন্তাও করতে পারছি না। আমরা কেউই ভাবছি না, আমাদের নিজেদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে অন্য পথে হাটলে কোনোভাবেই মুক্তি মিলবে না। পদে পদে আসবে সমস্যা আর সমস্যা।

আসলে আমাদের নিজেকে চিনতে হবে সবার আগে। নিজেকে চিনলেই অন্য সবকিছুকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে। না হলে নয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস ‘নো দ্যাই সেল্ফ বা নিজেকে জানো’ বলে যে শ্রেষ্ঠ উক্তিটি করে গেছেন সেটাই হলো আসল কথা। এই কথাটার বিশ্লেষণ সঠিকভাবে করতে পারলে জীবনের অনেক সমস্যারই সমাধান আপনা-আপনিই হয়ে যাবে। তাই আমাদের উচিত নিজেকে চেনা, জানা ও সঠিকভাবে অনুধাবন করা। আর এটাই হলো প্রতিটি মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে প্রথম ও মৌলিক অভিব্যক্তি।

নন্দিনী লুইজা: কবি, লেখক ও সমাজকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :